
মেকাপবক্স
সুজানার বাবা আর্মির বড় অফিসার।
সুজানা পাপড়ির সমবয়সী এবং ফুফাত বোন । দুদিন পরেই ঈদ আর ঈদের আগের সময়টুকু সুজানা পাঁপড়ির সাথেই কাটাতে চায়। দুজনে মিলে চলছে সারাদিন হৈহুল্লোর আর অনবদ্য দস্যুতা। সুজানা খুব চঞ্চল মেয়ে আর পাঁপড়ি শান্ত এবং চাপা স্বভাবের। হঠাৎ গ্রামে এসে কি উচ্ছ্বসিত সুজানা কখন কী করছে নিজেই জানে না।
কখনও ছুটছে পাখির বাসায় তো কখনও ছুটছে হাঁসের দলের পিছু পিছু। বাঁধ ভাঙা উল্লাসে দুজনেই অদল বদল করে নিজেদের আয়নায় দেখছে কে কতো সুন্দর ! আবার কখনও কখনও দুজনার জামা কাপড়ও পড়ছে অদল-বদল করে ।
বিকেলে সাজতে গিয়ে সুজনা মেকাপ বক্সটায় হাত দিতেই চেঁচিয়ে উঠেন পাপড়ি । “তোকে না বলেছি ওটা ধরবি না ” ও পাশেই তো আরেকটা রাখা আছে কিন্তু সুজানার এই মেকাপটাই ভাল্লাগছে । লাল সবুজের নজরকারা লাভ লেদারের এতো সুন্দর মেকাপ বক্স এর আগে কোথাও দেখেনি সুজানা । সুতরাং এটা সুজানার চাই।
সুজানা যখন অনেক জোর দিয়ে বলল এটা তো আমি নেব-ই নেব-ই পাপড়ির চোখ তখন বর্ষার জল ভরা নদী। পাপড়ির চোখের জল দেখে সুজানা অবাক ! “একটা মেকাপের জন্য এভাবে কাঁদছিস ,
আচ্ছা যা নেব না ” “এবার তো কান্না বন্ধ কর”। পাঁপড় চোখ মুছতে মুছতে তার ঘরে চলে যায় ।
পাপড়ির কাছে এটাই সোহেলের শেষ স্মৃতি । আজ থেকে পাঁচ বছর আগে সোহেল শহর থেকে এনে দিয়েছিল । তারপর সোহেলের সাথে পাপড়ির আর দেখা নেই। অথচ হৃদয়ের লেনাদেনার কারবার নিয়ে কতোই না ঘুরেছে পাপড়ির পিছু পিছু । কতো দিন রাত হয়ে গেছে কতো রাত হয়ে গেছে দিন। কিন্তু পাপড়ি কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না । কারন পাঁপড়ি রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে । বাড়িতে এসব জানলে ভালো হবে না এটা সে জানে। কিন্তু সোহেলের আবেদন ছিল সমুদ্রের প্রলয়ঙ্কারী ঢেউয়ের মতো যা পাপড়িকে ভাসিয়েছিল তৃণের মতো ।
একদিন শীতের রাতে সোহেল বিষ কিনে সারারাত বসেছিল বাড়ির সামনে , শর্ত একটাই যদি পাপড়ি না আসে তবে সে আত্মহত্যা করবেন। পাপড়ি সেদিন নিজের সাথে অনেক অঙ্ক করে শেষ পর্যন্ত হিসেব মিলিয়ে ছিল সোহেলের সাথে। মন ভোলানো হাজার কথার জলে শিশির হয়ে ঝরেছিল দুজনে দুজনের মাঝে।
অনেক বছর কেটে গেল অপেক্ষায় অপেক্ষায় কিন্তু সোহেল কোথায় কেউ কি জানে তার খবর । পাপড়ি কাঁদে নিভৃতে ঘরের কোণে। তার এই মন পোড়ার গন্ধ কেউ পায় না । স্মৃতির আনন্দপাঠে নিঃশ্বাসেরা খেলা করে , জীবনে চলার পথে তৈরি করে বড় বড় অন্ধকার গর্ত।
পাপড়ি নিস্পলক তাকিয়ে থাকে জড় মেকাপ বক্সটার দিকে। যেভাবে তাকিয়ে থাকে প্রেমিক বহু প্রতিক্ষিত পাওয়ার কিছুতে। ফোঁটা ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে । ভিজে ভিজে গাঢ় হয় বেদনার রঙ ।
কিন্তু রঙ বদলে যায় প্রতিদিনের অপেক্ষা আর বাস্তবতায়। এই সব ভাবতে ভাবতে পাপড়ির অজগর রাত লেজ নেড়ে ছুঁয়ে যায় সকালের সূর্য । ফোলা ফোলা চোখের উপরে তখন স্পষ্ট হয়ে উঠে বড়ই পাতার ছাপ ।
এদিকে সুজানারও বিয়ে ঠিক হয়েছে । ঈদের পাঁচ দিন পরেই সুজানার বিয়ে। ছেলে আর্মির ক্যাপ্টেন । রোদে শুকাতে দেওয়া সুতি কাপড়ের মতো ফিনফিন হাওয়ায় উড়ছে সুজানার মন । কিন্তু কিছুই কিছু আর ভালো লাগে না পাপড়ির। জীবনের সব সঞ্চয় নিয়ে সমুদ্রে গেল যে নাবিক , এটাই কি তার শেষ জাহাজ ছিল ? আর আমি কি মাঝ ধরিয়ায় ভাসতে ভাসতে ডুবে যাব পরিত্যক্ত ডিঙির মতো !
আগামিকাল সুজানার বিয়ে। বেস্ট বান্ধবী হিসেবে পাপড়িকে যেতেই হবে একদিন আগে । পাপড়ি আগের দিন সন্ধ্যায় চলে গেল সুজানাদের বাড়িতে। রাতভর গান বাজলো ঝিলিক বাতিতে সাজানো হয়েছে বাড়ি পুকুর ঘাট গাছ গাছের সবুজ পাতা। গাছের পাতার ঝিকমিক সবুজ আলো যেন অনাহুত বৃক্ষের মিটমিট নিঃশ্বাস। গল্প আড্ডাবাজিতে কখন যে রাত শেষ হয়ে গেল কেউ জানে না । সুজানা ও পাপড়ি দুজনেই ঘুমিয়ে আছে প্রেমিক প্রেমিকার মতো আলিঙ্গন করে।
ভোরের সূর্যের সাথে নড়ে উঠলো পাপড়ির ফুফুর মেশিন মুখ । টইটই করে ভেঙে দিল ঘুম ।” উঠ উঠ একটু পরেই ছেলে আসবে এখন আর ঘুমানো যাবে না” এইসব । ঘুম থেকে উঠে পাপড়ি সোজা চলে গেল পুকুর ঘাটে । দুহাত বাড়িয়ে জল ধরতে যেতেই জলে ভেসে উঠলো নিজের মুখটা । সে যেন রঙ্গ করে বলছে কী,রে পাপড়ি তোর বিয়ে কবে হবে !
সকাল দশটায় বরযাত্রীদের গাড়ি আসা শুরু হলো। চলছে কণে সাজানোর কাজ । ইতিমধ্যে অনেকেই বর দেখে এসেছেন । দেখতে নাকি নায়কের মতোই সুন্দর । সুজানা তো আগেই দেখেছেন তাই বেস্ট ফ্রেন্ড পাপড়িকে বলল ” পাপড়ি যা দেখে আয় না তুই “। পাপড়ি বললো “তোর জামাইকে তো আমার দেখতেই হবে , এটা তুই বললেও দেখব না বললেও দেখব”।
কিন্তু কে জানে কার কপালে কি আছে ! ভাগ্যের কোন পরিহাস অপেক্ষা করছে কার জন্য । তাই হলো পাপড়ির সাথে । মেঘ ছাড়া বৃষ্টি ছাড়া বজ্র ঝরে পড়ল পাপড়ির মাথায়। পাপড়ি ভুলেও এমনটা আশা করিনি। কিন্তু কেন এমন হলো সবই যে নিয়তির খেলা। বর দেখে এসেই জ্ঞান হারালেন পাপড়ি। সবাই মাথায় পানি ঢালল সুজানার বাবা ডাক্তারও নিয়ে আসল কিন্তু না পাপড়ির তো তেমন কিছু হয় নি । যা হয়েছে তার ঔষধ কী কেউ দিতে পারেন ? আর যিনি দিতে পারেন তিনিই তো তার হৃদয়কে করেছেন রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত ।
ঝড়ে পড়া জাহাজের ক্যাপ্টেনের মথো নিজেকে সামলে নেন পাপড়ি। ধৈর্য ধরতে বলেন নিজের মনকে। যতনে রাখা মেকাপবক্সটা একটা রেপিং পেপারে মুড়িয়ে উপহার দেন সুজানাকে । সুজানা বলেন আমি জানি তুই মেকাপবক্সটাই দিয়েছিস তাই না ? পাপড়ি মাথা নেড়ে হা বলেন কারন পাপড়ির গলা শুকিয়ে গেছে শরীর কাঁপছে। জীবনের বহু প্রতিক্ষিত মানুষটিই যে আজ অচেনা তখন এই মেকাপবক্সটি রেখে আর কি হবে !
বিয়ের কাজ ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে। অপরাধী দুটো লাল চোখ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সুজানার বর একবার তাকাচ্ছেন সুজানার দিকে আরেকবার পাপড়ির দিকে। কিন্তু পাপড়ি তাকিয়ে আছেন আকাশের উপরে।
পৃথিবীযে কত নিষ্ঠুর হাতে হাতে প্রমাণ পেলেন পাপড়ি। এটাও জানলেনযে , পাপড়ির বাবাই সোহেলকে চাকরি দিয়েছিল। আর সোহেল এখন এতো বড় হয়েছেযে , তাকে আর দেখা যায় না । দেখা যায় যেটুকু সেটুকু হলো যান্ত্রিক মুখ। সোহেল যখন একটিবার তার কথা শোনার জন্য পাপড়িকে মিনতি করছেন
পাপড়ি তখন ভিড় ভিড় করে বলছেন ,
অনেক বড় হয়ে গেছিস
এতোটাই বড় যে
যতটা বড় নয় অন্তহীন আকাশ
তাই তোকে আর দেখা হয় না ।
ভালোথাকিস জোছনায় থাকিস
আদরে থাকিস আহ্লাদে থাকিস
যদি কখনও দেখিস
তোর পদতলে পিষ্ট হয়ে মরেছে
কোন কাঞ্চন কুমারীর হৃদয়ের ঘাস
কাঁদিস না তারে বুকে বাঁধিস না ।
ভালোবাসা হায়রে ভালোবাসা
এতোটাই বড় হয়েছিস যে
তোকে আর ধরা যায় না ছোঁয়া যায় না।
দালান জাহান
12/6/19
সখিপুর।
১১টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
খুব আবেগময় গল্প,
এক জনের ভালোবাসার জন, সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর কাছে চলে গেলে কষ্টের পাহাড় বুকে চেপে বসবেই।
পাপড়ি আর সোহেলের বিচ্ছেদটা হল কেন?
গল্প খুব আকর্ষনীয় ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন আপনি।
শুভ কামনা।
দালান জাহান
অনুপ্রাণিত করার জন্য কৃতজ্ঞতা ভাই। আমি আসলে গল্পকার নই। আপনাদের উৎসাহে লিখছি।
শাহরিন
করুণ পরিনতি কিন্তু ভালো লেগেছে পড়ে।
দালান জাহান
ধন্যবাদ অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি
সঞ্জয় মালাকার
করুন নিয়তি পড়ে ভালোই লাগলো
শুভ কামনা।
দালান জাহান
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ভাই
রেহানা বীথি
ভালো লাগলো
দালান জাহান
ধন্যবাদ
আরজু মুক্তা
বিচ্ছেদের অনল।।
মনির হোসেন মমি
চমৎকার একটি গল্প পড়লাম।লিখতে থাকুন।
সাবিনা ইয়াসমিন
ভালোবাসা এক সময় অনেক বড় হয়ে যায়, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। একরাশ হাহাকারে ভরা মনে না থাকে ভালোবাসা, না থাকে প্রত্যাশা। আবেগময় লেখা। মন খারাপের ব্যপারটা সংক্রামক, ছড়িয়ে যায়।
অন্যদের লেখাগুলো পড়ুন দালান। আপনার লেখা পড়ে যারা কমেন্ট দেন, তারাও সোনেলার লেখক। তারা যদি লেখক হয়েও আপনার লেখায় পাঠক হয়ে মন্তব্য দিতে পারেন, তাহলে আপনি কেন পারবেন না অন্যদের লেখায় মন্তব্য দিয়ে তাদের উৎসাহ বাড়িয়ে দিতে?
ভালো থাকবেন। শুভ কামনা 🌹🌹