GUY DE MAUPASSANT
মোপাসাঁ একজন ফরাসী সাহিত্যিক, Realism ধারার একজন লেখক হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত। ছোট গল্পের যাদুকর, বলা যায় ছোট গল্পের অবিসংবাদী রাজা। পুরো নাম Henri Rene Albert Guy De Maupassant. বিশ্বের সর্বশেষ্ঠ ছোট গল্পকার হিসেবে তাকে প্রায় সকল মহলই মেনে নিয়েছেন।
১৮৮১ সালে প্রকাশিত মোপাসাঁ’র প্রথম ছোট গল্প সংকলন Ball of Suet মাত্র ৪ বছরের মাঝে ১২ তম সংস্করন ছাপা হয়। সেই উনিশ শতকে এমনটা ভাবতেও কল্পনা শক্তি দরকার হয়, অথচ এটাই ছিল বাস্তবতা। এটা ছিল তার গল্প বলবার অসাধারনত্বের স্বীকৃতি। ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত তার প্রথম উপন্যাস A Woman’s Life মাত্র ১ বছরের মাঝে ২৫০০০ কপি বিক্রি হয়। ঠান্ডা মাথায় ভাবলে এটাকে অবিশ্বাস্য লাগে। সেই সময়ে বইকে একটা পন্য হিসেবে বিচার করে মার্কেটিং এক্সপার্টদের সহায়তা নিয়ে বই বিক্রি হতো না। বই এর কপি তার চাহিদার উপর নির্ভর করতো, নানারকম ফন্দি ফিকির করে ক্রেতার মাঝে চাহিদা তৈরী করা হতো না। লেখার মানই ছিল ক্রেতার মাঝে চাহিদা তৈরীর একমাত্র উপায়।
১৮৮৪ সালে প্রকাশিত মোপাসাঁ’র The Necklace কে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটা ছোটগল্প হিসেবে মেনে নেয়া হয়েছে প্রকাশের সাথে সাথেই। সেই শ্রেষ্ঠত্ব এখনো বহাল আছে। এই গল্প নিয়ে নির্মিত স্বল্প দৈর্ঘ চলচ্চিত্র সবার অবশ্যই অবশ্যই দেখা উচিৎ। ইউটিউবে The Necklace লিখে সার্চ দিলে মুভিটির অগুনিত সূত্র পাওয়া যাবার কথা।
মোপাসাঁ তীব্রভাবে অপছন্দ করতেন আইফেল টাওয়ার। তিনি এই অপছন্দ সুযোগ পেলেই প্রকাশ করতেন। এমনকি সুযোগ না পেলে নিজেই সুযোগ বানিয়ে নিয়ে সেই অপছন্দবোধ জানিয়ে দিতেন। মজার বিষয় হচ্ছে এই আইফেল টাওয়ারের একটা রেস্টুরেন্টেই তিনি প্রতিদিন মধ্যাহ্ন ভোজ করতেন। তাকে একবার এ বিষয়ে প্রস্ন করা হলে দ্ব্যর্থ কণ্ঠে বলেছিলেন, একমাত্র এখান থেকেই এই কুৎসিত টাওয়ারটা দেখা যায় না।
মোপাসাঁ যখন বলেন A legal kiss is never as good as a stolen one তখন তার রিয়েলিজম ধারা স্পস্ট হয়ে ওঠে। মোপাসাঁ তার নিজের এপিটাফের জন্য যখন লিখেছিলেন I have coveted everything and taken pleasure in nothing তখনই তার রিয়েলিজম ধারার মাঝে নৈরাজ্যের ছোঁয়া লাগে। সাহিত্যিক হিসেবে নিজের সফলতা থেকেও জীবনের বৈচিত্রহীনতা তাকে জীবনের প্রতিই গভীরভাবে নিরাসক্ত করে তোলে। মোপাসাঁ অল্প বয়সেই সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হন। তিনি চিকিৎসা গ্রহনে অস্বীকৃতি জানান এবং এক পর্যায়ে তার মানসিক বিকারগ্রস্ততা দেখা দেয়। ১৮৫০ সালের ০৫ আগস্ট জন্ম নিলেও মাত্র ৪২ বছর বয়সে ১৮৯৩ সালের ০৬ জুলাই তারিখে নিজের গলা নিজেই কেটে মোপাসাঁ নিজেরই জীবনাবসন ঘটান।
মোপাসাঁ হয়তো দৈহিকভাবে বেচে নেই। তার সাথে লাইভ বসে এক কাপ চা-কফি হয়তো খাওয়া হবে না। কিন্তু মোপাসাঁ আমাকে ছেড়েও যায়নি। মোপাসাঁ’র জন্য ভালোবাসা।
********************************************************************
একজন বিশ্ব সাহিত্যিক ” মোপাঁসা ” সম্পর্কে কত সুন্দর আর সহজ ভাবে জানা গেল!
যারা পাঠক তাদের পড়ার তৃষ্ণা বাস্তবিক ক্ষুধা-পিপাসার চাইতেও বেশি হয়। এই পড়ার তৃষ্ণাবোধ একজন পাঠককে নিত্ত-নতুন পড়ার / জানার আগ্রহকে বাড়িয়ে তোলে। পাঠকের পড়ার কোনো নির্দিষ্ট পরিমন্ডল থাকেনা। যার যার রুচি এবং পছন্দ অনুযায়ী তারতার পাঠ্য জগৎ বিসৃত করে নেন। পড়ার এই জগৎটা তখন পরিচিত সাহিত্যকে ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে। দেশ-কাল-জাতি-ধর্ম-বর্ণ সব বাধ্য-বাধা পেরিয়ে পাঠকেরা সাহিত্য সুধায় নিজেকে মগ্ন রেখে আনন্দ পান। তবে, অধিকাংশ পাঠকেরা চান তাদের পঠিত, পছন্দের লেখকদের সম্পর্কে জানতে, বুঝতে।
লেখকের পরিচিতি, লেখকের ভাবনা, বোধ, দর্শন থেকে শুরু করে তাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের প্রতিও পাঠকের আগ্রহ থাকে। একটি লেখা, লেখার বিষয় বস্তু বুঝতে হলে লেখকের সম্পর্কে কমবেশি জানা থাকা ভালো। লেখকের দর্শন, তার চিন্তাধারা, তার সময়কার সামাজিক অবস্থান, পরিবেশ পরিস্থিতি সমন্ধে জানা থাকলে লেখাটির মুলভাব উপলব্ধি করা সহজ হয়ে যায়। বিশেষ করে লেখক যদি ভীনদেশী হয় বা কালের ইতিহাসের পাতায় তার নাম উঠে যায়, তাহলে সেই লেখককে আগে জেনে নেয়াই উত্তম।
এমনই এক চিন্তা ধারা থেকে এই সময়ের পাঠকদের জন্যে উপহার হিসেবে এলো ” বিশ্ব সাহিত্যে পরিচিতি
“
জহির আশফাকের লেখা ” বিশ্ব সাহিত্য পরিচিতি ” বইটি ইতিমধ্যেই অমর একুশে বইমেলা ২০২০ইং এ বহু পরিচিতি এবং পাঠকের মনযোগ কাড়তে সক্ষম হয়েছে। বইটি সম্পর্কে লেখক নিজে যা বলেছেন তা হলো
★★ বইটা বিশ্ব সাহিত্যের হাল সম্পর্কে ধারনা রাখেন এমন কারো জন্য লেখা নয়। সাহিত্য নিয়ে গবেষনা বা অধ্যয়ন করছেন এমন কারো জন্যও নয়। এটা মাত্র বিশ্ব সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সক্ষম এবং আগ্রহী এমন কাওকে লেখকের প্রতি আকর্ষন তৈরী করতে লেখা। যে কারণে লেখার ধরন আমি যতটুকু সম্ভব আটপৌঢে রেখেছি। একটা উদহারন দেয়া যাক, ধরুন বইটাতে আমি কামু সম্পর্কে বলেছি। কামু সম্পর্কে বলতে যেয়ে আমি absurdism ধারা নিয়ে তত্ত্ব কপচানো থেকে নিজেকে দুরে রেখেছি। এতে হিতে বিপরীত হতো বলেই আমার ধারনা। এতে করে আমার পাঠক শ্রেণীকে হয়তো দুরে ঠেলে দেয়া হতো। আমি মনে করি absurdism কি এটা জানার আগ্রহ ঐ পাঠকের জন্য আরো পরের বিষয় ★★
৪৬ পৃষ্ঠার এই বইয়ে মোট ১৩ জন সাহিত্যিকের পরিচিতি দেয়া হয়েছে। পড়ার পর যেটা অনুভব করলাম, তা হলো,অল্প পাতার স্বাস্থ্যহীন বইটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় হওয়ার যোগ্যতা রাখে। বইটির প্রতি লেখক যদি আরেকটু আবেগীয় এবং সদয় মনোভাব রাখতেন তাহলে এই বইটা একটি সম্পদে পরিনত হতে পারতো। যারা শুধু বইয়ের গল্প ছাড়াও বইয়ের পিছনের গল্প জানতে চান, তাদের জন্য এই বই।
********************************************************************
” বিশ্ব সাহিত্য পরিচিতি ” বই নিয়ে এতক্ষণ অনেক লিখেছি এবার লিখছি এই বইটার লেখক সম্পর্কে। বইয়ের শেষ পাতায় গিয়ে লেখক পরিচিতির স্থানে নিজের সম্পর্কে লেখক কিছুই উল্লেখ করেননি! বর্তমান সময়ের লেখকেরা যেখানে এক-আধটা বই বের হওয়ার আগেই অনলাইনে অফলাইনে নেঁচে-কুঁদে একাকার হয়ে উঠেন, সেখানে জহির আশফাক নিজেকে গুটিয়ে-লুকিয়ে রেখে লিখতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। জহির আশফাককে নিয়ে ” বাংলাদেশ রাইটার্স গিল্ড ” এর প্রকাশক পারভেজ রানা ভাই যা বলেছেন, তার হুবুহু টা তুলে দিলাম…
★★ জহির আশফাককে প্রথম দেখায় মনে হবে ভবঘুরে একজন মানুষ, যে কিনা, উচ্ছন্নে যাবার আগে আগে, হুট করে এসে বলতে চায়, আমার অনেক কিছু বলার আছে। তার বলার ভঙ্গি এতটাই সরল, বিভ্রান্ত করে দেয়, এবং এই বিভ্রান্তি নিয়েই তার সকল কাজ-কারবার। একজন ঘোর লাগা মানুষ হিসেবেই যেন তাকে অধিক মানায়। অথচ পেশাগত জীবনে এই মানুষটাই কেমন সহজাত ভাবে দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ। যেন, ওসব মিশে আছে তার শরীরের প্রতিটি কোষে। নিজেকে কবি পরিচয় দিতেও তার দ্বিধা আছে। আসলে কোনো নির্দিষ্ট পরিচয়ের আবরণ সে এড়িয়ে যেতে চায়। একজন মানুষ, যে কিনা সুশাসনের জন্য নিজের বৃহত্তম ছাড় দিতেও সম্মত। ★★
বই সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য _
* লেখক- জহির আশফাক
* প্রকাশক- পারভেজ রানা
* প্রচ্ছদ- মুস্তাফিজুর রহমান রুপম
* মুল্য- ১৬০ টাকা,
মেলা চলাকালিন মুল্য-১২০ টাকা।
★ প্রকাশনা- বাংলাদেশ রাইটার্স গিল্ড
* বর্তমান প্রাপ্তিস্থান-
অমর একুশে বইমেলা ২০২০ইং,
স্টল নং – ৪৮৪,৪৮৫
১৭টি মন্তব্য
ফয়জুল মহী
অসাধারণ, লেখা খুবই ভালো লাগলো।
সাবিনা ইয়াসমিন
ধন্যবাদ মহী ভাই।
সম্ভব হলে বইটি পড়ে দেখবেন, ভালো লাগবে।
শুভ কামনা 🌹🌹
সুপর্ণা ফাল্গুনী
খুব ভালো লাগলো আপু। এতো সুন্দর করে লিখেছেন যে এক কথায় বলতে গেলে অসম্ভব সুন্দর হয়েছে। ভালো থাকুন
সাবিনা ইয়াসমিন
ধন্যবাদ সুপর্ণা,
বইটি পড়ে আমার খুব ভালো লেগেছিলো। ভালো লাগা থেকেই এই রিভিউটা দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছি।
ভালো থেকো,
শুভ কামনা 🌹🌹
তৌহিদ
অনবদ্য একটি লেখা পড়লাম। এমন তথ্যসমৃদ্ধ লেখাগুলো সোনেলার মানকে বৃদ্ধি করছে নিশ্চিত।
ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য সাবিনা আপু।
সাবিনা ইয়াসমিন
আপনাকেও ধন্যবাদ ভাই।
বুক রিভিউ শুধুমাত্র নিজস্ব ধারণা দিয়ে লেখা যায় না। বই সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য রেখে যদি সংরক্ষণ করা যায় তবে পাঠকদের জন্যেই সুবিধা হয়। আমি প্রফেশনাল নই। তাই রিভিউটা সম্পূর্ণ করতে পারিনি।
শুভ কামনা 🌹🌹
সুপায়ন বড়ুয়া
বিশ্ব সাহিত্যের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে
লেখককে যেভাবে তুলে ধরলেন সত্যি অসাধারন।
শুভ কামনা আপনার জন্য।
সাবিনা ইয়াসমিন
বিশ্ব সাহিত্য বইটি আকারে ছোট হলেও অসাধারণ। আশা করছি পরবর্তীতে লেখক বইটিতে আরো অনেক সাহিত্যিকের পরিচিতি সংযোজন করে পূর্ণ আকারে আনবেন। যিনি এমন একটি বই লেখার কথা ভেবেছেন, এবং ভাবনাকে বাস্তবায়িত করেছেন, তার সম্পর্কে না লিখলে রিভিউটা অসম্পূর্ণ লাগতো।
অনেক ধন্যবাদ,
ভালো থাকুন দাদা,
শুভ কামনা 🌹🌹
হালিম নজরুল
খুব জরুরী বইটি সংগ্রহ করার ইচ্ছে আছে।
সাবিনা ইয়াসমিন
সম্ভব হলে সংগ্রহে রাখতে পারেন। ছোট আকারের পরিমার্জিত বইটি পড়ে আপনারও ভালো লাগবে নজরুল ভাই।
অনেক ধন্যবাদ ও শুভ কামনা 🌹🌹
জিসান শা ইকরাম
এত সুন্দর রিভিউ আমি আর অতীতে পড়িনি,
আপনার রিভিউ লেখা পড়ে মুগ্ধ হলাম।
রিভিউতে বই এবং লেখক সম্পর্কে পরিস্কার এবং স্বচ্ছ ধারনা দিলেন।
এত গুনী একজন মানুষের বইটি অবশ্যই কিনে পড়ব।
শুভ কামনা লেখক এবং আপনার জন্য।
সাবিনা ইয়াসমিন
চেষ্টা করেছি সম্পুর্ন একটি রিভিউ লিখতে, কতটুকু পেরেছি জানি না। আপনার কমেন্টে অনুপ্রেরণা পেলাম। ধন্যবাদ আপনাকে।
বইটি পড়ে আপনারও ভালো লাগবে।
শুভ কামনা 🌹🌹
মনির হোসেন মমি
অসাধারণ রিভিউ ।অ-কবিতার কবি যে এতো ভাল সুন্দর রিভিঊ দেয় তা এটা পড়ে বুঝলাম।ভাল।
সাবিনা ইয়াসমিন
ছোট্ট ভাইয়েরা যে বড় (!) বোনের প্রশংসা একটু বেশি বেশিই করে তা আরেকবার চাক্ষুষ করলাম 🙂
ভালো থাকুন মমি ভাই,
শুভ কামনা 🌹🌹
আরজু মুক্তা
ভালো লাগলো
ছাইরাছ হেলাল
আপনার পক্ষেই সম্ভব!
পুরো বই(প্রায়) টাইপ করে ফেলেছে।
অবশ্য এমন বইয়ের জন্য এটুকু করাই যায়।
চিন্তিত মতামত দিয়েছেন সুন্দর করে।
মোপাসাঁ সমগ্র পড়ার সুযোগ হয়েছে।
সঞ্জয় মালাকার
খূব ভালোলাগলো দিদি, এতো সুন্দর করে লিখেছেন
পড়ে মুগ্ধ হলাম।
দিদি আপনার জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা🌹🌹