
আদিযুগ থেকে আমরা যখন ধীরে ধীরে সভ্যজগতে পদার্পণ করতে শিখেছি। সেইসাথে মনের ভাব প্রকাশের দিক দিয়েও আমাদের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আদিযুগের আদিম মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করতে আকার ইঙ্গিতে। মানে চোখের ইশারায়। এরপর মুখের শব্দ ধ্বনিতে ডাক চিৎকার, হাউমাউ করে একে অপরের সাথে মনের ভাব বিনিম করতো। এরও অনেকে পরে হয়েছে ভাষার আবিস্কার। ভাষা আবিষ্কারের অনেক পরে ভাষার শব্দ নিয়ে বর্ণ চিহ্ন বা অক্ষরের আবিষ্কার। সেইসাথে শুরু হয় লিপি বা লেখার চেষ্টা। চেষ্টা সফল হলে আবিস্কার হয় লেখবার কলম ও পাত্র বা কাগজ। শুরু হয় বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন জাতিগত ভাষা ও ভাষার গবেষণা। কেউ ইংরেজি, কেউ ফারসি, কেউ হিন্দি, কেউ উর্দু, কেউ আরবি, কেউ বাংলা নিয়ে। আবিষ্কার হয় বিভিন্ন দেশে বিভিন্নরকম ভাষা শেখার বইপুস্তক। শুরু হয় দেশবিদেশে শিক্ষা কার্যক্রম।
আমরা বাঙালি। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। মানে মায়ের ভাষা। যা আমরা শিশুকাল থেকে মায়ের মুখের ভাষা শুনে নিজেরাই বলতে শিখেছি। তাই বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের লেখা-পড়ার প্রথম ধাপই শুরু হয় বাংলা স্বরবর্ণ অ,আ,ই,ঈ, আর ব্যঞ্জনবর্ণ ক,খ,গ,ঘ দিয়ে। এরপরও বিভিন্ন দেশের ভাষাভাষীদের সাথে ভাব বিনিময়ের জন্য আমরা বিভিন্ন দেশের ভাষাও শিখে থাকি। পাশাপাশি শিখে থাকি হিসাব-নিকাশের নানারকম পদ্ধতিও। যেমন– শতকিয়া ১২৩৪ হতে ১০০শো পর্যন্ত। নামতা, যা গুন করার প্রযোজ্য হয়। অঙ্ক–করা হয় যোগ, বিয়োগ, পূরণ, ভাগ, লসাগু, গসাগু দিয়ে। আরও আছে ভূমির পরিমাপ জ্যামিতির হিসাব-নিকাশ ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে দিন যাচ্ছে তো মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাও বদলাচ্ছে। সাথে বদলে যাচ্ছে এককালের বাঙালি সনাতনী হিসাব-নিকাশের পদ্ধতিও। তাতে অবশ্য হিসাবের তেমন অসুবিধা হচ্ছে না, বরং দিনদিন ডিজিটাল পদ্ধতিতে খুব ভালোভাবেই হিসাবের কাজ চলছে।
তবে হেরফের দেখা যায় হিসাবসম্পর্কিত বেশ কিছু শব্দের অর্থের। কিছু শব্দ তাদের নিজস্ব আভিধানিক অর্থ হারিয়ে ঠাঁই নিয়েছে মানুষের মুখের ভাষায়। যার কারণে শব্দের মূল অর্থ পরিত্যাগ করে সম্পূর্ণ নতুন অর্থ ধারণ করে বসে আছে।
যেমন: এক নিমেষে, ক্ষণ, প্রতিক্ষণ, এক মুহূর্ত এমন আরও কিছু শব্দ। তবে এসব শব্দ আমরা একে অপরের সাথে হরহামেশাই ব্যবহার করি বা উচ্চারণ করি। কিন্তু আমরা এসব কিছু শব্দের সঠিক আভিধানিক অর্থ কী এবং আমরা ব্যবহারই বা করছি কীভাবে, তা অনেকের কাছেই থেকে যায় অজানা। তাহলে জেনে নিন এবং এক নিমেষে পড়ুন! আর ভাবুন শব্দের হিসাব কাকে বলে?
নিমেষ বা নিমেষে:
আমরা হরহামেশাই বলে থাকি, ‘এতোদিনের সু-সম্পর্ক এক নিমেষে শেষ হয়ে গেল!’ কিন্তু এক নিমেষ কী? নিমেষ বা নিমেষে-এর আভিধানিক অর্থ হলো–পলকহীন/ মানে দেখতে না দেখতে যা ঘটে যায়! তাহলে এর সময় কতটুকু? এক নিমেষ বা নিমেষে= ১৬ মিনিটে এক নিমেষ।
ক্ষণ:
যেমন–যতক্ষণ, ততক্ষণ, সর্বক্ষণ, কিছুক্ষণ, দিনক্ষণ ইত্যাদি হলেও, আমরা কারোর প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আফসোস করে বলে থাকি, ‘তোমার জন্য প্রতিটি ক্ষন পথের পানে চেয়ে থাকি!’ কিন্তু এই ক্ষণ কী এবং কত সময়? ক্ষণ /বিশেষ্য পদ/ কালের অংশবিশেষ; সময়, মুহূর্ত, অল্পকাল ক্ষণমাত্র.। ক্ষণকাল /বিশেষ্য পদ/ অতি সামান্য সময়। তাই আমরা সবাই জানি কালের অতি অল্প সময় হলো ক্ষণ। এই ক্ষণেরও কিন্তু একটা সময় আছে! ক্ষণ’র সময় হলো, এক নিমেষের চার ভাগের এক ভাগ সময় অর্থাৎ ১৬÷৪=একটা ক্ষণ। তবে জ্যোতিষশাস্ত্রে একটা ক্ষণ ৪৮ মিনিটে।
দণ্ড:
যেমন–মানদণ্ড, মৃত্যুদণ্ড, গুরুদণ্ড, কারাদণ্ড, প্রাণদণ্ড ইত্যাদি ইত্যাদি।
আসল কথায় দণ্ড হলো দমনযন্ত্র! মানে যা দিয়ে দমন করা যায়। মানে চারহাত লম্বা লাঠি বা ডাণ্ডা। দণ্ড মানে জরিমানা, শাস্তি। দণ্ড মানে সাজা।
জানা যায় কোনোএক সময় নির্ধারণের ঘড়ি বা সময়ের যন্ত্র আবিষ্কার হয়নি, তখন প্রাচীন ভারতে খাড়াভাবে স্থাপিত দণ্ডের ছায়া মেপে সময় নির্ণয় করতো। দণ্ডের ছায়া পরিমাপ করে হিসাব হতো—এক দণ্ড, দুই দণ্ড ইত্যাদি। দণ্ড’র সময়ের মাপ হলো ২৪ মিনিট।
পল:
পল এখন কেউ ব্যবহার করে না। কারণ পল’র টাইম খুব! কিন্তু এর আভিধানিক অর্থ থেকে যাবে চিরকাল। পল /বিশেষ্য পদ/ ১/৬০ দন্ড বা ২৪ সেকেন্ড ক্ষণকাল। মানে মাত্র ২৪ সেকেন্ডে এক পল।
মুহূর্ত:
এক মুহূর্তের মধ্যে সে হারিয়ে গেলো। আমরা এই শব্দটা বারংবার ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু কিন্তু মুহূর্ত মানে কতো সময় সেটা নিয়ে কেউ ভাবি না। তাহলে মুহূর্ত কী এবং কতো সময়? মুহূর্ত /বিশেষ্য পদ/ অত্যল্পকাল, সামান্য ক্ষণ! কিন্তু মুহূর্তটা বেশ বড়ো, বারো ক্ষণে এক মুহূর্ত! মানে দিবারাত্রের ত্রিশ ভাগের এক ভাগ ৪৮ মিনিট।
প্রহর:
যেমন–এক প্রহর, দুই প্রহর, ২৪ প্রহর, ৪৮ প্রহর ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের হরিনাম সংকীর্তনের পোস্টারে লেখা থাকে ২৪ প্রহর বা ৪৮ প্রহর ব্যপী হরিনাম সংকীর্তন। যার আভিধানিক অর্থ হলো প্রহর /বিশেষ্য পদ/ দিনের বিভাগ। যা দিনরাতের অংশকে প্রহর বলি। কিন্তু প্রহর কতো সময়? এক প্রহর হলো তিনঘন্টা। আটপৌরে অর্থাৎ অষ্ট প্রহর হলো একদিন ও রাত, মানে ২৪ ঘন্টা।
ক্রোশ:
ক্রোশ, কোশ / দূরত্বের পরিমাপবিশেষ; দুই মাইলের কিছু বেশী। এই ক্রোশ আক্রোশ নয়! এই ক্রোশ রৈখিক হিসেবে মাপা হয়। তাহলে কতটা দূরত্বে এক ক্রোশ হয়? তিন আঙুল= এক মুষ্টি। তিন মুষ্টি≠ এক বিঘত। দুই বিঘতে এক হাত, চার হাতে এক ধনু, কুড়ি ধনুকে এক রশি আর দুই হাজার ধনুতে এক ক্রোশ। এখনকার দূরত্বের হিসাবে প্রায় আড়াই কিলোমিটারে এক ক্রোশ।
যোজন:
লেখকরা লেখে যোজন যোজন পথ হেঁটে চলেছে পথিক। কিন্তু এর দূরত্ব কতটুকু? যোজন /বিশেষণ পদ/ একত্রকরণ; নিয়োজন; চারক্রোশ পরিমাণ দৈর্ঘ্য।
যোজন খুব বেশি পথ না! মানে দশ কিলোমিটারে এক যোজন।
বি.দ্র. আমি কোনও ভাষাবিদ নই! তথ্য সংগ্রহ করেছি অনলাইন অভিধান থেকে। আর লিখেছি নিজের মতো করে।
ছবি সংগ্রহ ইন্টারনেট থেকে।
৩০টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত-ই শিক্ষা। মানলাম।
তবে আর যাই বলুন, লসাগু গসাগু ভাল পাই না।
নিতাই বাবু
শ্রদ্ধেয় দাদা, লসাগু গসাগু আগে নিজের মাথায়ও বেশি একটা খেলেনি! আপনাদের সংস্পর্শে এসে এখন কিছুটা কাজ করছে। আশা করি ভগ্নাংশ নিয়ে আর বেশি চিন্তায় পড়তে হবে না। ভালো থাকবেন শ্রদ্ধেয় কবি ছাইরাছ দাদা।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
দাদা অসাধারণ। সময় নিয়ে এভাবে জানা ছিলো না। শুধু ব্যবহার করেই গেছি। অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা রইলো
নিতাই বাবু
আপনার প্রতিও রইল শুভেচ্ছা সহ শুভকামনা। আশা করি ভালো থাকবেন নিশ্চয়!
সুরাইয়া পারভীন
সত্যিই দাদা আপনার জবাব নেই। যে শব্দ গুলো সবসময় ব্যবহার করি তার এমন ব্যাখ্যা নিয়ে কখনো ভেবেই দেখিনি। দারুণ পোস্ট 👏👏👏
নিতাই বাবু
মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ সহ শুভকামনা থাকলো।
সুপায়ন বড়ুয়া
শব্দ দিয়ে একটি
অর্থবহ সমৃদ্ধ লেখা হলো।
শুভ কামনা দাদা।
নিতাই বাবু
মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ সহ শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয় কবি দাদা।
আরজু মুক্তা
শুভকামনা দাদা।
আগেও জানতাম। তবে ঝালিয়ে নিলাম।
নিতাই বাবু
ঝালাই যাতে বেশি না হয় দিদি! হুঁট করে ফেটে যেতে পারে! নাহয় ফেটে হুঁট শব্দ করবে। ভালো থাকবেন শ্রদ্ধেয় দিদি।
সাবিনা ইয়াসমিন
২৪ সেকেন্ডে ১ পল!
কত শব্দের অর্থ অজানায় ছিলো!!
শব্দ নিয়ে আপনার বিশ্লেষণধর্মী লেখাটা শুধু ভালোই লাগলো না, উপকারেও এলো।
লেখা প্রিয়তে নিলাম দাদা, অভিধান হিসেবে কাজে লাগাবো ☺☺
শুভ কামনা 🌹🌹
নিতাই বাবু
লেখা প্রিয়তে নিয়েছেন শুনে ধন্য হলাম, শ্রদ্ধেয় কবি সাবিনা দিদি।
সঞ্জয় মালাকার
দাদা অসাধারণ লেখা। কিন্তু সময় নিয়ে এভাবে জানা ছিলো না।
আপনার তথ্যবুহুল লেখায় জানা হলো,
পড়ে শিখার শিক্ষা পেলাম,।
আপনার জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা।
নিতাই বাবু
আপনার জন্যও অনেক অনেক শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয় দাদা। মোবাইল সমস্যার কারণে বর্তমানে আপনাদের লেখাগুলো ভীষণ মিস করছি। নিজের লেখায়ও মন্তব্যের উত্তর দিতে দেরি হয়ে যাচ্ছে! কিছু মনে করবেন না। আশা করি ঠিক হয়ে যাবে।
সঞ্জয় মালাকার
সেইম সমস্যা আমার ও দাদা,। তবে সমস্যা নেই, আমরা আমরাই তো।
ভালো থাকবেন সবসময় শুভ কামনা।
কামাল উদ্দিন
আপনাদের মাথায় অনেক জটিল বিষয় থাকে, আমার সাদামাটা মাথায় এতোসব থাকে না, তবে আপনার পোষ্ট পড়ে চমৎকৃত হলেও নিজেকে মুর্খই মনে হচ্ছে। কারণ এসবের কিছুই আমার জানা নাই…….শুভ কামনা সব সময়।
নিতাই বাবু
লেখালেখির পাঠশালায় যখন ভর্তি হয়েছেনই, খুব তাড়াতাড়িই সবকিছু নিজের আয়ত্ত্বে এসে যাবে। শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয় দাদা।
কামাল উদ্দিন
আশা করছি আপনাদের সাথে থাকার ফল কিছুটা হলেও পাবো।
নিতাই বাবু
শুভেচ্ছা সহ শুভকামনা!
ফয়জুল মহী
পরিপক্ব লেখা । বেশ ।
নিতাই বাবু
সুন্দর গঠনমুলক মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ সহ শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয় কবি দাদা।
তৌহিদ
অত্যন্ত তথ্যবহুল এবং চমৎকার এই পোস্টটি প্রিয়তে রাখলাম। এসবের কিছুই জানতামনা দাদা। তবে তথ্যসূত্র লিংকগুলি দিয়ে দিলে আরো যথার্থ হত। পোস্ট থেকে অনেক কিছু শিখলাম।
শুভকামনা রইলো দাদা।
নিতাই বাবু
তথ্য বলতে অনলাইন অভিধান থেকে শব্দের অর্থ সংগ্রহ করা মাত্র। আর যা আছে, তা নিজের মতো করে লেখা।
ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় তৌহিদ দাদা।
তৌহিদ
ভালো লাগলো এমন লেখা দাদা।
রেহানা বীথি
আমরা কতকিছুই জানি না। খুব ভালো পোস্ট দাদা।
নিতাই বাবু
সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি, শ্রদ্ধেয় কবি দিদি। আশা করি ভালো থাকবেন।
জিসান শা ইকরাম
কিছুই জানতামনা এসবের।
ধন্যবাদ আপনাকে দাদা, জানানোর জন্য।
পোস্ট প্রিয়তে নিলাম।
শুভ কামনা।
নিতাই বাবু
শুনে খুবই খুশি হলাম শ্রদ্ধেয় দাদা। শুভকামনা থাকলো। আশা করি ভালো থাকবেন।
দালান জাহান
সমৃদ্ধ মানুষের সমৃদ্ধ লেখা
ইসিয়াক
খুব ভালো পোষ্ট । অনেক কিছু জানলাম ।