ওয়াসার পানি ফুটিয়ে কেন পান করবেন! কারণ ঐ পানিতে ক্ষতিকর জীবাণু থাকে, তাই তা ফুটিয়েই খেতে হয়। ওসব ক্ষতিকর জীবাণু ছাড়াও আরও কিছু রাষায়নিক ক্ষতিকর উপাদান থাকে যা ফুটিয়েও দূর করা যায় না। তারই একটা মৌলের নাম আর্সেনিক, যা কোন ভাবেই পানি থেকে আলাদা করা যায়না।

মোগলরা এক সময় আর্সেনিক বিষকে বেশ ভালো ভাবেই ব্যাবহার করতো। একজনকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলার জন্য সবচাইতে ভালো কাজ দিতো এই বিষ, যাতে মৃত্যুর কারণ বের করা সহজ হতো না সেই যুগে। আর সেই বিষ আমরা পানির সাথে পান করছি জেনে এবং না জেনে। আসুন আমরা সবাই একটু সচেতন হয়ে এই বিষকে প্রত্যাহার করি।

আর্সেনিক একটি রাসায়নিক মৌল যা ধাতু এবং অধাতুর মাঝামাঝি একটি পদার্থ। এগুলোকে বলে মেটালয়েড যা একটা শক্তিশালী বিষ, খুব সামান্য পরিমাণেই এটি তীব্র বিষক্রিয়া তৈরি করে। মাত্র ১০০ মিলিগ্রাম আর্সেনিক একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে। ১০০ মিলিগ্রাম কতটুকু? ১ টেবিল চামচের ২০ ভাগের ১ ভাগের ওজন ১০০ মিলিগ্রাম। এর বাসস্থান ভূগর্ভস্থ পানিতে। পানিতে কেমন করে গেলো তা না হয় এড়িয়ে যাই এই মুহূর্তে। পৃথিবীর অনেক দেশের সাথে আমাদের দেশেও এর উপস্থিতি আবিস্কৃত হয়েছে। খোদ আমেরিকাতে এর বেশ প্রকট যা তাদের গবেষকদের মাথা ব্যথারই কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক বড় বড় গবেষক কাজ করে যাচ্ছেন এ থেকে পরিত্রাণের চেষ্টায়। আমেরিকান কয়েকটা ইউনিভারসিটি সহ আমাদের দেশের গবেষকরাও এই কাজে অংশ নিয়ে বেশ কিছু তথ্য প্রকাশ করেছেন। ২০১০ এ আমাদের একটা গবেষণার ফলাফল সারা পৃথিবীর গবেষকদের টনক নাড়িয়েছিল। আমাদের দেশের সংবাদ সংস্থাও সবার নজরে আনার চেষ্টা করেছিলেন। বিশেষ একটা এলাকাতে ২০ ভাগ মানুষের মৃত্যুর জন্য এই আর্সেনিক দূষণের পানিই দায়ী যা এই গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে।

নীচে প্রথম আলোর একটা লিংকে বিশেষ তথ্য মূলক খবর পাওয়া যাবে।

http://epaper.prothom-alo.com/view/dhaka/2010-08-07/15

অনেক দেশেই এর থেকে প্রতিকারের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেয়ে শুরু করেছে। অত্যন্ত দুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে যে আমাদের সরকার একটা প্রেস নিউজ করার মাঝেই তাদের দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন তখন। শুধু তাই ই নয়,তখনকার অনেক কল্যাণ কর্তা সরাসরি আমাদের গবেষণা নিয়েও নেগেটিভ প্রশ্ন তুলছিলেন যা ছিল বেশ দুঃখজনক। The Lancet (ল্যাঞ্চেট) নামের একটা প্রথম সারির স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান ম্যাগাজিন এই ফলাফল প্রকাশ করেছিলো যা গবেষকদের জন্য বেশ সম্মানের ব্যাপার।

নিচের লিঙ্ক থেকে ফলাফলটা পড়ার সুযোগ আছে।

http://www.thelancet.com/journals/lancet/article/PIIS0140-6736%2810%2960481-3/abstract

প্রথমেই আমরা জানার চেষ্টা করি দেশের কোন কোন অঞ্চলের পানিতে এই বিষ আছে। ঢাকা শহর বাসীদের জন্য সুখবর এইজন্য যে এখানখার পানিতে এই বিষটা নাই। বেশ কয়েকটা আমেরিকান ইউনিভারসিটির সাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটিও এই জরিপের সাথে জড়িত। নিচের ম্যাপটা প্রাথমিক ধারনা দেবার জন্য দেয়া হলো। লাল রঙের এলাকা গুলো খুঁজে নিন ইন্টারনেটের সাহায্যে। জেনে নিন আপনার ভালো লাগা মানুষরা ওই এলাকাতে থাকেন কিনা। তাদের জন্য আমরা সামান্য হলেও কিছু করতে পারি বলে আমি বিশ্বাস করি।

 

ArseniMapBD (278x300)

ছবি – ১ঃ বাংলাদেশ ম্যাপ (লাল রঙের এলাকা গুলো খুঁজে নিন ইন্টারনেটের সাহায্যে যেখানে আর্সেনিকের মাত্রা বেশি)

WHO এর মতে ৫% (নীল) পর্যন্ত আর্সেনিক যুক্ত পানি মানুষের শরীরে সহনীয়।

বি এম এ ভবনে  (ঢাকা প্রেস ক্লাবের বিপরীত দিকে) এই দুষিত পানি টেস্ট (Hach Kit, Arsenic Econo-Quick etc.) করার যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়। যা দিয়ে জেনে নিন আপনার প্রিয় জনেরা কি পানি পান করছে। এই সব কিটের দাম আমাদের ক্রয় সীমার মধ্যেই আছে।

আর্সেনিক দূষণের পানি পানের ফলে সম্ভাব্য কী কী হতে পারে বা কেমন করে এদের সনাক্ত করা যায় এবং আমাদের কী করণীয় –

আর্সেনিকোসিস (Arsenicosis) প্রতিফলন মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায় যাকে আমার বলি মেলানোসিস (Melanosis ) এবং কেরাটোসিস (Keratosis)।  এ দুটোকে আরও কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়েছে চিকিৎসা সুবিধার জন্য। আপাতত আমরা এই মুল দুটো লক্ষণগুলো জানার চেষ্টা করি।

১) মেলানোসিস (Melanosis) – সাধারণত হাত, পা, বুক এবং পিঠে সাদা কালো দাগ দেখে এর প্রাথমিক ডায়াগনোসিস করা হয়। ২ নং ছবিটা একজন আরসেনিকসিস এর রুগী।

arsonicosis_Edited

ছবি – ২ (Melanosis)

এই সাদাকালো দাগ ছাড়াও মাঝে আবার কিছু কিছু ক্ষতের আকারও হয় যাকে চর্ম ক্যান্সার বলা হয়। (৩ নং ছবি)।

Ori

ছবি – ৩ (Bowens disease)

৩ নম্বর ছবিটা একটা বিশেষ lens (DermLite) দিয়ে দেখলে ৪ নম্বর ছবির মত দেখা যায়

IMG_0006-(1024x768)-(300x225)_Edited

ছবি – ৪

Clinical diagnosis – Bowens disease

Biopsy indicator – basal cell carcinoma

মুল কথা – স্কিন ক্যান্সার

২ – কেরাটোসিস (Keratosis)– হাতের তালু এবং পায়ের পাতায় গোটা গোটা শক্ত হয়ে যাওয়া। অতিরিক্ত ঘর্ষণে অনেক সময় এই রকম গোটা হতে পারে। তবে তার সংখ্যা অনেক কম।

Palm2_Edited

ছবি – ৫ (Keratosis)

৫ নম্বর ছবির এই গোঁটা গুলোতে অনেক সময় ক্ষত জন্মায় যা ঐ ক্যান্সারকেই মনে করিয়া দেবে।

আমাদের যা করণীয়–

এইসব রুগীদের একজন চর্ম চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিৎ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে ছোট ক্ষতকে ক্রাও (Cryo) করে বেশী ছড়ানো রোধ করা যেতে পারে। তাতে একজন রুগী কিছুটা হলেও ভালো থাকতে পারেন। একজন চর্ম চিকিৎসকই এই রুগীদের ভালো চিকিৎসা দিতে পারেন।

সবচাইতে ভয়ানক বিষয় এই আর্সেনিকের বিষ মানুষের প্রায় সব অরগ্যানেরই ক্ষতি করে যা বেশ কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে। তাই চর্ম চিকিৎসকের পাশাপাশি একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শও আবশ্যক। একজন মানুষের শরীরে  আর্সেনিকের মাত্রা জানার উপায় তার ইউরিন এবং রক্ত কোষ মাপা।  খুবই দুঃখজনক যা আমাদের দেশে কোন  ল্যাবেই এই পরিক্ষাগুলো করার ব্যবস্থা নাই। আমাদের দেশে যারা এই বিষয়ে গবেষণা করেন, তারা পশ্চিমা দেশের সাহায্য নিয়েই করেন।

যাদের শরীরে এই বিষ আছে, এর থেকে তার কোন পরিত্রাণ নাই। তবে ভালো চিকিৎসা পরামর্শ নিয়ে তাদের জীবনকে কিছু হলেও ভালো রাখা যেতে পারে। আমাদের দেশে একটা Clinical Trial (BEST – Bangladesh Vitamin E and Selenium Trial) করা হয়েছে ১০ বছর ধরে যা ২০১৫ তে শেষ হয়েছে। উদ্দেশ্য –  Antioxidant এর মাধ্যমে কিভাবে এই স্কিন ক্যান্সার রোধ করা যায়। আমরা এখন সেই ডাটা নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি ভালো ফল পাওয়া যাবে এবং তা সবাইকে জানানো হবে।

একমাত্র বিশুধ্য পানিই পারে এই বিষ থেকে আমাদের ধুরে রাখতে। আসুন আমরা সবাই বিশুধ্য পানি পান করি এবং সবাইকে উদবুদ্ধ করি।

উল্লেখ

http://epaper.prothom-alo.com/

http://www.grameenveoliawaterltd.com/

http://www.thelancet.com/

১৭৩২জন ১৭০৩জন

৫৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ