
আমরা বাঙ্গালীরা বুঝি কিন্তু বেশ দেরিতে। আর তাতে মাঝে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। পরে যেটা রিকোভার করতে অনেক সময়, কাঠ- খড় পোডাতে হয়।
আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতা, এনজিওতে জব করার সুবাদে যেগুলোর অর্জন। আমাদের কোঅর্ডিনেটর একজন মহিলা আশরাফী আপা ( ছদ্ম নাম)। আমাকে তিনি ভীষন পছন্দ করতেন কারন আমি বাস্তবে অনেক অগোছালো, যেমন- তেমন হলেও প্রফেশনাল রেসপন্সসিবিলিটিস সুন্দর ও নিখুঁতভাবে পালন করি। আর অনেক সিরিয়াস বিষয়ও হাসি ছাড়াই উপস্থাপন করি। তাই আশরাফী আপা আমাকে সবসময় সাথে নিতেন।
অধিকাংশ ক্যাম্পেইন ছিলো রংপুরের চর এলাকায়। আর তা জনসচেতনতা বিষয়ক। অর্থাৎ কনডম, পিল, জন্মনিয়ন্ত্রনের অন্যান্য উপকরন বিষয়ক। মহিলাদের নিয়ে আসার জন্য ফিল্ড ওয়ার্কারদের বলে রাখা হতো এবং নাস্তা পানির আয়োজন করা হতো। তবুও চরের মহিলারা আসতেই চাইতো না। যারা আসতো তারা প্যাকেট নেবার লোভে। কোনভাবে আগে দিয়ে দিলে আর তাদের পাওয়া যায় না, মাঠ ফাঁকা।
ফ্রিতেই সব উপকরন দেওয়া হতো। এবং সব পিলই তাদের কাছে ‘মায়া বড়ি’ নামে পরিচিত। আর কনডম স্বামীরা ব্যবহার করে কিনা এটা জানতে চাইলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। মানে চেনে না, তখন তাদের প্যাকেট থেকে বের করে দেখানো হতো।
তাদের চোখ কপালে- ওমা এতো বেলুন, ছাওয়ারা ফুলায়। আরও কিছু বিষয় ছিলো যা বলাও যায় না এমন একটা ভাব তাদের। পুরুষদের শেখানোর জন্য ডামি হিসেবে কাঠের পুতুল ব্যবহার করা হতো। এতে তাদের লজ্জার শেষ নেই। অথচ বছর বছর এই লজ্জা জনক কাজ করেই বাচ্চা জন্মে দেশ ভরায় ফেলছে তাতে কোন সমস্যা নেই।
ফিল্ডে সমস্যার শেষ নেই হাদিস- কোরআন সব উপস্থাপন করেও লোকজনকে বোঝানো যেত না এটা সবার জন্য কতোটা জরুরী। কারও কারও স্বামীদের বারন, কারও হাতে খাওয়া বারন মানে ‘মায়া বরি’ যে মহিলা খায় সে অপয়া বা হারাম। আবার তাদের কারও কারও নাকি গিলতে সমস্যা হয়। আশরাফী আপা ভাষা হারিয়ে ভীষন রেগে যেতেন।
– আরে তোরা এক গামলা করে ভাত গিলিস তাতে গলায় আটকায় না আর সামান্য ছোট্ট একটা পিল গলায় আটকায়।
একজন কিছুতেই পিল খেতে পারছে না তাকে শিখিয়ে দিতে পানি নিয়ে আসা হলো। এবার প্রমান হবে খাওয়া কতোটা সহজ। কিন্তু কে খেয়ে দেখাবে? মহিলাদের মধ্য থেকে দুএকজন সাহসী ছিলো কিন্তু তারা অলরেডি আজকের পিল নিয়ে নিয়েছে।
কাউকে পাওয়া গেলো না অবশেষে আশরাফী আপা আমাকেই এক হুঙ্কার দিলেন-‘ আপনি খেয়ে দেখিয়ে দেন!’
কি বিপদ! বসের কথা আদেশসম। মানতে গিয়ে অকারণ পিল খেয়ে ফেললাম। ফিরতি পথে গাড়িতে বসে আশরাফী আপা আর আমি হাসিতে গড়াগডি।
-বাসায় ফিরে জানাস কি হয়। ( আমাকে এমনি সময় তুই করে বলতেন)। আমার আবার বাসায় ফিরে রীতিমতো বমি পেত।
-যাক তুই তাহলে মা হতে চলেছিস; তাও ব্যাচেলর মা।
বাঙ্গালীর অনেক বছর লেগেছিলো কনডম আর পিল খাওয়ানো- ব্যবহার শেখাতে। এখন জনগন মোটামুটি সচেতন কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে। জনসংখ্যায় দেশ সয়লাব হয়ে একাকার হবার পর!
করোনা কোন রোগই নয় এ ধারনার পরও শিক্ষিত নামের মূর্খ বিশেষজ্ঞরা টিকা আবিস্কার করেই ফেললো। এরপর টিকা নিয়ে নানা কুসংস্কার, হাদিস, ফতোয়া এবং জনভীতির শেষ ছিলো না। তবুও বোঝাতে হলো জনগনকে।
আমাদের আমেনা বুয়া টিকা দিয়ে এসে সেই কান্না “ আম্মা মাফ করি দেন, মুই আইজ রাইতেই মরি থাকিম”।
আমাকে অনুরোধ করলো তার কাফনের কাপড় কিনে দিতে। এখন কথা এতো ভয়ের পরও সে কেন টিকা নিলো?
সে জানালো, এলাকার মেম্বার তাদের নাকি বাধ্য করিয়েছে। হ্যাঁ, কথা সত্যি। অনেক বলে কয়েও যখন কাজ হচ্ছিলো না। তখন মেম্বার ঘোষনা দিয়েছে সামনে যে সরকারী বরাদ্দ আসবে টিকা না নিলে তাদের দেওয়া হবে না।
সুতরাং পেটের দায়ে সবাইকে তো ঝাঁপ দিতেই হবে। এমন হতে হতেই টিকার সচেতনতা বেড়েছে। ভোটকেন্দ্রের ভীর আমরা বহুবছর না দেখলেও, ভোটকেন্দ্রের মতো টিকা কেন্দ্রে ভীর দেখতে পাচ্ছি।
এমন সুখবরে বাঙ্গালী দূর্নীতিতেও ঝাপিয়ে পরেছে। টিকা নাকি টাকায় বিক্রি হয়। ৩/৪ হাজার টাকা দিলে সিরিয়ালসহ টিকা পাওয়া যাচ্ছে। আমরা শুধু নেতাদেরই সবসময় গালি দেই। আসলে শুধু নেতা নয়, বাঙ্গালীদের শিরায় শিরায় দূর্নীতি। সবসময় সুযোগ খুঁজে বেডায়। ওঁত পেতে থাকে।
এতোকিছুর ভেতরেও আমাদের সাবধান থাকতে হবে। এবং জানতে হবে এখন পর্যন্ত টিকা ফ্রি চলছে। সামনে কি হবে বলা যায় না। কারন টিকা নিয়ে একটা ব্যবসা যে হবে সেটা ভারত হঠাৎ করে টিকা বন্ধ করে দেওয়াটা একটা বড় উদাহরণ।
এখন যে হারে টিকা কার্যক্রম চলছে তাতে বেশ কয়েক বছর লেগে যাবে ৭০/৮০ ভাগ লোকের টিকা কমপ্লিট করতে। একটু সময় লাগুক তবুও আমরা অপেক্ষা করে টিকা দেই। তবে টিকাই শেষ কথা নয়, অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে।
আস্তেধীরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও খুলে যাচ্ছে। স্টুডেন্টরা মাস্ক পরে না এবং গাদাগাদী করে আড্ডায় ব্যস্ত। এটা অবশ্যই ক্ষতিকর। কারন অনেককেই দেখা গেছে ডাবল ডোজ গ্রহন করার পরও করোনায় আক্রান্ত হয়। তাই আমাদের সাবধান না হলে আবারও যে কোন সময় করোনা খারাপ আকার ধারন করতে পারে। তাই মাস্ক পরি, সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে তবেই নিশ্চিত থাকি। এবং মহামারী প্রতিরোধে দেশকে সহযোগীতা করি।
ছবি- নেটের
১৯টি মন্তব্য
আলমগীর সরকার লিটন
বেশ সচেতনামূলক পোষ্ট আপু অনেক শুভেচ্ছা রইল
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাই সময় করে পড়ার জন্য। ভালো থাকবেন।
ছাইরাছ হেলাল
আপনার মত নিবেদিত কর্মীরা আগে নেমে গেলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কুন ব্যাপার ই ছিল না!!
আর টিকা নিয়ে অনেক কাণ্ড হচ্ছে, ধর্মের দোহাই ও যোগ হয়েছে, টিকা না নেয়াতে।
রোকসানা খন্দকার রুকু
হ নিজেই খেয়ে শেষ করে ফালাইতাম এক্কেরে!!!
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা অশেষ।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপনি আফা মহান , দায়িত্ব শীল কর্মী। এমন কর্মী সর্বত্র দরকার যারা প্রয়োজন না হলেও নিজের কান কেটে অন্যকে শিক্ষা দিবে। আমরা বাঙ্গালী এমনি এক জাতি যারা খুইয়ে তারপর শিক্ষা নেয়। টিকা নিয়ে অনেক কিছুই হয়েছে প্রথম থেকেই, এখনো চলছে। ধন্যবাদ আপু 💓💓
রোকসানা খন্দকার রুকু
কি যে কন আফা প্র্যাকটিস আগে থেকে থাকা ভালো!! আমার উপকার সেতো আমিই বুঝতে আছি!!!
রেজওয়ানা কবির
হায়রে এন জিও আফা🥰এর সাথে প্রত্যক্ষ ৫ টা বছর জড়িত থেকে বাঙ্গালীর কি অবস্থা আর কি অসচেতনতা তা দেখে এসেছি। অনেক মজাদার অভিজ্ঞতা আমারও আছে। তোমার ব্যাচেলর,,,,,খাওয়া ভালোই ছিল,,, 🥰
আর হ্যা টিকা নিয়ে যা হচ্ছে তা আর নাই বলি,,,,
চরম বাস্তবতা তুলে ধরেছো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আপনার অভিজ্ঞতাগুলো ফটাফট লিখে ফেলুন। আমরা একটু হাসি।
ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
ছদ্ম আর বড়ি এই বানান দুটা আপাতত সম্পাদন করুন।
এই রকম কর্মীই দরকার। কেনো যে ছাড়লেন চাকরীটা।
মাস্ক মাস্ট। টিকা নিলেও
রোকসানা খন্দকার রুকু
হ সেটাই চাকুরীটা ছাড়া ভুল হইছে। মজা ছিলো বেশ। ধন্যবাদ।
হালিমা আক্তার
চমৎকার বিশ্লেষণমূলক পোস্ট। আমাদের দেশের সাধারণ জনগণ বুঝতে চায় না। তাদের বোঝালো যে কত কষ্ট, যারা ফিল্ডে কাজ করে তারাই বুঝতে পারে। সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে, আমরা সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। শুভ কামনা রইলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আসলেই এদের বুঝানো মুশকিল। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা অশেষ।
বোরহানুল ইসলাম লিটন
বাঙালী সবই বোঝে
তবে একটু দেরীতে নয়তো দেয়ালে পিঠ ঠেকলে।
সুন্দর সমসাময়িক উচ্চারণ।
আন্তরিক শুভ কামনা জানবেন সতত।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আপনার জন্যও ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইলো।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আপু লেখার শিরোনামটা দারুণ এবং এতে চরম সত্য প্রকাশিত হয়েছে। আসলেই — “বাঙ্গালীর অনেক বছর লেগেছিলো কনডম আর পিল খাওয়ানো- ব্যবহার শেখাতে। এখন জনগন মোটামুটি সচেতন কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে। জনসংখ্যায় দেশ সয়লাব হয়ে একাকার হবার পর”!
সুস্থ আর ভালো থাকবেন।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আপনিও সুস্থ থাকবেন। শুভ কামনা রইলো।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আপা শুভ কামনা রইলো।
সাবিনা ইয়াসমিন
আমরা (বাঙালি) অনেক কিছু দেরিতে বুঝি আবার অনেক কিছু শিগগিরই বুঝে যাই। বিশেষ করে কখন কার পাঁকা ধানে মই দিতে হবে সেটা কাউকে আগে থেকে বলা লাগে না।
টিকার জন্য অপেক্ষা করতেই আছি, আমার ভাগের টিকা ব্লাকে বিক্রি হয়ে গেছে কিনা আল্লাহই ভালো জানেন। পোস্ট পড়ে কিছুটা শংকায় আছি।
অন্যেকে বুঝাতে গিয়ে যেভাবে টপাটপ পিল গিলে ফেলেছেন তার জন্য আপনাকে সাহসী নারীর খেতাব দেয়া জরুরী হয়ে পড়েছে।
বাঙ্গালী জাতি খুবই কিউট, এটা কিন্তু প্রমাণিত 😉
রোকসানা খন্দকার রুকু
আর একটু অপেক্ষা করতে হবে টিকার জন্য উপায় নেই।
কতো কি করতে হয় কাউকে শেখাতে। খেতাব শিরোধার্য ম্যাম।
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা অশেষ।।