
নাসিমাকে সন্ধ্যার আগে আগেই বিদায় করা হয়েছে। নদীর ঘাট পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিতে সবাই গেলেও যায়নি শুধু মৃদুল। একটা ভাঙ্গা হাটের নাইটগার্ড হয়ে সে যেন বসে আছে বৈঠক খানার রেলিং ঘেরা বারান্দায়। সন্ধ্যার পাতলা অন্ধকার ধীরে ধীরে গ্রাস করছে প্রকৃতি ও প্রতিবেশকে। বিদায়ের সময় নাসিমার বুক ফাটা আর্তনাদ, উচ্চস্বরের চিৎকার। তার কাছাকাছি এসে মাটিতে গড়িয়ে পড়ার দৃশ্যগুলো একটার পর একটা বারবার ফরোয়ার্ড-রিওয়াইন্ড হচ্ছে। মৃদুলের বুকের মধ্যেও একটা কষ্ট কিছুক্ষণ পরপরই দলা পাকিয়ে ওঠছে। সে এখন দেখতে পাচ্ছে একটা অসুরের প্রতিমূর্তি যেন নাসিমার কোমল পেলভ শরীরটাকে নিয়ে এক ভয়ানক অসুরীয় তান্ডবে মেতে ওঠেছে। এক শব্দহীন বোবাচিৎকারে নিজের শ্রবনিন্দ্রিয়ই অবস করে দিচ্ছে তার।
এমন একটা অবস্থায় কখন এসে যে ফরিদাভানু মৃদুলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পায়নি সে। মামীকে দেখেই মৃদুল ওঠে দাঁড়ায়। কাঁদতে কাঁদতে ফরিদা ভানুর চোখ ফুলে গেছে। এ বাড়িতে মেয়েটিই ছিল তার একমাত্র অবলম্ভন। বিয়ের প্রথম দিকেই নাসিমা পেটে এসেছিল। নাসিমার পর তার আর কোনো ভাই-বোন হয়নি। তার যখন পাঁচ বৎসর তখনই নাসিমার বাবা কাদিম আলী মোল্লা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে এক রকম বিছানায়। তাই মায়ের আদর আর ভালোবাসায়ই বড় হয়েছে সে। তবে নিঃসন্তান ওয়াহিদ মোল্লাও নিজের সন্তানের মতো কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে নাসিমাকে।
মৃদুল ওঠে দাঁড়াতেই ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে মৃদুলকে ঝরিয়ে ধরে ফরিদা ভানু। মৃদুলও আর তার চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারে না। এ ভাবেই দু’জনের মধ্যে চলে কিছুক্ষণ শব্দহীন কান্না। এই সময়টাতে একজন পুরুষ মানুষকে যতটুকু সহনশীলতার পরিচয় দিতে হয় মৃদুল যেন তা কিছুতেই দিতে পারছেনা। একটা সময়ে এসে সে তার দুর্বলতার রাশকে টেনে ধরতে সমর্থ হয়। মামীকে প্রবোধ দিতে টেনে পাশে একটা চেয়ারে বসায়। কিন্তু এতে ফরিদা ভানুর কান্নার হেচ্কীটা আরো বেড়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতেই ফরিদা ভানু বলে-
: নাসিমা তোমারে খুব ভালবাসতো। আমি তা বুঝলেও কোনদিনঐ তারে বুঝতে দেই নাই। সে এতই চাপা স্বভাবের মেয়ে আছিল যে, কাউরে কোন দিন কিছু বুঝতে দেয় নাই। কিন্তু আমি বুঝতাম তার অন্তরের দহন। আমার নিজেরও খুব ইচ্ছা আছিল, তোমারে মেয়ের জামাই করার। কিন্তু আমাগো মা মেয়ের ইচ্ছা হইলে কি হইবো। তোমাদের পক্ষ থাইকা তো কোন ইঙ্গিত কোন দিনঐ পাই নাই। বিশেষ করে তোমার পক্ষ থাইকা। মেয়ের মা হইয়া ত আমি তোমারে সরাসরি কিছু বলতেও পারি নাই।
ফরিদা ভানুর কথা শুনে মৃদুল যেন পাথর মানুষ হয়ে বসে থাকে। তার সকল আবেগ সকল অনুভুতিই যেন এ মুহুর্তে ভোতা হয়ে গেছে। এর কোন জবাব দেবার ভাষা সে হারিয়ে ফেলে। মৃদুলের এই নিশ্চলতা দেখে ফরিদা ভানুই আবার বলা শুরু করে-
: আমি বেশ কয়দিন দেখছি, সবাই ঘুমিয়ে গেলে সে তোমার একটা ছবি বের করে ছবিটার সাথে নিজে নিজেই কথা বলত। একদিন আমি চুপি চুপি দেখি সে তার ওড়নাতে চোখ মুছতাছে আর বলতাছে-
: তুমি এত পাষাণ। আমার মনের কতা তুমি বুঝলানা। আমি মেয়ে মানুষ হইয়া কী নিজের মনের গোপন কথা খুইলা বলতে পারি। আমারে তোমার ভালা লাগবো কেমনে। তুমি হইলা অনেক শিক্ষিত মানুষ। ভারসিটিত পড়। কত সুন্দর সুন্দর মেম সাব গো সাথে এখন তোমার ভাব। আর আমি হইলাম গিয়া গাও গেরামের নাসিমা। হের কথা কে মনে রাহে। কিন্তু আমি যে তোমারে কিছুতেই ভুলতে পারি না। তুমি আস। আইসা আমারে মাইরা দিয়া যাও। আমি তোমারে ছাড়া বাচুম না মৃদুল ভাই। তুমি আস। একবার আইসা আমারে দেখা দিয়া যাও। তোমার কাছে আমি আর কিছুই চাই না। এই কথা বইলাই ও বালিসে মুখ চাইপ্যা অনেকক্ষণ ধইরা কানলো। এরপর কান্দা থামাইয়া আবার বলা শুরু করল-
: ভালাঐ যদি না বাসবা তা হইলে ছোট বেলায় মিছা মিছা আমার বর হওয়ার লোভ দেখাইছলা ক্যান। সেই থাইক্যাঐ ত আমি তোমারে মনে মনে ভালা বাইসা ফালাইছি। আর এখন বড় হইয়া আমারে বুইলা গেলা।
ফরিদা ভানু যেন এতক্ষন কোন মন্দিরের পাথর মুর্তির সাথে তার আকুতির কথা বলছিল। এত কথার পরও মৃদুলের নির্বিকারতা যেন কাটাতে পারছে না সে। এতক্ষণে চারিদিকের আঁধার আরও গাঢ় হয়ে জমেছে যেন। এই ঘন অন্ধকারে বসেই ফরিদা ভানু আবার বলা শুরু করে-
: সেইদিন মেয়ে এ অবস্থা দেখে সব চক্ষু লজ্জার মাথা খেয়ে দুই তিন মাস আগে তোমার আম্মা যখন আমাদের বাড়িতে বেড়াইতে আইল তখন তার সাথে নাসিমা ও তোমার সম্মন্ধের কথাডা তুলি। কথাটা বলেই ফরিদা ভানু আবার কান্নার হেচ্কী তোলে। মামীর কান্না দেখে এতক্ষণের নৈঃশব্দতা ভেঙ্গে মৃদুল জিজ্ঞেস করে-
: সেদিন কী বলেছিল আম্মা।
: না বাবা। এখন আর এসব কথা না বলাই ভালা। ফরিদা ভানু বলে।
: না বলুন মামী। আম্মা কি বলেছিল।
: থাকনা এসব কথা এখন।
: না মামী বলুন। আমি শুনতে চাই কথাটা।
ফরিদা ভানু কিছু না বলে কিছুটা সময় চুপ করে থাকে। এর ফাঁকে নিজকে কিছুটা গুছিয়ে নেয় সে। তখনই আবার তাগাদা দেয় মৃদুল-
: বলুন না মামী, আপনার এ প্রস্তাবে কি বলেছিলেন আম্মা।
: না। কি আর বলব। ত তুমি যখন এত কইরা বলছ তখন বলি শোন। আমার এই কথা শুইনা তোমার আম্মার চেহারা কেমন জানি হইয়া গেল। কতক্ষণ চুপ কইরা থাইকা বলল-
: ছেলে আমার এমএ পড়ে। তার লাইগা ত কম কইরা হইলেও একটা বিএ পাশ মাইয়া দরকার। আমাগো নাসিমা ত মেট্রিক পাশঐ করতে পারল না। তা ছাড়া মৃদুলের লাইগা তো অনেক ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারঐ লাইন দিয়া আছে। হেরে বিয়া করাইলে শহরেঐ বিয়া করামু। তোমরা নাসিমারে নিয়া অন্য চিন্তা কর। তোমার আম্মার এই কথা শুইনা সেইদিন আমার পায়ের তলার মাটি যেন সইরা যাইতে লাগলো। মনে মনে ভাবলাম মৃদুলের আম্মা ত ঠিইঐ কইছে। তাগো পোলা কত উচ্চ শিক্ষিত। আর আমাগো মাইয়া হইলো গিয়া কম লেখাপড়া জানা মাইয়া। কার জন্য আমি কি বলি।
কথাটা শেষ করেই বুক নিকাষ করা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ফরিদা ভানু। যে দীর্ঘশ্বাসে তার ভেতরের সকল কষ্ট যেন বিষাদের ঢেউ হয়ে আছরে পড়ে এসে মৃদুলের উপর। সেই আছড়ে পড়া কষ্টের ঝাপটাটা কোন রকম সামলে নিয়ে মৃদুল বলে-
: মামী এত কিছু হয়ে গেল; এর তো কোনো কিছুই জানিনা আমি। আর নাসিমা তো কোনো দিনই আকারে ইঙ্গিতেও তার নিজের ভেতর পোষে রাখা কথাগুলো আমাকে খুলে বলেনি। আর আমি নিজেও নাসিমাকে নিয়ে ঐ ভাবে কিছু ভাবেনি। আমি শুধু তাকে ছোট বোন হিসাবেই দেখেছি। সত্যি সত্যি যদি আমি তার মনের কথা বুঝতে পারতাম তা হলে…
মৃদুল আর এগুতে পারে না। সে কথার মধ্যখানেই হঠাৎ করে থমকে যায়। এই ফাঁকে ফরিদা ভানু মৃদুলকে বলে-
: জানলে কি করতা। তুমি কী তোমার মায়ের ইচ্ছা ছাড়া নাসিমাকে বিয়া করতে পারতা ?
: জানলে বিষয়টা নিয়ে অবশ্যই সিরিয়াসলী ভাবতাম। মাকে বুঝাতাম। তাছাড়া নাসিমা তো আমাকে কোনদিন ধরাই দেয়নি। বরং কখনো কখনো বলেছে। আমাদের সম্পর্ক যেমন আছে তা যেন চির দিন এমনই থাকে। আমরা যে কেউ কাউকে কোনদিন ভুইলা না যাই।
মৃদুলকে থামিয়ে দেয় ফরিদা ভানু-
: একটা মেয়ে মানুষ এর থাইক্যা আর ভাইগ্যা কি বুঝাইব। বোকা ছেলে। তোমারে যতটুক চালাক মনে করছিলাম, তুমি ত তেমন চালাক না। কথাটা শেষ করেই ফরিদা ভানু কেমন অন্যমনস্কতায় ডুবে যায়। মৃদুলও যেন এই মূহুর্তে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে চুপচাপ বসে থাকে। ফরিদা ভানু অন্য মনস্কতার আবরণ ভেদ করে বলে-
: থাউক। যা হওনের তা হইয়া গেছে। এখন আর এইসব নিয়া কথা কইয়া কি লাভ হইব। তোমরা সুখি থাইক। আর আমার মাইয়াটার লাইগা দোয়া কইরো সে যেন স্বামী সংসার নিয়া সুখি হয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফরিদা ভানু বলে, চল ভিতর বাড়িত যাই।
: না মামী। আপনি যান। এখানে আমি আরো কিছুটা সময় বসি।
: এই অন্ধাকারে একলা একলা বইসা থাইকা কি করবা। চল। চল।
: মামী, আপনি যান, আমি কিছুটা পরে আসছি।
ফরিদা ভানু ভিতর বাড়িতে চলে যায়। অন্ধকারের ভয়ানক নির্জতাকে সঙ্গি করে মৃদুল বসে থাকে। কেন, সে এখানে একা একা বসে থাকবে তার কোন কারণই যেন জানা নেই মুদুলের। [চলবে…]
২৩টি মন্তব্য
নুর হোসেন
আপনার উপন্যাসের কথামালা ভালো,
লিখতে থাকুন শুভ কামনা রইলো।
মাহবুবুল আলম
ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা রইলো!
মনির হোসেন মমি
দারুণ এক রুদ্ধশ্বাস ঘটনার মধ্য দিয়ে নাসিমার বিদায় হলেও মৃদুল খুব একা হয়ে গেল। মামীর কাছে নাসিমা বৃত্তান্ত জেনে মৃদুলের এখন কেবল অনুশোচনাই হচ্ছে। খুব ভাল লাগছে এ পর্বে পিউকে পেলাম না তেমন।
মাহবুবুল আলম
এটি একটি ত্রিভূজ প্রেমের উপন্যাস।
ধন্যবাদ মমি ভাই!
সুপর্ণা ফাল্গুনী
গল্প ভালোই এগিয়ে যাচ্ছে
মাহবুবুল আলম
ধন্যবাদ আপনাকে!
মোঃ মজিবর রহমান
হাইরে প্রেম ! হাই ভালবাসা শুধুই পানি ঝরায়। সবাই বোকা কেউ কাউকে বলেনা তা হই!!!
ভাল লাগা রেখে দিলাম,
মাহবুবুল আলম
প্রেম এমনই। ধন্যবাদ আপনাকে!
মোঃ মজিবর রহমান
চলুক সেভাবেই। ভাল থাকুন আপনি।
প্রদীপ চক্রবর্তী
বেশ ভালো লাগছে দাদা।
এগিয়ে চলুক।
শুভকামনা রইলো অশেষ।
মাহবুবুল আলম
ধন্যবাদ আপনাকে!
মাহবুবুল আলম
আপনাকেও ধন্যবাদ!। ভাল থাকবেন!
সুরাইয়া পারভিন
আপনার উপন্যাস পড়তে পড়তে আমার চা সরবত হয়ে গেলো। অবশেষে কাউয়াগোছের লোকটার সাথেই বিয়ে হলো নাছিমার 😭😭
মাহবুবুল আলম
হাহাহাহা। উপন্যাসের গল্পটি আপনার ভাল লেগেছে জেনে খুবই খুশি হলাম! ভাল থাকবেন!
নিতাই বাবু
মামীর কাছে তো সবকিছুই শুনল! এবার দেখা যাক মৃদুলের কী অবস্থা হয়! পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম, শ্রদ্ধেয় প্রিয় কবি।
মাহবুবুল আলম
নিতাই বাবু! শুভেচ্ছা জানবেন।
শুভ কামনা রইলো!
তৌহিদ
এই তাহলে আসল ঘটনা? নাসিমা মৃদুলকে ভালোবাসতো?
আহারে! মামীর জামাই আর হওয়া হলোনা মৃদুলের।
পর্বগুলি ভালো লাগছে পড়তে ভাইজান। শুভকামনা।
আর হ্যা, আপনার ব্যস্ত সময় থেকে কিছু সময় বের করে সোনেলাকে দিচ্ছেন দেখে সত্যিই আনন্দিত লাগছে। এভাবেই পাশে থাকবেন ভাই।
মাহবুবুল আলম
ধন্যবাদ তৌহিদ ভাই।
এমন করে বলবেন না।
সোনেলাতো আমাদেরই!
ভাল থাকবেন।
শুভ কামনা রইলো!!
জিসান শা ইকরাম
ত্রিভুজ প্রেম মনে হচ্ছে 🙂
পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা।
শুভ কামনা ভাই।
মাহবুবুল আলম
জিসান ভাই! আজ নবম পর্ব দিলাম। আশা করি ভাল লাগবে।
ভাল থাকবেন। শুভ কামনা!!
এস.জেড বাবু
নাসিমার জন্য খারাপ লাগলেও
কষ্ট লাগছে মৃদুলের জন্য।
বেচারা বেচারা লাগছে।
পরের পর্বে মৃদুলের জন্য শুভকামনা রেখে গেলাম।
মাহবুবুল আলম
আসলে ত্রিভূজ প্রেমের গল্পে এমনটাই হয়।
আজ নবম পর্ব দিলাম। আশা করি পড়বেন।
কামাল উদ্দিন
…………..হয়তো নাসিমার জন্য বুকের ভেতর জমে থাকা একটা অপ্রকাশিত ভালোবাসাকে কবর দেওয়ারই চেষ্টা করছে সে।