আজ ২৬ শে ফাল্গুন ১৪২৭ বঙ্গাব্দ বৃহস্পতিবার মহা শিব চতুর্দশীতিথি।
আজকের মহাপূণ্য তিথিতে দেবাদিদেব ভগবান শিবের প্রলয় মহাশিবরাত্রির ব্রত ও তিনির চার প্রহরের পূজা অনুষ্ঠিত হবে।
আমাদের সনাতন হিন্দু ধর্ম শাস্ত্র গ্রন্থ গুলির মধ্যে পুরাণ শাস্ত্র গ্রন্থের অন্তর্গত অন্যতম পুরাণ ধর্ম গ্রন্থ শ্রী শ্রী শিব পুরাণের মধ্যে “শিব” শব্দের প্রকৃত অর্থের ব্যাখ্যা নিন্ম লিখিত ভাবে বর্ণিত হয়েছে–
শ + ই + ব – এই তিনিটি বর্ণের সমন্বয়ে “শিব” শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। তন্মধ্যে ‘শ’ -কার শব্দের অর্থ হলো নিত্য সুখ ও আনন্দ, ‘ই’ -কার শব্দের অর্থ হলো পুরুষ এবং ‘ব’ -কার শব্দের অর্থ হলো অমৃতশক্তি। অতএব শিব শব্দের প্রকৃত অর্থ হলো– যে মহাযোগী পুরুষ তাঁর ভক্তগণকে নিত্য সুখ ও আনন্দ প্রদান করতে পারেন এবং যিনির মধ্যে তাঁর ভক্তগণকে সবসময় অমৃত শক্তি প্রদান করার মতো সক্ষমতা সম্পূর্নরূপে বিদ্যমান রয়েছে তিনিই হলেন মহযোগী দেবাদিদেব ভগবান শিব।
সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্ শ্রীগুরু কৃপাহি কেবলম্।
এই শিবচতুর্দ্দশী তিথির মহাশিবরাত্রি আসলে কি মহত্তপূর্ন এবং কেনই বা আমরা তা পালন করি!
এই মহাশিবরাত্রি সমন্ধে আমাদের সনাতন হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রে আসলে কি বলা হয়েছে– আমাদের সনাতন হিন্দু ধর্মের পুরাণ শাস্ত্র গ্রন্থ গুলির মধ্যে নানান ভাবে এই মহাশিবরাত্রি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
কোথাও লেখা আছে মূখ্যচান্দ্র মাঘ গৌণ ফাল্গুন কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দ্দশীতিথির এই মহাশিবরাত্রিতে দেবাদিদেব ভগবান শিব কেন গরল ( বিষ ) পান করে নীলকন্ঠরূপ ধারন করে ছিলেন তাই সেই কাহিনীটিতে বলা হয়েছে যে, দেবতা ও অসুরগণের দ্বারা অমৃত লাভের উদ্দেশ্যে সমুদ্র মন্থনের সময়ে (খীরোদ সাগর ) যে গরল ( বিষ ) উত্থিত হয়েছিল। সেই গরলের বিষক্রিয়ার ভয়ানক মৃত্যুর কবল থেকে সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মানবকুলকে প্রাণে বাঁচানোর জন্য। দেবাদিদেব ভগবান শিব নিজে সে গরল ( বিষ ) পান করে ছিলেন। উত্থিত হওয়া সকল গরল ( বিষ ) তিনি নিজে পান করার ফলে তিনি নিজে নীলকন্ঠ রূপ ধারন করে ছিলেন। প্রকাশ থাকে যে, যে দিবসের রাত্রিতে দেবাদিদেব ভগবান শিব দেবতা ও অসুরগণের অমৃত লাভ উদ্দেশ্যে অমৃত মন্থন করার সময়ে, খীরোদ সাগর থেকে উত্থিত সমস্ত গরল ( বিষ ) তিনি নিজে পান করে, সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মানব জাতিকে প্রাণে বাঁচিয়ে ছিলেন। সেই শুভ তিথির মহান রাত্রিটির নামই হলো ‘মহাশিবরাত্রি’।
আবার অনেক পুরাণ শাস্ত্র গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে মুখ্যচান্দ্র মাঘ গৌণ ফাল্গুন কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দ্দশীতিথির এই শুভ রাত্রিতে দেবাদিদেব ভগবান শিবের সাথে জগজ্জননী প্রজাপতি দক্ষরাজ কুমারী সতী দেবীর শুভ বিবাহ কর্ম সম্পন্ন হয়ে ছিল। অতপ কারণে দেবাদিদেব ভগবান শিব ও প্রজাপতি দক্ষরাজ কন্যা সতীর দেবীর শুভ বিাহকে চিরস্মরণীয় করে রাখার নিমিত্তে মহাশিব চতুর্দ্দশী তিথির এই ব্রতোপবাস পালন করা হয়ে থাকে।
আবার প্রজাপতি দক্ষরাজ কুমারী সতী দেবীকে অনেকে কিন্তু ভগবতী পার্বতী দেবীর সাথেও সমীকরন করেছেন। আবার অনেকের ধারনা শিবচতুর্দ্দশী তিথির এই রাত্রিতে স্বয়ং দেবাদিদেব ভগবান শিবশম্ভু নিজেই তাঁর সকল মন্দির পরিদর্শন করতে স্বন্গধাম থেকে মর্তধামে নেমে আসেন। তখন তিনি তাঁর মন্দিরে আগত সকল ভক্ত বৃন্দকে কৃপাশীর্বাদ প্রদান করেন।
মহাশিবচতুর্দ্দশী তিথির এই মহাপূণ্য জনক রাত্রিতে সকল শৈব ভক্তগণ বিনিদ্র রজনী যাপন করে থাকেন।
তবে আসলে প্রকৃত ব্যাপারটা যাই হোক না কেন কেবল মাত্র শৈব সম্প্রদায়ই নয়, মহাশিবচতুর্দ্দশী তিথির এই মহাপূণ্যময় রাত্রির ব্রতোপবাস কিন্তু সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী সকল নর – নারীগণের জন্য একটি মহাপবিত্র ধর্মানুষ্ঠান। এই মহাপবিত্র রাতে আমরা সকল হিন্দু ধর্মাবলম্বী নরনারীগণ গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তির সমন্বয়ে একান্ত নিষ্ঠার সাথে আমাদের পরম ঈশ্বর দেবাদিদেব ভগবান শিবকে মনে প্রাণে গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তির সমন্বয়ে স্মরণ করি। আসলে হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রানুযায়ী দেবাদিদেব ভগবান শিব হলেন এই নিখীল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, স্হিতি ও লয় এর একমাত্র অধিশ্বর অর্থাৎ কারণের কারণ। সনাতন হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রানুযায়ী তিনি হলেন দেবের দেব মহাদেব তাই তিনি দেবাদিদেব। আবার মহাকালও কিন্তু তিনিই অপরদিকে মহামৃত্যুঞ্জয়ও তিনিই আবার আশুতোষও তিনিই। যেহেতু দেবাদিদেব ভগবান শিব অনাদির আদি এবং তিনিই আবার অনন্ত। তাই এই জাগতিক মহাবিশ্বে দেবাদিদেব ভগবান শিবের থেকে অধিক পরাক্রমশালী দেবতা আর কেহ এই ত্রিভূবনে নেই।
তা ছাড়া দেবাদিদেব ভগবান শিবের থেকে বড় যোদ্ধাও কিন্তু ত্রিভূবনে আর কেহ নেই। তাই বলে দেবাদিদেব ভগবান শিব এত বড় শক্তির অধিশ্বর হলেও তিনির পূজাতে কিন্তু তেমন কোন আরম্বরতার প্রয়োজন হয় না। ভক্তের কাছ থেকে একটু খানি গঙ্গাজল আর একটি বিল্বপত্র পেলেই তিনি তুষ্ট হয়ে থাকেন সবসময়। অাবার দেবাদিদেব ভগবান শিব একদিকে যেমন শান্ত। আবার অপরদিকে তিনি রেগে গেলে কিন্তু তাঁর ক্রোধানলে পড়ে সমগ্র সৃষ্টি হয় অশান্ত অর্থাৎ বিনাশ।
তখন তিনির মহাপ্রলয়ের তাণ্ডব নৃত্যের ফলে আমাদের এই জাগতিক মহাবিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড এক মহাশ্মশানরূপ বদ্ধ ভূমিতে পরিনত হয়। তিনির শিঙ্গা ও ঝাজর বাদনের শূর শুনতে পেয়ে দৃক হস্তিগণ পর্যন্ত প্রাণ বাঁচানোর নিমিত্তে দিক বেদিক ছুটাছটি করতে থাকে।
জনশ্রুতি রয়েছে যে প্রতি ৭২ ( বাহাত্তর ) বৎসর অন্তর একবার মহিমান্নিত একটি মহাপূণ্য তিথি আসে। সেই মহাপূণ্য তিথিতে কৈলাশ পর্বতের উপর থেকে তিনটি সমান্তরাল রেখা সরাসরি জাগতিক বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ভূভাগের দিকে চলে আসে। আসলে ওই তিনটি সমন্তরাল রেখাই কিন্তু দেবাদিদেব ভগবান শিবের কপালে থাকা সেই তিনটি রেখা। যেই শুভ সময়ে ঐ তিনিটি রেখা ধরাধামে নেমে আসে ঠিক সেই সময়ে দেবাদিদেব ভগবান শিব প্রকট হয়ে নিজে শিবগিরি পর্বতে প্রবেশ করেন। এই শিবগিরি পর্বতে ইচ্ছা করলেই যে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। কারণ এই শিবগিরি পর্বতে প্রবেশ করতে অনেক বড় বড় তান্ত্রিক সাধক মহাপুরুষ ও আঘোরীদেরও পা কেঁপে ওঠে। তবে কেবল মাত্র দেবাদিদেব ভগবান শিবের প্রতি তাঁর ভক্তগণের প্রবল নিষ্ঠা ও অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ভক্তি থাকলেই কেবল তাদের পক্ষে এই শিবগিরি পর্বতে খুব সহজে প্রবেশ করা সম্ভব।
তা না হলে শিবগিরি পর্বতে প্রবেশ করা তো দূরের কথা সেই পর্বতের দর্শন দূর থেকেও পাওয়া সম্পূর্ন অসম্ভব। তার একমাত্র বিশেষ কারণ হলো এই পর্বতটি সকল পাপীদের জন্য সবসময় অদৃশ্য থাকে। প্রকৃত শৈব ভক্ত হতে না পারলে শিবগিরি পর্বতের দর্শন কখনো পাওয়া যায় না। তবে পাঠক বন্ধুগণ একটি কথা কিন্তু আপনারা সবসময় মনে রাখবেন। সে কথাটি হলো জাগতিক চোখ দিয়ে কখনো শিবগিরি পর্বতের দর্শন পাওয়া সম্ভব নয়। তবে কিন্তু প্রকৃত শৈব ভক্ত হতে পারলে, দেবাদিদেব ভগবান শিবের কৃপাশীর্বাদে তখন কেবল মাত্র মনের চোখ দিয়ে ,এই শিবগিরি পর্বতকে যেমন দেখতে পাওয়া যাবে। তেমনি আবার উপলব্ধিও করা যাবে খুব সহজে। প্রকৃত শৈব ভক্ত হতে না পারলে কখনো কারো পক্ষে শিবগিরি পর্বত দেখা বা উপলব্ধি করা কোনটিই সম্ভব নয়।
বিশেষ জ্ঞ্যাতব্য যে শিবচতুর্দ্দশী তিথি আজ বিকাল ৩/১২/৪৯ মিনিটে আরম্ভ হবে এবং আগামী কাল ২৭শে ফাল্গুন ১৪২৭ বঙ্গাব্দ শুক্রবার বিকাল ৩/১১/৫৬ মিনিটে ছেড়ে যাবে।
মহাশিবরাত্রির ব্রত ও চারপ্রহরের পূজা আজ রাতে অনুষ্ঠিত হবে। উপবাস করতে হবে আগামী কাল শুক্রবার চতুর্দ্দশীতিথি থাকা পর্যন্ত। যারা দেবাদিদেব ভগবান শিবের মাথায় জল ঢালার মনোবাসনা পোষন করেছেন। তাঁহারা আগামীকাল শুক্রবার তা করতে পারবেন।
আর যারা মহাশিবরাত্রিতে দেবাদিদেব ভগবান শিবের চার প্রহরের পূজা করার ইচ্ছা পোষন করেছেন। তাঁহারা মহাশিবচতুর্দ্দশী তিথির আজ রাতেই দেবাদিদেব ভগবান শিবের পূজা সমাপন করবেন।
.
সকলকে মহা শিবরাত্রির শুভেচ্ছা ।
শিবরাত্রিতে উপবাসই প্রধান কার্য, একমাত্র উপবাসেই শিব অধিক সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন । প্রায় চল্লিশ ঘণ্টা এক নাগাড়ে নির্জলা উপবাস ।
রাত্রিতে চার প্রহরে চারবার পূজা এবং চার প্রহরে “ওঁ পশুপতয়ে নমঃ” বলে জলদ্বারা স্নান করাতে হয় । জলদ্বারা স্নান করানোর পর বিশেষ দ্রব্যে বিশেষ মন্ত্রে স্নান করাতে হয়।
প্রথম প্রহরে – ওঁ হৌং ঈশানায় নমঃ, এই মন্ত্রে দুগ্ধদ্বারা স্নান করাতে হয় ।
দ্বিতীয় প্রহরে – ওঁ হৌং অঘোরায় নমঃ, এই মন্ত্রে দধিদ্বারা স্নান করাতে হয় ।
তৃতীয় প্রহরে – ওঁ হৌং বামদেবায় নমঃ, এই মন্ত্রে ঘৃত দ্বারা স্নান করাতে হয় ।
চতুর্থ প্রহরে – ওঁ হৌং সদ্যোজাতায় নমঃ, এই মন্ত্রে মধু দ্বারা স্নান করাতে হয় ।
ভগবান শিব সকলের মঙ্গল করুন ।
.
তথ্যঃ আংশিক সংরক্ষিত ও সংশোধিত।
ছবিঃ সংগৃহীত।
৫টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
প্রথম দিকের বর্ণনাটুকু জানা ছিল, বিষ ধারণ করে নীলকণ্ঠ হয়েছেন।
বিস্তারিত জানতে পারি আপনার লেখা থেকেই, এমন করে।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা । খুব সুন্দর করে বিশদভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য। ওঁ নমঃ শিবায়। হর হর মহাদেব। দেবাদিদেব সবার মঙ্গল করুন।
রোকসানা খন্দকার রুকু
অল্প- স্বল্প জানা ছিল! বিস্তারিত জানা হল তবে একটু কঠিন লাগলো। আমার হিন্দু বন্ধুদের দেখতাম পুজো করত।
শুভ কামনা দাদা।
আরজু মুক্তা
অনেক তথ্য জানলাম আপনার লেখায়।
শুভ কামনা
সৌরভ হালদার
ধন্যবাদ দাদা