হ্যা, আমরা উত্তরবঙ্গের মানুষ মফিজঃ
—————————————————-

উত্তরবঙ্গের মানুষকে মফিজ কেন বলা হয় জানেন কি? তাহলে শুনুন-

গাইবান্ধা জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত অত্যন্ত সৎ একজন ড্রাইভার ছিলেন মফিজ। তাঁর শেষ জীবনের সঞ্চয় এবং বাবার দেয়া সামান্য জমি বিক্রয় করে ঢাকা রুটের একটা পুরাতন বাস ক্রয় করে ঢাকা- গাইবান্ধা রুটে বাসটি চালু করলেন। গরীব দরদী মফিজ সাহেব দিনমজুর লোকদের স্বল্প ভাড়ায় ঢাকা নিয়ে যেতেন।

এক সময় বয়সের ভারে মফিজ সাহেব অন্য ড্রাইভার দিয়ে বাস চালনো শুরু করলেন। কিন্তু দিনমজুর শ্রেনীর লোকেরা ভাড়া সাশ্রয়ের জন্য তাঁর বাড়িতে ধর্না দেয়া শুরু করলো। তাদের উপকারের জন্য সাদা কাগজে মফিজ লিখে সুপারভাইজারকে দিতে বলতেন এবং বাসের ছাদে নামমাত্র ভাড়ায় ঢাকা যাতায়াতের সুবিধা করে দেয়ার ব্যবস্হা করতেন। বাসের সুপারভাইজার “মফিজ” স্বাক্ষরযুক্ত কাগজ সংগ্রহ করে কম ভাড়া আদায় করতেন। তাই বাসের ছাদে উচ্চস্বরে সুপার ভাইজার বলতেন কয়জন মফিজ আছো ছাদে? অথাৎ কয়টা মফিজের স্লিপ আছে? আর এ ভাবে গরীবের উপকারী বন্ধু মফিজ শব্দটি চালু হয়। আজ আমরা ঠাট্টা করে অনেকে ‘মফিজ’ শব্দটি উচ্চারণ করি। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলেন ‘মফিজ’ হওয়ার যোগ্যতা কি আপনার আমার আছে?

এখন আসুন মুল কথায়- ব্যাকডেটেট, পিছিয়ে থাকা জনগনকে ভাইভা বোর্ডে নব্বই ডিগ্রী এ্যাংগেলে ভ্রু-কুঁচকে বলা হয় – ও…! তোমার বাড়ি উত্তর- বঙ্গে?
তারপর রেজাল্ট যা হবার তাই হয়। এটা একটা কমন চিত্র। ব্যাপারটা কি সত্যি এরকম? আসলেই কি এরা ব্যাকডেটেট? যাদের মানসিকতা এমন তারা কি আপডেটেড?

আসুন আমাকে মফিজ বলার আগে নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দিয়ে যান-

আজকের প্রভাবশালী জনপ্রিয় লেখক আনিসুল হক কোথাকার? সৈয়দ শামসুল হক কোথাকার? কবি শেখ ফজলল করিম কোথাকার ছিলেন? ফকির মজনু শাহ? আব্বাস উদ্দীন? তেভাগা আন্দোলনের সফল নায়ক হাজী দানেশের বাড়ি কোন বঙ্গে ছিল? প্রফুল্ল চক্রবর্তী আর ক্ষুদিরাম বসু কোথাকার ছিল জানেন? পারবেন বলতে?

যে নারী ম্যাডামগন আজকে ভাইভাতে কর্তার চেয়ারে বসে উত্তরবঙ্গকে ব্যাকডেটেট বলে, সে হয়তো ভুলে গেছে মেয়ে মানুষদের পড়াশুনার ইতিহাস-  উত্তরবঙ্গের বেগম রোকেয়া না থাকলে দেশের নারী জাগরণ আজ কি হতো? তানিয়া আমিররা আইনজীবী হতে পারতো না, বিমানের পাইলট হতে পারতো না কানিজ ফাতেমারা ; ওয়াসফিয়ার হিমালয় জয় করা লাগতোনা। চুলায় আগুন দিতে দিতে এদের জীবন শেষ করতে হতো।

মৌর্য সেনদের রাজধানী কোথায় ছিল? ঢাকা তো দু- চার’শ বছর আগে রাজধানী হল। ঢাকা অনেক জুনিয়র, সিনিয়র রাজধানী তো মহাস্থানগড়!! নয় বছর দেশ চালানো এরশাদ সাহেব কোথাকার? শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কোন বঙ্গের? বগুরার ম্যাডাম খালেদা জিয়ার জন্ম দিনাজপুর।

দেশের সংকট সময়ে সাহসী সেনাবাহিনীর প্রধানরা কোন বঙ্গের ছিল? বিখ্যাত সাংবাদিক থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাওয়া মশিউর রহমান যাকে আমরা জাদু মিয়া নামে চিনি তার বাড়িটাও উত্তরবঙ্গের রংপুরে। কি কিংকর্তব্যবিমূঢ় লাগছে? বাংলাদেশের বিপদকালীন সময়ে হাল ধরা রাষ্ট্রপতিরা আর সেনাপ্রধানরা কোন বঙ্গের?

বলুন, আমি উত্তর চাই।

একবার বাংলা একাডেমিতে আঞ্চলিক বিতর্ক হচ্ছে। এই বিতর্ক নিজের অঞ্চলের ভাষায় করতে হয়। একটু মজাও করতে হয়। রংপুরের পক্ষে বিতর্কের যে অংশটুকু চ্যানেল আই-এ দেখানো হল সেটি ছিল সংক্ষেপে এরকম- “হামার দ্যাশের জনক বঙ্গবন্ধুর ছাওয়া শেখ হাসিনা। তার বিয়ার জন্যে পাত্র খুঁজিবার নাগচে। কোনোটে ভালো পাত্র পায় নাই। শ্যাষে সবারচাইতে ভালো পাত্র কোটে পাইচে কন তো বাহে? হামার অমপুরত!!”

কি বুঝলেন?

বাদ দেন, সারা দেশে শতসহস্র ছেলে থাকতে বঙ্গবন্ধু ওনার মেয়েকে উত্তরবঙ্গের ছেলের সাথে বিয়ে দিলেন কেন? কারন বঙ্গবন্ধু জানতেন ওয়াজেদ জিনিয়াস, হু ইজ রিয়েলি স্মার্ট!!” দেশ চালায় কোন বঙ্গের মানুষ? কোন বঙ্গের পুত্রবধু? সাবধান!

মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জাতীয় চার নেতার এক নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর , জেনারেল জে.এন.চৌধুরী (সাবেক ভারতীয় সেনাপ্রধান), সাবেক বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল(অবঃ) এ.কে. খন্দকার, স্যামসন এইচ চৌধুরী যিনি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ঔষধ প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লি: এর প্রতিষ্ঠাতা। সঙ্গীতশিল্পী তপন মাহমুদ, বাপ্পী লাহিড়ী, ডলি সায়ন্ত্বনী, বাদশা বুলবুল ,খ্যাতিমান উপস্থাপক ফজলে লোহানী, বাংলা গদ্যরীতির সার্থক রূপকার সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী, কবি বন্দে আলী মিয়া, উপমহাদেশের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা সুচিত্রা সেন, টিভি ব্যক্তিত্ব চঞ্চল চৌধুরি, জাহিদ হাসান, তৌকির আহমেদ, নায়ক আলি রাজ, পরিচালক বৃন্দাবন দাস সহ অনেকে- এরা সবাই কিন্তু উত্তরবঙ্গের! জানেনতো?

ধৈর্য হারাবেননা, আরও আছে-

স্বপ্নাতুর কবি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, ডক্টর আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন, মাওলানা খোন্দকার আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, যাদব চন্দ্র চক্রবর্তী , রজনী কান্ত সেন, ফতেহ লোহানী, কন্ঠ শিল্পি কনকচাঁপা, মুসা ইব্রাহীম একজন বাংলাদেশী পর্বতারোহী এবং সাংবাদিক, যিনি প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান মন্ত্রনালয়ের সদ্যবিদায়ী মন্ত্রী জনাব নাসিম এরা সকলেই উত্তরবঙ্গের সন্তান ।

ভুলে যাবেননা সজীব ওয়াজেদ জয় একজন রংপুরের সন্তান। হাঁসের মত প্যাকপ্যাক করে ভাইভা বোর্ডে উত্তরবঙ্গের মফিজ বলে সবাইকে তাড়িয়ে দিলে প্রেসিডেন্ট জিয়া, জেনারেল এরশাদ, খালেদা জিয়া, আনিসুল হকদের পেতোনা এই বাংলাদেশ।

ভারত সহ বিশ্বে ১৫০ টির বেশি দেশে পন্য রপ্তানি করে সারা বিশ্বে দেশের সুনাম আনছে প্রান আর এফ এল গ্রুপ, দু:খিত ভাই এটাও উত্তরবঙ্গের।

সারাবিশ্বে ফ্যাশন দুনিয়ার রানী বলে সমাদৃত বিবি রাসেল, এই মানুষটার বাড়িও রংপুর। অসংখ্য রহিমুদ্দি, করিমুদ্দি ভরসা কিংবা আমজাদ খান চৌধুরি পুরো উত্তরবঙ্গ জুড়ে।

মেধার অভাব উত্তরবঙ্গে নেই তবে কিছু কিছু চেয়ারে বসা কর্তাব্যক্তির “সুস্থ মানসিকতার” অভাব আছে। সেসব কথিত মহান ব্যাক্তিরা উত্তরবঙ্গ বলে উপহাস করে যখন কাউকে পাঠিয়ে দিলেন তারা হয়তো তখন ভাসানী, ক্যাপ্টেন মনসুর, একজন আনিসুল হক কে কিংবা ভবিষ্যত কোন রাষ্ট্রপতিকে হারিয়ে ফেললেন। সাথে সাথে এক ধাপ পিছিয়ে গেল বাংলাদেশ।

আমি একটা কথা সবসময় বলি- মনে রাখবেন, রাষ্ট্র শাসনের নবাবীত্ব উত্তরবঙ্গ থেকেই এসেছে। তাই উত্তরবঙ্গের মানুষকে মফিজ বলার আগে এই কথাগুলো একবার ভেবে দেখবেন।

আমার কথাঃ
——————

এই যে আমাকে আপনাদের বন্ধু হিসেবে পেয়েছেন সেই আমিও কিন্তু উত্তরবঙ্গের। তাই উত্তরবঙ্গের মানুষকে মফিজ বলার আগে আরো একবার ভেবে বলবেন।

লেখাটি বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগৃহীত এবং পরিমার্জিত। মফিজ নামের সেই মানুষটির নামের সাথে এই “মফিজ” শব্দটির নামকরনের তেমন কোনো অথেনটিক সোর্স আমি খুঁজে পাইনি, তবে এটি যুক্তিযুক্ত। তথ্যগুলি যাচাইয়ের জন্য নীচের পত্রিকা এবং ওয়েবসাইটগুলির সাহায্য নিয়েছি।

ছবিঃ সংগৃহীত

তথ্যসূত্র-

http://www.namingbd.com

http://www.bangladeshtimes.net/উত্তরবঙ্গের-মানুষকে-মফিজ/

https://the71age.com/archives/8264

২১১৫জন ১৮৩৬জন
0 Shares

৩৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ