শেখরা মুক্তি পেল আর ওদের যাবজ্জীবন জেল হল। শেখরা মামলা থেকে বাঁচল, কিন্তু সর্বস্বান্ত হয়েই বাঁচল। ব্যবসা নাই, জমিদারি শেষ, সামান্য তালুক ও খাস জমি, শেখ বংশ বেঁচে রইল শুধু খাস জমির জন্য। এদের বেশ কিছু খাস জমি ছিল। আর বাড়ির আশপাশ দিয়ে কিছু জমি নিষ্কর ছিল। খেয়ে পরার কষ্ট ছিল না বলে বাড়িতে বসে আমার দাদার বাবারা পাশা খেলে দিন কাটাতেন। সকলেই দিনভর দাবা আর পাশা খেলতেন, খাওয়া ও শোয়া এই ছিল কাজ। এরা ফার্সি ভাষা জানতেন এবং বাংলা ভাষার উপরও দখল ছিল। রেণুর দাদা আমার দাদার চাচাতো ভাই, তিনি তাঁর জীবনী লিখে রেখে গিয়েছিলেন সুন্দর বাংলা ভাষায়। রেণুও তার কয়েকটা পাতা পেয়েছিল যখন তার দাদা সমস্ত সম্পত্তি রেণু ও তার বোনকে লিখে দিয়ে যান তখন। রেণুর বাবা মানে আমার শ্বশুর ও চাচা তাঁর বাবার সামনেই মারা যান। মুসলিম আইন অনুযায়ী রেণু তাঁর সম্পত্তি পায় না। রেণুর কোন চাচা না থাকার জন্য তার দাদা সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান। আমাদের বংশের অনেক ইতিহাস পাওয়া যেত যদি তাঁর জীবনীটা পেতাম। কিন্তু কে বা কারা সেটা গায়েব করেছে বলতে পারব না, কারণ অনেক কথা বের হয়ে যেতে পারে। রেণু অনেক খুঁজেছে, পায় নাই। এ রকম আরও অনেক ছোটখাট গল্প আছে, কতটা সত্য আর কতটা মিথ্যা বলতে পারি না।
যাহোক, শেখদের দুর্দিন আসলেও তারা ইংরেজদের সহ্য করতে পারত না। ইংরেজকে গ্রহণ করতে না পারায় এবং ইংরেজী না পড়ায় তারা অনেক পেছনে পড়ে গেল। মুসলমানদের সম্পত্তি ভাগ হয় অনেক বেশি। বংশ বাড়তে লাগল, সম্পত্তি ভাগ হতে শুরু করল, দিন দিন আর্থিক অবস্থাও খারাপের দিকে চলল। তবে বংশের মধ্যে দুই একজনের অবস্থা ভালই ছিল।
আমার দাদাদের আমল থেকে শেখ পরিবার ইংরেজি লেখাপড়া শুরু করল। আমার দাদার অবস্থা খুব ভাল ছিল না। কারণ দাদারা তিন ভাই ছিলেন, পরে আলাদা আলাদা হয়ে যান। আমার দাদার বড় ভাই খুব বিচক্ষণ লোক ছিলেন; তিনি দেশের বিচার-আচার করতেন। আমার দাদা হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন। আমার বড় চাচা এন্ট্রান্স পাশ করে মারা যান। আমার আব্বা তখন এন্ট্রান্স পড়েন। ছোট্ট ছোট্ট ভাইবোন নিয়ে আমার আব্বা মহাবিপদের সম্মুখীন হন। আমার দাদার বড় ভাইয়ের কোন ছেলে ছিল না। চার মেয়ে ছিল। আমার বাবার সাথে তাঁর ছোট মেয়ের বিবাহ দেন এবং সমস্ত সম্পত্তি আমার মাকে লিখে দেন।
আমার নানার নাম ছিল শেখ আব্দুল মজিদ। আমার দাদার নাম শেখ আবদুল হামিদ। আর ছোট দাদার নাম শেখ আবদুর রশিদ। তিনি পরে ইংরেজদের দেয়া ‘খান সাহেব’ উপাধি পান। জনসাধারণ তাঁকে ‘খান সাহেব’ বলেই জানতেন। আমার আব্বার অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলেও দুই চাচার লেখাপড়া, ফুফুদের বিবাহ সমস্ত কিছুই তাঁর মাথার উপর এসে পড়ল। বাধ্য হয়ে তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে চাকরির অন্বেষণে বের হলেন। মুসলমানদের তখনকার দিনে চাকরি পাওয়া খুবই দুষ্কর ছিল। শেষ পর্যন্ত দেওয়ানি আদালতে একটা চাকরি পান, পরে তিনি সেরেস্তোদার হয়েছিলেন। যেদিন আমি মেট্রিক পাস করে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যাই আমার আব্বাও সেইদিন পেনশন নিয়ে বাড়ি চলে যান।
একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, “তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।” রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধ হয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সাথেই রেণু বড় হয়। রেণুর বড় বোনেরও আমার আর এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিবাহ হয়। এরা আমার শ্বশুরবাড়িতে থাকল, কারণ আমার ও রেণুর বাড়ির দরকার নাই। রেণুদের ঘর আমাদের ঘর পাশাপাশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান। অন্যান্য ঘটনা আমার জীবনের ঘটনার মধ্যেই পাওয়া যাবে।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান।(পৃষ্ঠা নং-০৬ থেকে ০৮)
২৪টি মন্তব্য
শুভ্র রফিক
চমৎকার লাগল।জাতির জনকের অনেক না জানা তথ্য জানতে পারলাম
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ। জানুন এবং সবাইকে জানার সুযোগ করে দিন।
মিথুন
কত চমৎকার সব ইতিহাস লুকিয়ে আছে। জাতির জনক কে কাছ থেকে জানবার একটি দলিল এটি। আগেরগুলোও পড়ে এলাম আপু খুঁজে খুঁজে। এখানে লিঙ্ক দিয়ে দেয়া যায়না আপু?
ভাল একটি পদক্ষেপের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ …..
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হ্যাঁ, দেয়া যায়। আগেরগুলো দিয়েছিও। আজকের পোস্টটা নির্ধারিত সময়ে দেয়ার কথা ছিলো বলে তাড়াহুড়ো করে দিয়েছি।
অনেক ধন্যবাদ খুঁজে খুঁজে পড়ার জন্য। আমার পদক্ষেপটির সার্থকতা এখানেই। দিয়ে দেবো লিঙ্ক।
তানজির খান
বঙ্গবন্ধুর আত্নজীবনী পড়ছি আর অবাক হচ্ছি। কি সহজ সরল জীবন, কত না বেদনায় মোড়া জীবন।
আপনাকে বারবার ধন্যবাদ দিতে হয় এত কিছু সহজভাবে জানানোর জন্য। শুভকামনা রইল।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ আপনাকেও পাশে থাকার জন্য।
হ্যাঁ, শুভকামনাই দরকার যাতে ধৈর্যচ্যুতি না ঘটে। (y)
শুন্য শুন্যালয়
বাল্যবিবাহের ব্যাপারটা ভাবলে কেমন অবাক লাগে!! কত সহজ ভাবে তারা বাবা-মা দের ইচ্ছেকে সম্মান দিত। সময়ে কত্তো কিছু পালটে যায়। ভাবতেই কেমন লাগে এই পাহাড়সম মানুষটার জীবন কতো সহজ, যেন আমাদেরই পরিবারের একজন।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হুম, সম্ভবত তিনি এভাবেই পরিবারের একজন হয়েই সবাইকে একই পরিবারভুক্ত করেছিলেন।
ছাইরাছ হেলাল
জীবনের এই সহজতা আমরা কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছি।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ঠিক তাই। সহজ-সরল জীবনের ধারা কেমন যেনো বিলুপ্ত হতে চলেছে।
অনিকেত নন্দিনী
কী সহজ সরল জীবন!
বাবাকে তার চাচা ডেকে তাঁর নাতনিকে পুত্রবধূ করতে বললেন আর তিনি রাজি হয়ে গেলেন। কোথায় হারিয়ে গেছে সেসব দিন! 🙁
অনেক কিছুই জানছি এই ধারাবাহিকের সুবাদে। ধন্যবাদ আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ আপু, আপনাদের আগ্রহ আমার অনুপ্রেরণা। ভালো লাগছে। -{@
অনিকেত নন্দিনী
এগিয়ে যান, সাথেই আছি। 🙂
মারজানা ফেরদৌস রুবা
-{@
মোঃ মজিবর রহমান
অকপটে সব সহজ সরল ভাষায়
খুব ভাল লেগেছে আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হ্যাঁ, পড়তে থাকুন, আরোও আপ্লুত হবেন।
ব্লগার সজীব
আমাদের সহজ সরল পরিবারেরই একটি ইতিহাস যেন পড়ছি। কত সাধারন একটি পরিবার থেকে উঠে এসেছেন আমাদের জাতির জনক। কোন লুকোছাপা নেই, কোন ভাব নেই লেখার মাঝে।
আপু আপনাকে ধন্যবাদ কষ্ট করে লিখছেন বলে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ, অনুপ্রেরণা যোগানোর জন্য।
জিসান শা ইকরাম
পড়ছি আর ভাবছি বঙ্গবন্ধু কত সহজ সাধারন পরিবার হতে এসেছেন।
পরিশ্রম করে বই দেখে লিখে পোষ্ট দিচ্ছেন,
কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
শুভ কামনা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
কষ্ট করে দিলেও যতো বেশি পাঠকের কাছে পৌছাবে ততো আমার কষ্ট সার্থকতা পাবে।
আপনাদের শুভ কামনা প্রকাশই আমার এই কর্মযজ্ঞটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।
অরুনি মায়া
ধন্যবাদ আপু, ইতিহাসের পাতা থেকে আরও কিছু তথ্য জানতে সাহায্য করবার জন্য |
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ভালো লাগছে.. (y)
লীলাবতী
আপু আপনার মাধ্যমে বইটি পড়ছি। বইটি আসলে সংগ্রহে রাখতে হবে। ধন্যবাদ আপনাকে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আমার আনন্দ! ধন্যবাদ অনেক।