আপনি বলেছিলেন- রবীন্দ্রনাথের প্রত্যেকটা লাইন আপনার মনোযোগ দিয়ে পড়া । তাই বারেবার তাঁর কাছে আশ্রয় নিয়েছেন । অনেক বইয়ের নাম তাঁর কবিতা থেকে দিয়েছেন । প্রেম করেছি বেশ করেছি , প্রেম না দিলে থাপ্পড় খাবি টাইপ নামের চেয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন থেকে দেয়া নাম অনেক সাবলীল ওঁ সুন্দর ।
দেশে ফিউশন নাটক হয় , নজরুলের নাটক , রবীন্দ্রনাথের নাটক । রবি বাবুর গল্প থেকে নাটকে প্রায় মেয়ে চরিত্রকে পিঠখোলা ব্লাউজ ব্যবহার করতে দেখে হতাশ হয়ে বলেছিলেন ” রবীন্দ্রনাথ কি মেয়েদের পিঠ দেখতে পছন্দ করতেন ? আমি রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে নাটক বানাইনা কারন আমি জানি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ভুল করা চলেনা ” ।
জীবনানন্দ দাশকে কতো সুন্দর ভাবে আপনি তুলে ধরেছেন । আপনার বইয়ের প্রথমে ওঁ গল্পের কবিতার ব্যবহার ছিল । এসব দেখেই তো আমার মতো কতজন তাদের কাছে আবার আশ্রয় নিল । হয়তো অনেকেই স্বীকার করবেনা । আমি করবো । আরনেস্ট হোমিংওয়ে, জন স্টেইনবেক , রবার্ট ফ্রস্ট , টেনিসন এর লেখা ও যে পড়ার মতো এবং পড়া উচিত আপনার বইয়ের মাধ্যমেই জেনেছি । কি অদ্ভুত ভাবেই না আপনার বইগুলো সাহিত্যর সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতো আমাদের কাছে । হুমায়ুন দিয়ে শুরু তারপর কঠিন সব লেখকদের বই অবলীলায় আমরা পড়ে যাই ।
আপনি অজস্র নাটক বানিয়েছেন । সবাই জানে । আপনার বাকের ভাই , কাদের , হাসান , আনিস, হিমু , মিসির আলী , শুভ্রকে সবাই চিনে । আপনি না থাকার সময়েও বাংলায় জোছনা ছিল , বর্ষা ছিল , তবুও আমরা বলি আপনি জোছনা -বর্ষা আমাদের কাছে প্রিয় করেছেন । এখানেই একজন লেখকের সফলতা ।
বাংলাদেশে অনেক সুশিল লেখক আছে । দেশপ্রেম বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন । তাদের মুখে শুধুই তৎসম শব্দ বের হয় । তাদের কলম থেকে কিন্তু “তুই রাজাকার” বের হয়নি ।
র্যব এর ক্রসফায়ার দেখে আপনি ” হলুদ হিমু কালো র্যব ” লিখে প্রতিবাদ করেছিলেন ।
আপনার লেখার গভীরতা কম , হাল্কা লেখা এসব বলার কারনে একবার আপনি নাকি এক সমালোচক এর কাছে একটা গল্প লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন ।
সমালোচক বা সাহিত্তের সেই কঠিন অধ্যাপক গল্প পড়ে জানান , গল্প ভালো কিন্তু গভীরতা কম । সেই পাণ্ডুলিপি পকেটে ভরতে ভরতে আপনি তখন বলেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর গল্পে যখন গভীরতা কম তখন আমার লেখায় গভীরতা না থাকলে কিছু যায় আসেনা । আনিসুজ্জামান এক লেখায় এই কথা বলেছেন । মানিক বাবুর গল্প উনি হাতে লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন । সেই অধ্যাপক বুঝতে পারেননি ।
আপনি সবসময় বলেছেন ” আমি গল্পে শুধু আমার কিছু চিন্তা ভাবনার কথা বলতে চাই , কিছু দৃষ্টিভঙ্গীর কথা ” আপনি সফল ভাবে বলতে পেরেছেন ।
বাঙ্গালীদের নাড়ি ধরতে পেরেছেন বলেই আপনার প্রস্থান এর পর টানা সপ্তাহ খানেক আপনি মিডিয়াতে প্রথম পাতায় ওঁ প্রথম শিরোনামে ছিলেন । এই দেশে প্রথম পাতা ওঁ প্রথম শিরোনাম বিরোধীদলীয় নেত্রী ওঁ প্রধানমন্ত্রীর জন্য বরাদ্দ থাকে । শহীদ মিনারে আপনাকে ফুল দিতে ছেলে মেয়ের
পাশে কতো বুড়োও গেছে আপনি যদি জানতেন .. এতো বড় কাভারেজ এই দেশে এখনো কেউ পায়নি । একজন লেখকের জন্য এশিয়া মহাদেশে তা প্রথম । এশিয়ার বাইরের কথা জানিনা ।
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলতেন – হুমায়ুনের গল্পগুলো লুঙ্গির মতো , পইড়া আরাম কিন্তু বাইরে যাওয়া যায়না ।সেই তিনি মিডিয়াতে হুমায়ুন মহান , হেমিলনের বাশিওয়ালা , সাহিত্তের ক্ষতি হয়ে গেলোর মতো বাণী দিয়ে দিল । আমাদের মতো হুমায়ুন ভক্তরা আফসোস ফেলতে লাগলাম ।
হুমায়ুন কি ছিল দেশের সাধারন মানুষ দেখিয়ে দিয়েছে । সুশিলদের মত তো আমরা চাইনি । চ্যানেল আই আর প্রথম আলো আপনাকে নিয়ে এখনো ভালোই ব্যবসা চালাচ্ছে । স্যার , আপনি তো তাদের ছিলেন না , আপনি ছিলেন সাধারনের । আমাদের । আপনাকে নিয়ে এই খেলা আমাদের ভাললাগেনা ।
ব্যর্থতা নামক কোন কিছু আপনাকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি । যেখানেই হাত দিয়েছেন আপনি সফল । চল্লিশ বছর আপনি লিখেছেন । অনেকেই এই নিয়ে অনেক কিছু বলছে কিন্তু কেউ বলছেনা আপনি দৈনিক লেখক ছিলেন । প্রতিদিন লিখতেন না হলে প্রায় তিনশ বই লেখা সম্ভব না ।
আপনার ভালো উপন্যাসের সংখ্যা প্রচুর – বলে শেষ করা যাবেনা ।নন্দিত নরকে , শঙ্খনীল কারাগার , অন্যদিন , ১৯৭১ , সৌরভ , নির্বাসন , যদিও সন্ধ্যা ,এই বসন্তে , শ্রাবণ মেঘের দিন , তিথির নীল তোয়ালে , রুপা , বৃষ্টি ও মেঘমালা , চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক , ছায়াবীথি , অনীশ , নিষাদ , ময়ূরাক্ষী , দরজার ওপাশে , অচিনপুর , ফেরা , গৌরিপুর জংশন , দেবী , দেয়াল , মধ্যাহ্ন , বাদশাহ নামদার , আয়নাঘর , আমি এবং আমরা , বৃহন্নলা , কে কথা কয় , কবি , অন্যভুবন , শ্যামল ছায়া , কোথাও কেউ নেই , অয়োময় , তেঁতুল বনে জোছনা , তোমাকে কতো কতো নাম বলব?
আপনার প্রথম পড়া উপন্যাস ” নির্বাসন ” বই পড়ে কষ্ট পেয়েছি অনেক , কিন্তু কাদিনি । এই একটি বই আমার মতো কতো জনকে কাদিয়েছে ।
আনিস আর জরির জন্য কতোরাত ঘুম হয়নি । আনিসের এর সাথে জরি শেষ দেখা করতে এসেছে । আনিসের কপালে চুমু দিয়ে চলে যাবে । কি কষ্ট !!!!!!!!! বারান্দায় আনিস দাড়িয়ে আছে , জরি বউ বেশে চলে যাচ্ছে । কি কষ্ট !!!!!
অন্ধকারের গানের বুলু মনে হয়েছে নিজেকে , এখনো ভাবি আমিই হয়তো সেই বুলু । কবি উপন্যাস পড়ে কবি হতে চেয়েছি ।
( এক ছাত্রীকে পড়াতাম – বলদ মার্কা মগজ ছিল তার । আমার মতো বদরে পছন্দ করে ফেলল , ক্লাস নাইনে পড়া একটা মেয়ে ভুল করতেই পারে ।
ইনিয়ে বিনিয়ে জানাল আমাকে । আমি কখনো তাকে আর পড়াতে যাইনি । মাসের ২৮ দিন পড়িয়ে বেতন না নিয়ে চলে এসেছি । সেকি দুঃসময় আমার ।
মেয়ের সাথে পথে দেখা হল – সে জানতে চাইল আমি কিছু বলছিনা কেন ! আমি তখন বললাম
” শোন নৈশব্দবতী তুমি থাকো সুখে
তুমি থাকো চন্দ্র সাদা দুধের সায়রে ”
এই লাইনদুটো কবি উপন্যাসের জন্য লিখেছিলেন । কীভাবে যেন মগজে গেথে গিয়েছিল । সেই উপন্যাসে কবি’র বন্ধু ছাত্রীর প্রেমে পড়ে বলেছিলেন । আমার আর কবিতা দরকার নেই । আমি জীবন্ত কবিতা পেয়ে গেছি । কি ভয়ঙ্কর লাইন ! )
হিমু পড়ে কে হিমু হতে চায়নি ? আর মিসির আলীর বুদ্ধিতে কেউ কি আছে যে চমকিত হয়নি ? আর নিজেক শুভ্র কল্পনায় ভাবেনি এমন মানুষ খুব কম পাওয়া যাবে ।
জোছনাও জননীর গল্প সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র উপন্যাস যার সমাপ্তি দ্বিপদী হয়েছে । এটি শুধু উপন্যাস ছিল না । ঘরোয়া ভাষায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আমাদের যুদ্ধের , মুক্তি যুদ্ধের বর্ণনা । কেউ পেরেছে এমন ? নকশিকাথার মতো । শীতল পাটির মত । এটা মহাকাব্য । বাংলাদেশের সায়েন্স ফিকশন আপনার হাত ধরেই এসেছে ।
হুমায়ুন আপনি প্রজন্ম তৈরি করেছেন । আপনার ডান হাতে ছিল ছয়টি আঙ্গুল ।একটি কলম । সেই আঙ্গুল দিয়ে সপ্ন নির্মাণ করেছেন । আপনি সফল তা আমরা জানি । এর জন্য মহাকাল , আগামীকালের অপেক্ষা করতে হবেনা । কারন ফেসবুক খুল্লেই প্রতিদিন আমরা আপনার লেখা ছোট ছোট বাণী বা উপলব্ধি গুলো পাই । যদিও আল মাহমুদ বলেছেন ” হুমায়ুন কেমন লেখক ছিলেন আগামী দশ বছর পর দেখা যাবে ” ।
কবি আল মাহমুদের এই কথা অবশ্যই ভুল প্রমানিত হবে ।
” একবার আপনার একটা সাক্ষাৎকারে আপনাকে জিজ্ঞেস করা
হয় আপনি লিখেন কেন ?
আপনার উত্তর – আঙ্গুলের ব্যায়াম হয় বলে লিখি । ”
” কলকাতার সুনীল আমাদের যুদ্ধ , ইতিহাস নিয়ে প্রথম আলো , পূর্ব পশ্চিম লিখেছেন । আপনি কিছু লিখেননি কেন ?
হুমায়ুন – উনি মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি বলে লিখতে পেরেছেন । আমি পেরেছি বলে পারছিনা লিখতে ।
কবে আপনি এরকম লেখা লিখবেন ? বাজারি লেখা ছেড়ে ??
হুমায়ুন – লিখবো । নামও ঠিক করেছি । নামটা একটু বড় ।
কি নাম ?
হুমায়ুন – এই বইয়ে পূর্ব পশ্চিম , উত্তরদক্ষিন সব দিক ধরা হবে । তাই নামটা হবে পূর্ব পশ্চিম , উত্তরদক্ষিন , উর্ধে , পশ্চাতে ।
সাংবাদিক কুপোকাত হাহাহাহ ”
হাসন রাজার ছয়শর উপর গান আছে । আমরা জানি কতগুলো ? ১০ থেকে ১৫টা । তাও জানি আপনার কারনে । গানগুলো আপনি অতীতে খুঁড়ে তুলে এনেছেন । বই পড়ে যে হাসা যায় তা আপনি দেখিয়েছেন । কতো সহজ ছোট ছোট বাক্যে লিখতেন ! আপনি যতো বছর বেঁচে ছিলেন রাজার মতোই ছিলেন । তাই , নিরধিধায় বলতে পারি –
শুভ জন্মদিন
হুমায়ুন আহমেদ
লেখক নামদার ।
জলে কার ছায়া পড়ে
কার ছায়া জলে ?
সেই ছায়া ঘুরে ফিরে
কার কথা বলে ?
কে ছিল সেই শিশু
কি তাহার নাম ?
কেন সে ছায়ারে তাঁর
করিছে প্রনাম ?
আমি একটু অলস , ঠিক সময়ে পোস্ট করতে পারিনা । তাই একটু দেরিতে হলেও . . –
পুনশ্চ – স্যার আমি আনিস হতে চেয়েছি শুধু । যার কোন অন্ধকার থাকবেনা । শুধু শুদ্ধতা ও আলো থাকবে ।
যার শুধু একজন জরী থাকবে ।
১৫টি মন্তব্য
শুন্য শুন্যালয়
এতো আবেগী একটা লেখা …আপনাদের মতো এতো সুন্দর করে কখনো লেখা হবেনা, আমার মতো একজনের শ্রদ্ধা তাই আপনাদের লেখার মাধ্যমেই জানিয়ে দিলাম …অনেক শ্রদ্ধা তোমার জন্য হুমায়ূন আহমেদ …
প্রিন্স মাহমুদ
তুমি কিন্তু বেশ ভালোই লিখো ।
খসড়া
ভাল লাগলো ভালবাসায় ভরা আবেগ তাড়িত যন্ত্রনা মধুর লেখা।
প্রিন্স মাহমুদ
;?
শিশির কনা
অসাধারন লিখেছেন ভাইয়া ।
প্রিন্স মাহমুদ
-:-
মর্তুজা হাসান সৈকত
বর্তমান প্রজন্মের লিখিয়েদের এত অনুপ্রাণিত কে করেছে আর হুমায়ুন স্যারের মত।
প্রিন্স মাহমুদ
আসলেই ।
মা মাটি দেশ
(y) স্যারের তুলনা স্যার নিজেই।সুন্দর হয়েছে।স্যারকে নিয়ে আরো লেখা চাই।
প্রিন্স মাহমুদ
আমার স্টক শেষ । প্রচুর খাটতে হয় । আমি আর পারবোনা । আমি অলস
নীলকন্ঠ জয়
হুমায়ুন স্যার ছিলেন তরুণদের আইডল। তিনি বেঁচে রইবেন তারুণ্যের মাঝেই। খেয়াল করেছেন, এই ১৩ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু নোবেল পেয়েছিলেন।
প্রিন্স মাহমুদ
হাহাহাহাআহাহাহাহ , খেয়াল করেছি ।
আদিব আদ্নান
এখানে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে সেরা লেখাটি পড়ে
আপনাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি ।
প্রিন্স মাহমুদ
ধন্যবাদ নিতে পারবো না । হুমায়ুনকে নিয়ে সেরা লেখাটি কেউ লিখতে পারবে না ।
কারন তিনি নিজেকে কখনো ধরা দেননি ।
জিসান শা ইকরাম
লেখাটা আগেই পড়েছি । মন্তব্য করা হয়নি ।
অসাধারন এক লেখা , হুমায়ুনকে ভালো এবং সুন্দর ভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে ।
মুগ্ধ হয়েছি লেখায় ।