COVID-19 মহামারীর বৈশিষ্ট্যগুলির পূর্বাভাস দিয়ে ২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ইংরেজি সিনেমা ‘কন্টাজিওন’ এমন একটি সিনেমা যা করোনার সংক্রমণের বাস্তব পটভূমি নিয়ে নির্মিত হয়েছিলো বলে মনে করা হচ্ছে। সিনেমাটি যখন মুক্তি পেয়েছিলো তখন আদৌ কি কেউ ভাবতে পেরেছিলো ২০২০ সালে এসে সিনেমাটির পেক্ষাপট বর্তমানের সাথে মিলে যাবে? মনে হয়না, কারন তাহলে পৃথিবীর মানুষ আরো সচেতন হতো মনে হয়।

সিনেমাটি দেখার প্রারম্ভেই মানুষের একটি শান্ত কাশির শব্দ শোনা যায় যা কখনই সেসময় অশুভ হিসাবে গণ্য করা হয়না। যেমনটি ২০১১ সালের চলচ্চিত্র “কন্টাজিওন” এর প্রথম কয়েক মুহুর্তের অনুভূতিতে প্রকাশ পায়। সিনেমার উদ্বোধনী শটটি মোটেই শট নয়। এটি একটি কালো পর্দা। অডিওতে, আপনি কাশি শুনেছেন। তারপরে আরেকজন এবং অন্যজন। অথচ ২০২০ সালে, আমরা জানি কিছু সূক্ষ্ম কাশি, হঠাৎ হাঁচি দেওয়ার জৈব-ধূলিতে কী ধরনের কত জটিল রোগের সংক্রমণ হতে পারে।

“কন্টাজিওন” সিনেমাটির প্রথমদিকের কিছু দৃশ্যে দেখা যায় পরিচালক স্টিভেন সোডারবার্গের ক্যামেরা রোলটি একটা সময় পর্যন্ত সাদামাটা সাধারন হিসাবে কিছু ঘটনার দৃশ্যায়ন হয়ে তা নির্দিষ্ট কিছু ঘটনায় আবদ্ধ হতে থাকে। বিমানবন্দরে পাবের বারে একটি বাটিতে চিনাবাদাম; একটি সরকারী বাসের ক্রোম হাতল; একটি সংক্ষিপ্ত ক্ষেত্রে ঘটনাচক্রে রান্নাঘরের কাউন্টারে গিয়ে ক্যামেরা দৃশ্যকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সিনেমার প্রতিটি আইটেম দৃশ্যই যেন একটি হরর-ফিল্মের সাথে মিলে যায়। বাটির বাদাম, বাসের হ্যান্ডেল, রান্নাঘর প্রতিটি জড়বস্তুই প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে পরিচালকর কারিশমাটিক হাতের ছোঁয়ায়।

এশিয়ায় জন্ম নেওয়া একটি অভিনব ভাইরাসের সাথে সিনেমায় দেখানো প্রতিটি বস্তুই একসময় জড়িত হয়ে যায়। একটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেইন ফরেস্ট থেকে বাদুর উড়ছে। প্রজাতির বাধা অতিক্রম করে যখন বাদুরের মল চীনের একটি কোলাহলমুখরিত বাজারে একটি শূকরকে সংক্রামিত করে এবং যখন ভাইরাসটি শূকর থেকে শিকাগোর একটি এশিয়ান রেস্তোরাঁয় একজনের বাহক গ্যাইনথ প্যাল্ট্রোর সাথে চলে আসে। যেখানে  কসাইয়ের দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন অভিনেতা বেথ এমফোফ তার সাথে প্যাল্ট্রোর হাত মিলিয়েছিলেন।

রেস্তোঁরা, সংলগ্ন ক্যাসিনো, বিমানবন্দর, বিমান এবং তার বাড়িতে যে সমস্ত লোক তাকে ছুঁয়েছে এবং যারা তার সাথে কথা বলে তাদের প্রত্যেককে সংক্রামিত করে বেথ একটি নতুন রহস্যজনক ভাইরাস সংক্রমণের জন্য পৃথক একটি মাধ্যম হয়ে ওঠেন। যারা প্রত্যেকেই একে অন্যের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের শিকার হয়। আর এভাবেই ভাইরাসটি জ্যামিতিকভাবে বিশ্বজুড়ে প্রসারিত হয়।

সিনেমাটির বিশাল কাস্ট এবং ক্রসক্রসিং প্লট লাইন সহ – শীর্ষস্থানীয় কিছু নির্দোষ-ব্যক্তি ভাইরাসের কবলে পড়ে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলার মতই শ্বাসরুদ্ধকর থ্রিলারধর্মী একটি সিনেমা “কন্টাজিওন”। যেখানে ভাইরাস হচ্ছে একাকী নায়ক যে নিজের সামর্থের বাইরেও লড়াই করে পৃথিবীতে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। COVID-19 মহামারীর পটভূমির বিপরীতে “কন্টাজিওন” তার ভয়াবহতা নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল পৃথিবীব্যাপী এবং যেখানে বিশ্বের সবরাষ্ট্রের হতবাক হয়ে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলোনা।

সিনেমার দৃশ্যে ভাইরাসের সংক্রামণ মহামারী আকার ধারণ করার সাথে সাথে স্কুল এবং অন্যান্য সরকারী ভবনগুলি বন্ধ করে দেয়া হয়। বাণিজ্যিক ফিটনেস কেন্দ্রগুলি মনুষ্যবিহীন একাকী দাঁড়িয়ে থাকে। লকডাউনের প্রাক্কালে মানুষ বাড়িতে ডাবজাতীয় ফল ও শুকনো খাবার রক্ষণাবেক্ষণ করতে থাকে। জীবাণুনাশক এবং মাস্ক কেনাকাটার দোকানগুলিতে এসব পণ্যের স্বল্পতা শুরু হওয়ায় মানুষ আতঙ্কিত হয়ে উঠে। অবস্থা বেগতিক দেখে শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা মানুষকে সংযমের আহ্বান জানাতে থাকেন। চিকিৎসকরা সবাইকে “স্বাস্থ্যবিধি” এবং “সামাজিক দূরত্ব” মেনে চলার জন্য আবেদন করছিলেন।

সিনেমাটিতে ভাইরাস সংক্রামণে মানুষের মৃত্যুর হার COVID-19 এর তুলনায় অনেক বেশি দেখানো হয়েছে। হয়তো সিনেমাটিক রুপান্তরের ফলস্বরুপ পরিচালক  অতিফিল্মিকরুপে ভাইরাসটির দ্রুত-সংক্রমণ ঘটিয়েছেন। সিনেমাতে দেখা যায় ভাইরাসটি প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে এর শিকারকে অসুস্থ করে তুলছে এবং প্রায়শই এক দিনের মধ্যে সংক্রামিত মানুষকে হত্যা করছে যা করোনা সংক্রমণের মত ধীর নয়।

একসময় হাসপাতালে স্থান সংকুলান না হওয়ায় অন্যান্য রোগীর সাথেই ভাইরাস সংক্রামিত রোগীদেরকেও রাখতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়। “আমরা অসুস্থ মানুষের পাশে ভাল লোক রাখছি এবং আশা করি তারাও যেন অসুস্থ না হয়” – এটি ছিলো সেই মুহূর্তে লরেন্স ফিশবার্ন এর একটি ডায়ালগ যিনি সিনেমায় সিডিসি (সেন্ট্রাল ডিজিজ কন্ট্রোল) এর কর্মকর্তার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।

সিনেমায় বাস্তবিক সত্যরুপে যে দৃশ্যগুলি দেখানো হয়েছে তা হলো- সাধারণ মানুষতো দূরের কথা, অনেক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মেনেচলা মানুষেরই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই। খ্যাতিমান মানুষ যারা পর্যাপ্ত নিরাপদ বাড়িতে থাকেন, কোলাহল এড়িয়ে ব্যাক্তিগত গাড়িতে চলাফেরা করেন, যাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত চিকিৎসক সর্বদা যত্ন নিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন তারা পর্যন্ত স্বাভাবিক হাঁটাচলা করার মতোই ভাইরাসজনিত যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর কাছে নিজেরা অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়ে পড়েছেন। ভাবতে পারেন এটা কতটা ভয়াবহ!

“কন্টাজিওন” সিনেমার যে দৃশ্যটি আমার মনে দাগ কেটেছে-

প্রাথমিক ময়নাতদন্তের সময়, দু’জন প্যাথলজিস্ট একজন ভাইরাস সংক্রামিত ভুক্তভোগী মৃত মানুষের মাথার খুলিটি খুললেন এবং মাথা এবং কপালের চামড়াটি তার মুখের উপরে টেনে এনে ভাঁজ করলেন।

রোগীর মস্তিস্কের ভিতরে ভাইরাসের তাণ্ডবলীলা দেখে একজন প্যাথলজিস্ট বিস্মিত হয়ে বলে উঠলেন- “ও মাই গড! ” শুধু এতটুকু বলেই তিনি তাঁর সঙ্গীকে রোগীর শরীর থেকে দূরে সরে যাওয়ার জন্য চিৎকার করে অনুরোধ করলেন।

ভীত হয়ে তার সহকারী জিজ্ঞাসা করলেন- “আমি কি কাউকে ফোন করব?” ভাইরাস সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞ তখন বললেন- “এক্ষুনি! এক্ষুনি প্রত্যেককেই কল করুন,”!

শ্বাসরুদ্ধকর “কন্টাজিওন” সিনেমার মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন: প্যাল্ট্রো, ফিশবার্ন, ম্যাট ড্যামন, জন হকস, জুড ল, মেরিয়ান কোটিলার্ড, কেট উইনসলেট, এলিয়ট গোল্ড এবং ব্রায়ান ক্র্যানস্টন।

এখন অবধি, বেশিরভাগ পর্যবেক্ষকরা COVID-19 মহামারীতে তাদের নাগরিকদের পারস্পরিক ত্যাগের চেতনা এবং প্রশংসার জন্য বিশ্ব নাগরিকদের প্রশংসা করেছেন। যেমনটা এই সিনেমাতেও করা হয়েছে। তবে সিনেমাটির দৃশ্যপট করোনার চেয়েও অতিরিক্ত বীভৎসতা দেখানো হয়েছে বলে আমি মনে করি।

বিশ্বব্যাপী করোনা ভয়াবহতার বর্তমান প্রেক্ষাপটে দীর্ঘদিন ঘরবন্দী থাকা মানুষের দেহের স্বাভাবিক নার্ভাস সিস্টেম সামান্য ব্রেকডাউন হতেই পারে। অনেকেরই অনেক ঘটনা কিংবা প্রবাহ গ্রহণ করার ক্ষমতা কম থাকে। সেখানে ভাইরাস মহামারীর সময় ঘটিত বীভৎস কিছু ফ্লাশ দৃশ্য নিয়ে নির্মিত “কন্টাজিওন” সিনেমাটি এই মুহূর্তে না দেখাই উত্তম।

সোনেলায় “মুভি রিভিউ” বিভাগে “কন্টাজিওন” সিনেমাটি নিয়ে এটিই আমার প্রথম লেখা। তাই যেকোন ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করছি।

৯৩৮জন ৬৭৫জন
0 Shares

৩০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ