“বন্ধু তোরা পিঠে পুলির দাওয়াত নিবি চল্”।
শীত আসি আসি করছে। আর কদিন পরেই পিঠাপুলি খাওয়ার ধুম পড়ে যাবে। রাস্তায় মোড়ে মোড়ে দোকানীরা পিঠা বানাতে বসবে। এমন সময়ে গ্রামের রাস্তায় হালকা শীত শীত সকালে হাঁটতে বেড়িয়ে বেশ ভালো লাগলো। গ্রাম আর গ্রাম নেই। লোকজন সকালে উঠে চায়ে টোষ্ট ডুবিয়ে খেতে মোড়ের দোকানে মেতে উঠেছে। এখনকার বাড়িঘর গুলোও বেশ উন্নত, শহুরে স্টাইলে বানানো হচ্ছে। এটা ভালো শহরের উপর চাপটা কমে যাবে।
মনতো ভালো তাই ভাবলাম অনেক হল সিরিয়াস লেখালেখি। শীত শুরুর আমেজে চলুন একচোট হেসে নেয়া যাক-
আমরা পার হচ্ছিলাম স্কুল মোড় দিয়ে, যে স্কুলে আমি পড়েছি ম্যাট্রিক পর্যন্ত। স্কুলটির এখন বিরাট বড় বড় ভবন। অথচ আমরা যখন পড়তাম তখন পুরোনো ইটের জানালাবিহীন ঘর ছিল। ক্লাস ওয়ান টুতে বেন্চ ছিলনা তাই আমরা মাটিতে বসে ক্লাস করতাম। ক্লাসে আমি সবার চেয়ে মাংসবিহীন হওয়ায় প্রায়ই ঠান্ডা মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়তাম। বন্ধুরা খেলাধুলা শেষ করে আমাকে ডেকে তুললে বাড়ি ফিরতাম। আহা! আজ ভীষন মনে পরে গেল ওদের কথা। ঘুমন্ত আমাকে কখনো ফেলে আসেনি। কলেজের বন্ধুদের এতটা মিস করি না কেন যেন? শৈশব বলে কথা! অনেক মজা করতাম, ঝগড়া করতাম অথচ কেউ কাউকে ছাড়তাম না। আজ বন্ধুদের সাথে ঘটে যাওয়া হাসির ঘটনা লিখতে ইচ্ছে হল।
আমার বন্ধু মংগা(জাহাঙ্গীর আলম) গা ঘসঘসে ছেলেটি সরকারী হাইস্কুলের সিরিয়াস ম্যাথ টিচার। প্রায়ই ফেরার পথে আমরা যারা মেয়ে ছিলাম তাদের কুকুর লেলিয়ে দিত। আমরা প্রানপনে দৌড়ে পালাতাম। একদিন ওকে ধরে চুল ছিঁড়ে, কান মলে, বুকের উপর চড়ে বারোটা বাজিয়ে দিলাম। বেচারা হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেল। স্যারকেও বিচার দিলনা। ঠাকুরগাঁওয়ে থাকে দেখা হয়না অনেকদিন। বেশি হয়ে গিয়েছিল বন্ধু, সরি!!!
আবু তাহের (উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা)। কুড়িগ্রামে এসেই ওর দেখা। জোর করে বাড়িতে নিয়ে গেল। গিয়ে রীতিমত থ মেরে গেলাম। ওর বাড়ি তো নয় যেন কৃষি খামার প্রকল্প। ওর উৎসাহেই আমি গ্রামে অনেকগুলো জমি কিনে ফেললাম। মোটামুটি সবই লাগাই। আমাকে রীতিমত কৃষক বানিয়েই ছেড়েছে।
তো স্কুলে আমরা খেলাধুলা করতাম ছেলেমেয়ে একসাথে গোল্লাছুট, হাডুডু, মার্বেল, চেঙগু এসব। খেলতে খেলতে একদিন আবু তাহের এর সাথে আমার তুমুল ঝগড়া। এক পর্যায়ে আমি তাকে বা.. ছেঁড়া বলে গালি দিলাম। সে তখন কিছু না বলে হনহন করে চলে এসেছে। বাকিরাসহ খেলাধুলা শেষ করে গায়ে একগাদা মাটি কাদা নিয়ে ফিরছি। ছোট্ট রাস্তার মাথায় কাচি নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। কেন? বুঝতেই পারছেন,কাচি দিয়ে ….কাটবে তাই! কি বিপদ! কি করি। হঠাৎ দিলাম ভো দৌঁড়। আজও ভাবলে হাসি পায় তখন মাত্র সাত আট বছর বয়স। সেই বা কি বুঝে দাড়িয়েছিল আর আমিই বা কেন দৌড়ে পালিয়েছিলাম।
বান্ধবী নাজনীন বেলী অসম্ভব মেধাবী। ট্যালেন্ট পুলে বৃত্তি পেয়েছিল ফাইভে, এইটে। ম্যাট্রিক এ স্টার মার্কস্। কলেজে উঠে পালিয়ে গেল। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। সেই বেলীসহ আরও অনেকে স্কুলের পাশের বিরাট পুকুরে (পুরান দিঘি) চৈত্রের দুপুরের টিফিন পিরিয়ডে গোসল করতাম। বাড়ি থেকে ছোট্ট গামছা নিয়ে যেতাম। সেটা পরে , জামা প্যান্ট খুলে পুকুরে নেমে পড়তাম। সাঁতার প্রতিযোগিতায় বেলী বরাবর হেরে যেত। প্রতিশোধ নিতে হবে তাই আমার প্যান্ট চুরি করত। কি আর করা শুধু জামা পরেই ক্লাস। স্যার পড়া ধরেছে, দাড়িয়ে উত্তর দিচ্ছি আর সে পেছনে জামা তুলে দেখছে এবং দেখাচ্ছে। বোঝেন কি অবস্থা!
বান্ধবী মেরীনা, দুষ্টু একটা মেয়ে। মজা আর সাজা দুটোই তার কাজ।চনমনে মেয়েটির ম্যাট্রিক পাশ করেই বিয়ে হয়ে যায়। গতবছর বিধবাও হয়েছে। কষ্ট ছাড়া কিছুই করার নেই।
মজার মেয়েটি সবাইকে কলমের গুঁতা কাকে বলে বুঝিয়ে ছেড়েছে। স্যারের জবাব দিতে দাড়িয়েছি। সে সুন্দর করে কলমের মাথা খুলে দাড় করিয়ে রেখেছে পেছনে। যেই বসব একদম বরাবর কলমের মাথার উপর। বিকট চিৎকারের বদলে নিজের কষ্ট হজম করে ফেলাই ছিল একমাত্র উপায়। কারন স্যার টের পেলে আবার পিটুনি অবধারিত।
বন্ধু মিজানুর রহমান(জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক)। এখন ডক্টরেট করতে বাইরে আছে। হাইস্কুলে উঠে সে সবসময় বই নিয়ে থাকত। আমরা প্রায়ই তার বই চুরি করতাম। খুব কাঁদত আর নাক দিয়ে পানি বের হত। সেটা সে ঝেরে না ফেলে খেয়ে নিত। নাক ঝাড়ার সময় নাই বই ফেরত পাওয়াই তার কাছে মূখ্য। আমরা খেলতে ডাকলে শুধু বলত, বই দাও পড়ব। তারপর ফেরত দিলে ভীষন খুশী হত এবং ধন্যবাদ দিত। অতি ভদ্র ছেলে তাই সঠিক জায়গায় চলে গেছে। সরি বন্ধু, তোমার পথ অনুসরণ করা উচিত ছিল।
বন্ধু আতিক শাহ্( কুড়িগ্রাম কোর্টে উকিল)। সেভেনে উঠে আমাকে চিঠি লিখেছিল, তুমি যদি আমাকে ভালোবাস তোমাকে ঢুগঢুগির গান শোনাবো। আমি উত্তর না দেয়ায় রেগে গিয়ে মোটামুটি খারাপ গালি তার যত জানা ছিল সব দিয়ে চিঠি লিখেছিল। আমিও চিঠিটা রাগী ইংরেজি স্যারকে দিয়েছিলাম। আতিককে স্যার খুব মেরেছিল সেদিন। বেশ ক’দিন জ্বরে স্কুলে আসতে পারেনি। এখন দেখা হয় কথা হয়। খুব হিসেব করে কথা বলে। ঢুগঢুগি কি জানতে চাইলে শুধু হাসে।
বন্ধু আবু হাসেম বুলু( ম্যানেজার ডাচ্ বাংলা ব্যাংক)। আমরা একদল ছিলাম লুকিয়ে লুকিয়ে শাবনুর সালমান শাহের মুভি হলে গিয়ে দেখতাম। পরের দিন সে আমাদের সিনেমার গান শোনাতো। অসম্ভব সুন্দর গানের গলা। বাদাম বুট ভাজা হাত থেকে নিয়ে দিত দৌঁড়। নাইনে ওঠার পরে তার ভাবভঙ্গি বদলে যেতে শুরু করল। একদিন পিয়ন এসে আমায় চিঠি দিল। এতসুন্দর চিঠির ভাষা ছিল যে মুগ্ধতায় আমি কাউকেই বিচার দিতে পারিনি। অনেক সুন্দর সুন্দর ভাষার সেসব চিঠি আজও মিস্ করি। ম্যাট্রিকের পরে সে গেল রংপুর, তারপর চিটাগাং। আজ আর না বলি। তবে এসবে শুধুই মনে হয়, হায়! কৈশোর তুমি কত মজার ছিলে? তুমি এত ছোট ক্যানে!!!!
সবাই ভালো থাকুন। শুভ রাত্রি।
ছবি: সংগ্রহ।
২৬টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
ওরা তখন সত্যই ই বন্ধু ছিল বলে আজ বন্ধনহীনতায় ওদের কোথাই ভাবনায় আসে।
কৈশোর আসলেই অনেক ছোট, খুব ছোট একটি কাল।
রোকসানা খন্দকার রুকু
খুব আফসোস হয়। কেন ছোট?
শুভ কামনা ভাইয়া। ভালো থাকবেন।
রেজওয়ানা কবির
আপু বিশ্বাস কর,এই লেখা দেখে এত এত বেশী আবেগে আপ্লুত হলাম যে তোমাকে বোঝাতে পারব না,নিয়ে গেলে সেই পুরনো স্মৃতির পথে।ইশ!সত্যি অসাধারণ স্মৃতিচারন। বন্ধুরা যে যেখানে থাকুক,ভালো থাকুক।আমারও খুব লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে বন্ধুদের নিয়ে। পরে লিখব।তবে খুব মজার জীবন শৈশব
রোকসানা খন্দকার রুকু
লিখে ফেল তারাতারি। পড়তে ইচ্ছে করছে।
হাসি চাই কিন্তু। মনে হচ্ছে আমরা বেশি মজা করেছি।
কেউ কেন যেন হাসলনা। শুভ কামনা।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
স্কুল বন্ধুদের কথা মনে করিয়ে দিলেন যদিও গার্লস স্কুল এ পড়েছি তবুও পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ছেলেরা ছিল কিন্তু তাদের সাথে তেমন বন্ধুত্ব হয়নি , বান্ধবীদের সাথে ঝগড়া হয়েছে আবার মিল মহব্বত ও হয়েছে এখনও স্কুলের পাশ দিয়ে যাতায়াত করা হয় তখন খুব মনে পড়ে সেইসব দিনের কথা। খুব কড়াকড়ির মধ্যে থাকাতে দুষ্টামি তেমন করা হয়নি আর বাসার পাশেই স্কুল থাকাতে ভয় ও কাজ করতো। ভালো থাকুক বন্ধু-বান্ধব রা। আপনি ও ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন শুভ কামনা রইলো
রোকসানা খন্দকার রুকু
স্কুলের বন্ধুদের টান বেশি। ভালো থাকুক বন্ধুরা।
শুভ কামনা দিদিভাই।
আলমগীর সরকার লিটন
পড়তে পড়তে শ্রাবণ হয়ে গেলো
আপনি কত ব্যাচের ছাত্রী
মানে কত সানে এসএসসি পাশ করেছেন ———–
রোকসানা খন্দকার রুকু
ভাই মেয়েদের বয়স জানতে নেই। বুড়ো হয়েছি এটা ঠিক।
শ্রাবন আবার কেন ডাকছেন?
শুভ কামনা রইলো।
রেহানা বীথি
আহা, শীত আসছে ভাবতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে যাচ্ছে আপু। আমার শরীরেও মাংসের পরিমাণ ভীষণ কম ছিল, এখন বোঝা যায় না 😃
আপনার বন্ধুদের কথা জেনে মনে দোলা দিল। মনে পড়ে গেল নিজের সেইসব দিনের স্মৃতি।
ভীষণ সুন্দর লিখলেন আপু।
ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন সবসময়।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আপু মেয়েদের নিয়ে হাঁটতে বের হবেন। না হলে হিন্দি গানের সাথে উল্টাপাল্টা নাচবেন কমে যাবে। আমাদের ও বীথি আপু আছে তাই বললাম। কিছু মনে নিয়েন না।
শীত আমারও ভীষন পছন্দ।
অনেক অনেক ভালোবাসা ও শুভকামনা আপুনি। ভালো থাকবেন।
রেহানা বীথি
কিছু মনে করার প্রশ্নই আসে না আপু। মেদ ঝরিয়ে ঝরঝরে থাকার পরামর্শ তো উপকারের জন্যেই।
সুপায়ন বড়ুয়া
স্মৃতি কাতর হলাম
কৈশোরে ফিরে।
রম্য গল্পে শীত
গল্প ঘিরে।
শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
দাদা পুরোই রম্য। শুভ কামনা।
শামীম চৌধুরী
শীত ছুঁই ছুঁই
তার আগেই পিঠে পুলির দাওয়াত। এবার শীতটা জমবে ভাল।
রোকসানা খন্দকার রুকু
হুম শীত পছন্দের তাই ভাবতেই ভালো লাগছে।
শুভ কামনা রইলো ভাইয়া॥ শুভ সকাল।
আরজু মুক্তা
আপু কৈশোর বানান এটা হবে।
” বন্ধু, তোকে মিস করছি ভীষণ।” আপনার কাহিনী পড়ে এই গানটাই মনে হলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ আপুনি। বানানে খুব সমস্যা আমার।
ঠিক করে নিচ্ছি।
শুভ কামনা। শুভ সকাল।
ইসিয়াক
হায়! কৈশরের সেই দিনগুলি । সত্যি বারেবারে ডাকে সে সময়, জানি যদিও আর ফিরে আসবেনা কোনদিন। ভালো লাগলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ফিরে আসবেনা বলেই তো এত স্মৃতিমধুর॥।
শুভ কামনা। শুভ সকাল।
উর্বশী
কেন বড় হলে ছোট বেলার বন্ধুকাল হারিয়ে যায়।? যদিও ফিরে আসেনা তবুও স্মৃতিরা বড়ই মধুর।বারে বারে ডাকে কৈশোরের স্মৃতিরা। চোখ বন্ধ করে স্মৃতির জানালায় প্রবেশ করলাম। চমৎকার লিখেছেন, স্মৃতিচারণ শতভাগ ফুটে উঠেছে।
বেশ ভাল লাগলো। ভালোবাসা অফুরন্ত।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ভালো লাগলো জেনে খুশি হলাম। ভালো থাকবেন আপু।
শুভ কামনা।
সুরাইয়া পারভীন
হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেলো। কি সব দুর্দান্ত বন্ধু আর দুর্দান্ত তাদের কর্মকাণ্ড। আবু তাহের এটাতে বেশি মজা পেয়েছি।
সেই সাথে মেরীনা উনার কথা ভেবে কষ্টও হচ্ছে।
চমৎকার পোস্ট করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ
রোকসানা খন্দকার রুকু
পুরোটাই ভরপুর কমেডি। ফাইনালি একজনকে পেলাম যার হাসি পেল। বারবার খুঁজছিলাম কেউ কেন হাসছেন না।
কেন যেন মনে হচ্ছিল কেউ ভালো করে পড়েননি।
যা হোক শান্তি পেলাম। অনেক অনেক ধন্যবাদ ও ভালোবাসা আপুনি।
তৌহিদ
কৈশরের স্মৃতি ভোলা যায়না সহজে। রঙিন স্বপ্নে বিভোর বন্ধুদের সাথে কাটানো সেসব দিন যেন সুদূরপরাহত। আবারো যদি ফিরে পেতাম সেইসব দিন!
আপনার বন্ধুদের নিয়ে স্মৃতিচারণা পড়ে মুগ্ধ হকাম। ভালো থাকুন সবসময়।
শিরোনামটি পছন্দ হয়েছে।
তৌহিদ
দুঃখিত, মুগ্ধ হলাম।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আমিও আপনার মন্তব্য পেয়ে আপ্লুত হলাম ভাই।
শুভ কামনা রইলো॥