সবেমাত্র অষ্টম শ্রেণীতে উঠেছে রঘু। তবে বয়সের তুলনায় তা একটু কম। অবশ্য শরীরটা বেশ নাদুস নুদুস। বয়স আর শরীরের তুলনায় বুদ্ধিটা তেমন পাকে নাই। তাই মাঝে মধ্যেই হুটহাট করে একেকটা আজগুবি কাজ করে বসে সে। যতবারই সে নিজেকে জ্ঞানী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়েছে প্রায় প্রতিবারই ভাগ্য তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এজন্য পুরোপুরি সে একাই দায়ী নয়। এক্ষেত্রে তার সহযোগী ফন্টুও কম দায়ী নয়।
ফন্টুর শরীর স্বাস্থ্য রঘুর মত নাদুস নুদুস নয়। অবশ্য বয়সটাও দুই তিন বছর কম। তবে বুদ্ধি যথেষ্ট তীক্ষ্ণ।সেটা অবশ্য রঘুর তুলনায়। কিন্তু যতই সে জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব দেখাক না কেন, আসলে সে অত জ্ঞানী নয়। তবে ছেলেটাকে আধা জ্ঞানী বলা যেতে পারে। কেউ কেউ তাকে জ্ঞানবাবু বলে ডাকে। ওর অবশ্য আরেকটা বদ অভ্যাস রয়েছে। নিজেকে জ্ঞানী হিসাবে জাহির করা। একে ওকে জ্ঞান দিয়ে বেড়ানো ওর নেশা। এজন্য বিদ্যালয়ের প্রায় সবাই ওকে বুদ্ধিজীবী বলে ডাকে। তবে একথা সত্য ওর মত কোতুহলী মন আসলেই জ্ঞানী হওয়ার জন্য খুব দরকারী।
ফন্টু প্রচুর বই পড়ে।বিভিন্ন বই পড়ে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশী শেখে সে। যা শেখে সেগুলো আবার নিজের পাণ্ডিত্য প্রকাশের জন্য অন্যদের কাছে প্রয়োগ করে দেখাতে যায়। বেশ কিছুদিন হল রঘুও ফন্টুর মত বই পড়া শুরু করেছে। কয়দিন আগে বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে প্রখ্যাত লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের “গাব্বু”বইটি নিয়ে এসেছিল। ফন্টু আর রঘু দুইজনই বইটি পড়েছে। বইটি পড়ে তারা অনেক কিছুই শিখেছে। এখন আরও দুটি বই নিয়ে এসেছে। তাই নতুন নতুন নতুন কত কিছু শিখছে ওরা।
গতকাল বিদ্যালয়ে ওরা খুব হাততালি পেয়েছে।সবার মুখে মুখে সে কি প্রসংশা! দুজনের যাদু দেখে সবাই মুগ্ধ। একে একে বেশ কটি যাদু দেখালো রঘু আর ফন্টু। ফন্টুর একটু সম্মোহনী ক্ষমতা বেশী। তাই সেই প্রথম শুরু করলো। একটা চিরুনীকে মাথায় বেশ কয়েকবার আঁচড় দিয়ে কয়েক টুকরো কাগজের সামনে ধরছে। আর অমনি কাগজগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে চিরুনির উপর এসে গেঁথে যাচ্ছে। আবার একটু খানিক পরই যেই সে বলছে সরে যা, অমনি সব একে একে ঝরে যাচ্ছে। সবাই তাজ্জব হয়ে দেখছে আর তালি দিচ্ছে। কিন্তু রবিন স্যার ঠিকই জানে আসল কাহিনীটা কি। তাই সে মিটমিট করে হাসছে আর অন্যদের সাথে তালি দিয়ে যাচ্ছে। আসলে এটা তেমন কোন যাদু নয়। প্রকৃতপক্ষে চিরুনিকে মাথার চুলের সাথে ঘষার কারনে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে। একে ঘর্ষ বিদ্যুৎ বলে। যাহোক চিরুনির ম্যাজিকের পর পানি ম্যাজিক শুরু হল। ফন্টু একটা গ্লাস পানি দিয়ে ভর্তি করে নিল। এরপর একটা পাতলা কাগজ দিয়ে গ্লাসের মুখটা ঢেকে দিল। এবার গ্লাসটা উপুড় করে আস্তে আস্তে চারপাশ ঘুরতে লাগলো। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে গ্লাস থেকে কোন পানি পড়লো না। সবাই উচ্চস্বরে বাহবা ও তালি দিতে লাগলো। কিন্তু রবিন স্যার ঠিকই মিটমিট করে হাসলো। কারণ এটাও কোন ম্যাজিক নয়। মুলত বায়ুর চাপই এভাবে পানিকে ধরে রাখে। কিন্তু সবাই তো আর ওদের মত বই পড়েনা, তাই অনেক কিছুই জানতেও পারেনা। যাহোক এভাবেই রঘু আর ফন্টু বেশ কিছু যাদু দেখিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করল এবং প্রচুর হাততালি ও প্রশংসা নিয়ে বাড়ি ফিরলো সেদিন।
দুইদিন ছুটির পর আবার বিদ্যালয় খুলেছে। রঘু আর ফন্টু ভিতরে ঢুকতেই রবিন স্যার ওদের ডাকলো। দুজনকে জিজ্ঞেস করলো “সাঁতার জানো?”
কিন্তু দুজন দুইরকম উত্তর দিল। কারণ ফন্টু সাঁতার জানলেও রঘু জানেনা। রবিন স্যার বলল শোনো রঘু আমাদের সবার উচিত সাঁতার শেখা। কারণ কখন কোন বিপদ আসে তা তো বলা যায় না। তাছাড়া সাঁতার শেখা খুব কঠিন কিছুনা। কাল তোমরা গ্লাসে পানির যে ম্যাজিক দেখালে সেটা আসলে বায়ুর চাপ। বায়ুর যেমন চাপ আছে, পানিরও তেমন চাপ আছে। যেখানে পানির গভীরতা যত বেশী সেখানে পানির চাপ তত বেশী। পানির উপরে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে নীচের দিকে চাপ প্রয়োগ করলে সাঁতার শেখা যায়। এক্ষেত্রে কোন টিউব বা কলাগাছ বা শুকনো কাঠের সাহায্য নেয়া যায়। যত তাড়াতাড়ি সাঁতার শিখে নিতে পারো ততই ভাল।
রবিন স্যারের পরামর্শ রঘুকে খুব উজ্জিবিত করেছে। তাই সাঁতার শেখার জন্য সে উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছে। বাবাকে বলে সে একটা টিউব নিয়ে এসেছে। আজই তার সাঁতার শেখা চাই। ফন্টুকে সকাল সকাল ডেকে নিয়ে গেছে গ্রামের বড় পুকুরে। প্রথম প্রথম সাঁতার শিখতে সে খুব মজা পাচ্ছে। ফন্টু তাদের শরীরচর্চার শিক্ষকের মত সাঁতারের বিভিন্ন কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছে। রঘু বুকের নীচে টিউব দিয়ে সাঁতরাতে খুব মজা পাচ্ছে। গাঁয়ের অন্যান্য বন্ধুরাও দেখতে এসেছে। তারাও খুব মজা পাচ্ছে। মাঝে মধ্যে হাতে তালি দিয়ে উতসাহ দিচ্ছে। রঘু একবার একটু বেশী পানিতে আর একবার কম পানিতে যাচ্ছে আর ফিরে আসছে। কুলের দিকে এসে মাঝে মধ্যে টিউব ছাড়াই সাঁতরানোর চেষ্টা করছে। একপর্যায়ে সে বুঝে ফেলে যে সে প্রায় সাঁতার শিখে ফেলেছে। কিন্তু অনেকক্ষণ এই প্রক্রিয়ায় থাকায় সে বেশ ক্লান্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু সহজে সে ছাড়বার পাত্র নয়। তাই সে আবার এগিয়ে যায় বেশী পানির দিকে। হঠাৎ তার রবিন স্যারের কথা মনে পড়ে। স্যার বলেছিল গভীর পানিতে চাপ বেশী থাকে। তাই সাঁতার দেয়াটাও সোজা। এই কথা মনে হতেই রঘু টিউব ছেড়ে সাঁতরানোর চেষ্টা করে। অমনি ক্লান্ত রঘু খেই হারিয়ে ফেলে।মুহুর্তেই হাবুডুবু খেতে থাকে রঘু। তীরে দাঁড়িয়ে চিৎকার চেচামেচি শুরু করে বন্ধুরা। গ্রামের লোকজন ছুটে আসে পুকুরপাড়ে। দুই তিনজন ঝপাঝপ ঝাপ দিয়ে তুলে আনে রঘুকে। কিন্তু ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে রঘু।ফন্টুও তখন ভয়ে কাঁপছে। কিন্তু রঘুকে বাঁচাতে হবে। কেউ একজন রঘুর দুই পা ধরে শুন্যে কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে পেটে চাপ দিতে লাগলো। অমনি মুখ দিয়ে পানি বেরোতে লাগলো। এভাবে কয়কবার করার পর মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ এরকম করার পরই নড়ে উঠলো রঘু। তারপর আস্তে আস্তে চোখ মেলল।অল্পক্ষণেই আবার উঠে দাঁড়ালো রঘু। তখনও ভয়ে কাঁপছে ফন্টু। রঘু তার দিকে তাকিয়ে বললো
-কি রে ফন্টু কাঁপছিস কেন? ভয় পাবার কিছু নেই। যদিও আজ পানি একটু বেশী খেয়ে ফেলেছি,কিন্তু সাঁতার ঠিকই শিখে ফেলেছি। চল আর একটা সাঁতার দিয়েই বাড়ি চলে যাবো।
রঘুর কথা শুনে চারিদিকে হাসির রোল পড়ে গেল। কিন্তু ফন্টু তখনও কাঁপছে। মৃদু কণ্ঠে বলছে
-অতিরিক্ত কোনকিছুই ভাল নয়। আজ আর নয়।প্রয়োজনে অন্যদিন আসা যাবে। বেঁচে থাকলে কত সুযোগ পাওয়া যাবে। বলতে বলতে দুজন বাড়ি ফেরার পথ ধরলো।
২০টি মন্তব্য
রেহানা বীথি
ঠিক তাই। বেঁচে থাকাটাই জরুরি। যেকোনও সুযোগ হয়তো আবারও আসবে, কিন্তু প্রাণ হারালে আর ফিরে আসবে না। আর একথাটা এই সময়ে আমাদের দেশের মানুষের বোঝা উচিত ভালো করে। যে হারে প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে সবাই ঈদশপিং-এ নেমেছে!
শিক্ষণীয় গল্পটি চমৎকার লাগলো।
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ আপু, সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
বিজ্ঞানের সবচেয়ে কমন দুটি পরীক্ষা দিয়ে ম্যাজিক দেখালেন। আজো পানি দেখলে ভয় পাই, সাঁতার শেখা তো দূরের কথা। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। জীবন আগে। ধন্যবাদ আপনাকে
হালিম নজরুল
সাঁতার শেখা উচিৎ, হা হা হা
সুপর্ণা ফাল্গুনী
মাপ চাই দোয়াও চাই। ওটা আর সম্ভব নয়
ফয়জুল মহী
বেশ মন ছুঁয়ে গেল লেখা। ভালোবাসা ও শুভ কামনা।
হালিম নজরুল
শুভকামনা রইল ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
এক দম ঠিক বলেছেন, সীমিত ভাবেই সব কিছু করা উচিৎ!
হালিম নজরুল
আপনার জন্য সীমিত ভালবাসা বরাদ্দ রইল।
তৌহিদ
সময় চলে গেলে আর ফিরে আসেনা। নিজের ভালো পাগলও বোঝে, বুঝিনা শুধু আমরা।
শিক্ষণীয় গল্প ভালো লাগলো ভাই।
হালিম নজরুল
শুভকামনা ও ভালবাসা রইল ভাই।
আরজু মুক্তা
বেঁচে থাকলে সব হবে।
আমরা কেনো এটা বুঝিনা
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
ইঞ্জা
শিক্ষণীয় গল্প, প্রতিটি ঘটনায় আলাদা ভাবে শিক্ষণীয়, ফন্টুর কথাটায় ঠিক, বেঁচে থাকলে অনেক সুযোগ পাওয়া যাবে।
হালিম নজরুল
ভালবাসা ও শুভেচ্ছা রইল ভাই।
ইঞ্জা
শুভেচ্ছা ও শুভকামনা, সাথে ভালোবাসা ভাই। ❤
মাহবুবুল আলম
দারুণ শিক্ষামূলক গল্প।
শুভেচ্ছা জানবেন।
হালিম নজরুল
অন্তহীন শুভকামনা রইল ভাই।
সুপায়ন বড়ুয়া
গল্পটা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
ভাল থাকবেন। শুভ কামনা।
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ প্রিয় দাদা।