নতুন স্কুলে ভর্তি হবার পর নতুন জুতো, মুজো, ব্যাগ আরও নানা জিনিস কিনে আনা হলো। এসব দেখে মীরার আনন্দ আর ধরে না। কিভাবে জুতোর ফিতে বাঁধতে হবে, কিভাবে ব্যাগের ফিতে আটকাতে হবে, সব একে একে শিখিয়ে দিলেন বড় ভাই বোনেরা। শুরু হলো মীরার নতুন জীবন। কিন্তু তা বেশিদিন চললো না। একদিন হঠাৎ মেয়েটি চিৎকার করে বলতে লাগলো “আমার শীত লাগছে। কম্বল দাও।” গরমের দিন ভীষণ শীত লাগছে দেখে সবাই অবাক হলো। নিজের বাসার কাঁথা কম্বল দেয়ার পর পাশের বাসা থেকেও এনে দিলো। তাও শীত মানছে না। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে গেলো। পুরো শরীর নীলচে হতে লাগলো। খালি পায়ে ফুপা ফুপু তাকে কোলে নিয়ে দৌড়ালো ডাক্তার খানায়। ভর্তি হলো সি এম এইচে। পরীক্ষা করে জানা গেলো ম্যালেরিয়া হয়েছে। এখানে প্রায় ১ মাস ভর্তি থাকার পর যেদিন বাসায় ফিরলো সেদিনই জানতে পারলো পরেরদিন তার স্কুলে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা! সবাই বললো,
“থাক, এই পরীক্ষা দিতে হবে না। তুমি আজই হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছো। বিশ্রাম নাও। কিছুই পড়া হয়নি। তুমি পারবে না।”
মীরা জেদ করে বললো,
“আমি পারব। আমাকে পড়াও।”
ভীষণ পড়া পাগল এই মেয়ের জেদের কাছে হার মানলো তার বড় বোনরা। তাকে একরাত পড়ালো। কিভাবে যে সিলেবাস শেষ করে দিলো তাঁরা, তা মীরা টেরই পেল না।রাত দশটা পর্যন্ত পড়ে মীরা ঘুমোতে গেলো। তখন বড় ফুপু বললেন,
“তুমি যদি গনিতে ২৫ এ ২৫ পাও, তোমাকে একটা চকবার দিব।”
মীরার খুশি দেখে কে? সে খুশিমনে ঘুমোতে গেলো এবং পরদিন পরীক্ষা দিয়ে এলো।এভাবে পরীক্ষার আগের রাতে পুরো সিলেবাস শেষ করে কোনমতে ১ম সাময়িক পরীক্ষা শেষ করলো মীরা। ছবি আঁকার হাত তত দ্রুত পাকানো সম্ভব নয় বলে চুড়ি দিয়ে আপেল বানিয়ে আঁকতে শেখালো বড় দুই বোন।কিভাবে রং করতে হবে তাও শেখালো। তাদের চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিলো না। পরীক্ষা শেষে ফলাফল পাবার পর দেখলো গনিত সহ বাকি সবগুলোতেই ২৫ করে পেয়েছে শুধু ছবি আঁকায় ২/৩ নম্বর কম৷ ফলে ২য় স্থান অধিকার করলো মীরা। সবার খুশি সাথে বড় ফুপুর উপহার-চকবার! এই মেয়েটি হয়ে উঠেছিল ফুপুর বাসার হাসি আনন্দের উৎস।
কিছুদিন পর আবার ভীষণভাবে অসুস্থ হলো মীরা। আবার হাসপাতালে ভর্তি। সেখান থেকে ফিরে ২য় সাময়িক পরীক্ষা দিলো। পড়ার জন্য সময় পেয়েছিলো ৭ দিন। ২য় স্থান নিয়েই সে এগিয়ে রইলো বরাবর। কিন্তু স্কুলে কোন সাথী তৈরি হলো না। কারণ সে তো ক্লাসই করতে পারতো না। বেশিরভাগ সময় সামরিক হাসপাতালেই কাটাতে হতো। নীচতলার পিংকি আর পাশের বাসার কানন ছিলো তার খেলার সাথী। হেসেখেলে কাটছিলো দিনগুলি। এরই মাঝে বাবা বিদেশ থেকে চিঠি লিখতেন। কিভাবে চিঠির উত্তর লিখতে হয় তা শিখিয়ে দেন বড় বোনেরা। চিঠিতে বাবাকে জানায় :
“বাবা আমি ক্লাসে ২য় হয়েছি।”
বাবা আনন্দ পান। কখনো চিঠির মাঝে আম, কলা, জাতীয় পতাকা এঁকে পাঠায়। কি কি আঁকা শিখলো তা বাবাকে জানায়। কিছুতেই যেন উৎসাহের কোন কমতি নেই। ততদিনে তার ঘরে এসেছে ছোট্ট মিষ্টি একটা বোন। বোনটা আবার মীরার কোলে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। বোনকে নিয়ে আদর করে, ছবি এঁকে, খেলাধূলা করে কেটে গেলো একটি বছর। এ সময়টাতে যতটা না শাসন পেয়েছে, তারচেয়ে বেশি পেয়েছে স্নেহ। একটা ছোট বাচ্চা নিজের অজান্তেই জড়িয়ে গেলো এই পরিবারটির ভালোবাসার চাদরে। একবারের জন্যও তার মনে হলো না, এটি তার নিজের বাসা নয়, একদিন বাবা ফিরে এলে এ বাসা ছেড়ে তাদের চলে যেতে হবে।
২৬টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ওয়াও। দারুন হয়েছে। একটি ছোট্ট বাচ্চার জেদের কাছে সবাই হার মানলো। ভালো রেজাল্ট করলো। ছোটরা তো নিজের পর বলে কিছু বুঝে না তাই যেখানেই থাকে সেখানেই আপন করে নেয়। ভালো থাকুন সবসময়
নীরা সাদীয়া
ছোটরা এমনি হয়। একটা ছোট বাচ্চার মায়ায় সবাই জড়িয়ে যায়। পাঠ করে ভালো লেগেছে জেনে আমি আনন্দিত। শুভকামনা রইল একরাশ।
এস.জেড বাবু
এ সময়টাতে যতটা না শাসন পেয়েছে, তারচেয়ে বেশি পেয়েছে স্নেহ।
এটাইতো প্রাপ্তি হওয়া উচিত প্রতিটি শিশুর।
চমৎকার অনুভুতি নিয়ে লিখা
ভালো লেগেছে
নীরা সাদীয়া
সত্যি, ছোট শিশুকে শাসন করলে যতটা কাজ হয়, তারচেয়ে স্নেহ দিলে আরও বেশি কাজ হয়। আমরা তা না করে বাচ্চাদেরকে করি শাসন।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। শুভ কামনা রইলো।
বন্যা লিপি
একটা সময় আসে, যখন আমরা আমাদের শৈশব ভীষণ ভাবে স্মৃতীরোমন্থন করি একা একা। মনে হয় যদি আবার ফিরে পাওয়া যেত তবে বারে বারে ফিরে যাই পুরোনো দিনের চৌকাঠে। ভাষা শব্দের গাঁথুনীতে আশ্রয় নেয়া সেই সব দিনরাত্রির স্মৃতি মনে করা। দারুন লিখেছেন। চলুক মীরার কথা-
শুভ কামনা।
নীরা সাদীয়া
মীরার ছেলেবেলার এই গল্পের প্রতিটি পর্বে আপনাদের এমন প্রেরণাদায়ক মন্তব্য ও সাড়া পাব এই প্রত্যাশা করছি।
শুভ কামনা জানবেন।
দালান জাহান
গল্পের ম্যাসেজটা ভালো লেগেছে
নীরা সাদীয়া
অনেক ধন্যবাদ প্রতিবেশি।
অনেক শুভকামনা রইল।
প্রদীপ চক্রবর্তী
দারুণ লেখনী, দিদি।
ভালো লাগলো।
নীরা সাদীয়া
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ফয়জুল মহী
চমৎকার ভাবনার প্রকাশ। ভালো লাগলো।
নীরা সাদীয়া
অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
বেশ চমৎকার লেখা। ভালোই লেগেছে । ধন্যবাদ।
নীরা সাদীয়া
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করছি পরের পর্বগুলোতে পাশেই পাব।
মোহাম্মদ দিদার
নিশ্চিত গভীর জীবন বোধের বহিঃপ্রকা। আহা ছেলেবেলা! যদি ফিরে পেতাম!
নীরা সাদীয়া
ছোটবেলাটা এমনি হয়। তখনই আভাস পাওয়া যায় কী ঘটতে চলেছে!
শুভ কামনা রইলো।
আরজু মুক্তা
ছোটদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
ওরা অনেক বোঝে
নীরা সাদীয়া
অনেক ধন্যবাদ। আশা করছি পরের পর্বগুলোতেও পাশে পাবো।
তৌহিদ
শিশুদের মায়াবী মুখের কাছে আমাদের হার মানতেই হয়। চলুক গল্প।
ভালো থাকুন আপু।
নীরা সাদীয়া
গল্পের পরের পর্বগুলোতেও সাথে পাবো এই প্রত্যাশা।
অনেক শুভ কামনা রইলো।
সুপায়ন বড়ুয়া
শিশুদের আবদার মেঠাতেই আনন্দ। হারতে পারলেই খুশী।
ভাল লাগলো। শুভ কামনা আপু।
নীরা সাদীয়া
সবাই তো শিশুর মন বোঝে না। অনেকেই ভাবে শিশুর আবার মন কিসের?
পাশেই থাকুন, সুস্থ থাকুন।শুভ কামনা।
জিসান শা ইকরাম
শাসন নয়, শিশুর প্রয়োজন শ্নেহ।
আমরা অনেকেই এটি বুঝতে চাই না।
ভালো লেগেছে খুব।
শুভ কামনা।
নীরা সাদীয়া
ঠিক এটাই আমি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
হালিম নজরুল
শিশুর মনোজগতের প্রসার ঘটানো ও উন্নয়নের পাশাপাশি মানসিক বিকাশে সহযোগিতা জরুরি। সুন্দর লিখেছেন।
নীরা সাদীয়া
ঠিক বলেছেন।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।