
আমার প্রথম ইটালি ভ্রমণের সময়কার কথা, সময় ১৯৯২ সাল, বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে করে প্রথমে যায় লন্ডন, সেইখানে চাচার বাসায় ছিলাম চার দিনের মতো, এরপর রওনা হয়ে যায় ইটালির রোমে, সেইখান থেকে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে ফ্লাইট ধরে ফ্লোরেন্স শহরে চলে এলাম, এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি চেক শেষ করে যখন বেরিয়ে এলাম তখন খেয়াল করলাম আমার নাম লেখা কার্ড ধরে দাঁড়িয়ে আছেন এক ভদ্রলোক, আমি পরিচয় দিতেই উনি আমার সাথে হ্যান্ডশেইক করে পরিচয় দিলেন, উনি এসেছেন বিখ্যাত পিয়াজিও গ্রুপ যাকে সবাই চিনে পিয়াজিও ভি ই ইটালি নামে, পিয়াজিওর আমার আব্বার পরবর্তী আমি ছিলাম বাংলাদেশের ডিলার, সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশকে আমার আব্বাই প্রথম তিন চাকার গাড়ীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এই পিয়াজিওর তিন চাকার বেবি টেক্সি যার রুপান্তর বর্তমানের সিএনজি।
আমরা এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে গাড়িতে করে সোজা চলে এলাম পন্টেডেরা দ্যা পিয়াজিও সিটিতে, পিয়াজিও এক বিশাল গ্রুপের ক্ষুদ্র একটি অংশ, পিয়াজিওর ম্যানেজমেন্ট আসলে আলফা রোমিও, ফিয়াট এবং ফেরারি গাড়ি প্রস্তুত করে এই সিটিতে, যদিও কখনো এই গ্রুপ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এই পন্টেডেরা সিটি সম্পূর্ণ ভূতুরে শহরে পরিণত হবে।
এদের এক একটি ফ্যাক্টরি এতো বিশাল যে, একটি থেকে আরেকটিতে যাওয়ার জন্য এরা চপার (ছোট হেলিকপ্টার) ব্যবহার করে।
আমি যখন পিয়াজিওর হেড অফিসে পোঁছুলাম তখন প্রায় লাঞ্চের সময় হয়ে আসছে, আমাকে ওয়েটিংরুমে বসিয়ে ভদ্রলোক বললো, অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের ডিরেকটর আসবেন তোমার সাথে দেখা করার জন্য। উনি চলে গেলে কিছু সময়ের মধ্যেই ডিরেক্টর ভদ্রলোক এলেন, এইখানকার ডিরেক্টর মানে উচ্চ পদের অফিসার (জিএম) লেবেলের।
উনার সাথে যেহেতু আগে থেকেই টেলেক্সের মাধ্যমে যোগাযোগ ছিলো (তখন ইন্টারনেট ফ্যাক্স ছিলোনা) বিধায় উনি আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন, কিছু সময় সৌজন্য কথাবার্তার পর উনি আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন লাঞ্চ করার জন্য, আমরা পিয়াজিওর ক্যান্টিনে গেলাম লাঞ্চ করার জন্য, সেইখানে আমি ল্যাম্ব রোস্ট আর ভেজিটেবল, সাথে ডিনার রোল (এক ধরণের ছোট বনরুটি) নিলাম।
লাঞ্চ শেষে উনি আমাকে বললেন, তুমি আজকে হোটেলে ফিরে যাও, রেস্ট করো, আমি সন্ধ্যায় আসবো তোমাকে নিয়ে বেরুবো।
আমি সায় দিলে উনি অন্য আরেকজন অফিসারকে দিয়ে আমার জন্য রিজার্ভেশন দেওয়া হোটেলে পাঠিয়ে দিলেন।
আমি রুমে গিয়ে গোসল সেরে দিলাম ঘুম, সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ঘুম ভাঙ্গলো ফোনের শব্দে, ডিরেক্টর ভদ্রলোক ফোন দিয়ে বললেন আমাকে রেডি থাকতে, আধা ঘন্টার মধ্যে উনি আসবেন।
আমি দ্রুত রেডি হয়ে নিলাম, উনি আমাকে বললেন, পিসার হেলানো টাওয়ার দেখবো কিনা, আমি রাজি হয়ে গেলাম, আমাদের গাড়ি ছুটে চললো ফ্লোরেন্স শহরের উদ্দেশ্যে, ওখানেই আছে পিসার হেলানো টাওয়ার, এইখান থেকেই আমার আব্বা পাঠিয়েছিলেন পিসার ছবি, দেখে অবাক হয়েছিলাম টাওয়ারটা বাঁকা হয়ে থাকতে।
আমরা পিসার সামনে পোঁছালে গাড়ি পার্ক করে হেটে এগুলাম, সামনে থেকে ডিরেকটর ভদ্রলোক টিকেট কাটলেন, টিকেট দেখিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম, আসলে এইটি ক্যাথেড্রাল এলাকা, ক্যাথেড্রালের ঘন্টা লাগানোর জন্যই এই টাওয়ার বানানো হয়।
ধীরেধীরে এগিয়ে গেলাম পিসা টাওয়ারের দিকে, এই টাওয়ারটি ঘণ্টা বাজানোর উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছিল আগেই বলেছি, নির্মাণের শুরু থেকে আস্তে আস্তে এই মিনারটি ক্রমশ একপাশে হেলতে থাকে, বলে রাখা ভালো, এই পিসা শহরে অনেক অবকাঠামো আছে, যেগুলো একপাশে হেলে পড়েছে, এই পিসা মিনারটি ৩.৯৯ ডিগ্রী কোণে হেলে আছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা এটি ওয়াচ-টাওয়ার হিসেবে ব্যবহার করত।
মার্কিন এক সেনা কর্মকর্তা এই মিনারের শৈল্পিক দক্ষতা এবং এই চত্বরে অবস্থিত ক্যাথেড্রালের সৌন্দর্য দেখে এতই অভিহিত হন যে, তিনি সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করতে নিষেধ করেন, এভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিশ্চিত ধ্বংসের মুখোমুখি হতে রক্ষা পায় ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্থান পাওয়া জায়গাটি।
আমি দূর থেকেই টাওয়ারটি দেখে অবাক হলাম, এইটি যেন এই মূহুর্তেই হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে, হাতে থাকা ততকালীন রিল যুক্ত ক্যামেরা দিয়ে টপাটপ কয়েকটা ছবি তুললাম, এরপর এগিয়ে যেতে লাগলাম, আটতলা উঁচু টাওয়ারের চারিদিকে লোহার ঘের দিয়ে রাখা হয়েছে, সকালে এলে টিকেট কেটে টাওয়ারের উপরে উঠা যায় কিন্তু আমি ভুলেও উঠতে রাজি না, যদি এইটি আমাকে শুদ্ধ ভেঙ্গে পড়ে?
আমই যতই ওর কাছাকাছি হচ্ছি ততই ভয়ংকর লাগছে এর কাঠামোটি, আমি ডিরেক্টর ভদ্রলোককে বললাম, এতো ভয়ংকর, এইটা যদি ভেঙ্গে যায়?
উনি হেসে বললেন, এউটি যেন ভেঙ্গে না পড়ে তাই সরকার টাওয়ারের চারিপাশে ঢালাই করে দিয়েছে, এই পিসার টাওয়ার আগামী দুইশো বছরেও আর ভেঙ্গে পড়বেনা যদিনা ভয়ানক কোনো দূর্যোগ না হয়, উনি আরও সামনে এগুতে চাইলে আমি ভয়ে ভয়ে তাকালাম টাওয়ারের দিকে, উনি আমার ভয়ার্ত চোখ দেখে নিজে একটা হাত বাড়িয়ে ধরে আমার হাত ধরে সামনে এগিয়ে গেলেন, আমাকে টাওয়ারের সামনে রেখে কতেকটা ছবি তুলে দিলেন।
এইখানে দেখা এবং বেরানোর পর্ব শেষ করে উনি আমাকে নিয়ে চললেন ডিনারে, আমি এই ফ্লোরেন্স এবং পন্টেডেরা শহরে কয়েকদিন থেকেই রওনা হলাম আমার পরবর্তী গন্তব্য মিলান শহর, ওখানে যেতে গাড়িতে প্রায় তিন ঘন্টা লাগে, তাই আমি দ্রুত যাওয়ার জন্য ট্রেনে করেই গেলাম।
সমাপ্ত।
ছবিঃ গুগল।
জনস্বার্থেঃ
৩০টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ভাইয়া মুগ্ধ হয়ে গেলাম। যেমন বর্ণনা তেমন ছবি । আপনার বাবাকে প্রথম তিন চাকার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য বিনম্র শ্রদ্ধা। ঈশ্বর সহায় হোন সবার। তিনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। এমন আরো ভ্রমণকাহিনী চাই। ভালো থাকবেন শুভ কামনা রইলো
ইঞ্জা
আপু আপনার চাইতেও আমি বেশি মোহিত হয়েছিলাম এবং এখনো মোহিত আছি পিসার টাওয়ার দেখে, এমনিতে ঐতিহাসিক স্থাপত্য আমাকে টানেনা, কিন্তু ইটালির প্রচুর স্থাপত্য শিল্প আমাকে আজীবন মোহিত করে রেখেছে।
বাবার জন্য প্রার্থনার দরখাস্ত রইলো।
অবিরত ধন্যবাদ আপু।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
কি বলেন ঐতিহাসিক স্থাপত্য টানেনা! আমার তো অন্যরকম লাগে এগুলো দেখলে। সেসময়ের মানুষদের কথা ভাবি,ওদের চালচলন, ওদের আচার আচরণ ভেবে নস্টালজিক হয়ে যাই । ওনারা নেই কিন্তু ওনাদের সব কিছু আমরা দেখতে পাচ্ছি ভাবতেই শিহরিত হই। ইটালি তো এসব স্থাপত্যের জন্যই বিখ্যাত
ইঞ্জা
তা সত্য বলেছেন আপু, কিন্তু ইতিহাসের দূর্বল ছাত্র হিসাবেই টানেনা হয়ত আমাকে, অবশ্যই প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস অসাধারণ, বিশেষ করে ওদের স্থাপত্যকলা অনবদ্য।
আরজু মুক্তা
মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। ভালো লাগা রেখে গেলাম
ইঞ্জা
আপু আমি তো সামনাসামনি দেখে এখনো মুগ্ধ হয়ে আছি।
ধন্যবাদ অহর্নিশ।
ছাইরাছ হেলাল
সুন্দর বর্ণনায় হেলানো টাওয়ার আমরা দেখলাম
আপনার চোখে।
ইঞ্জা
ভাইজান, সত্যি এ অবাক করা শিল্প, ইটালির স্থাপত্য শিল্প সত্যি অনবদ্য।
অসংখ্য ধন্যবাদ।
নিতাই বাবু
ছবি দেখে আমারও ভয় হচ্ছে, দাদা। মনে হয় ভেঙে পড়বে মুহূর্তেই! আপনি এই টাওয়ারে উঠেনি জেনে খুশি হলাম। উঠলেই বিপদ হতো দাদা।
পোস্টের লেখা পড়ে অনেককিছু জানা হলো। শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয় দাদা।
ইঞ্জা
না দাদা, এই টাওয়ারে হাজার হাজার মানুষ উঠে প্রতিমাসে, আমি একার জন্য পড়বেনা কিন্তু দেখতে ভয়ংকর।
নিরন্তর ধন্যবাদ দাদা।
কামাল উদ্দিন
এসব দেখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু দেখা হবে কিনা কে জানে? মার্কিন সেই সেনা কর্মকর্তাকে ধন্যবাদ পোড়া মাটি নীতি গ্রহণ না করার জন্য।
ইঞ্জা
ভাই এইসব দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে ব্যবসায়িক এবং পড়াশুনার কল্যানে, আমি ইটালিতেই ইঞ্জিনিয়ারিং করেছি।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
উপভোগ্য সুন্দর ভ্রমণ কাহিনী। অনেককিছু জানা গেল। ধন্যবাদ অশেষ।
ইঞ্জা
আনন্দিত হলাম, অশেষ ধন্যবাদ ভাই।
তৌহিদ
ছবি দেখে মুগ্ধ হলাম ভাই। পিসার হেলানো টাওয়ারের রুপ অসাধারণ। আজ আপনার লেখায় অনেকদিন পরে ভ্রমণ স্বাদ পেলাম। আপনার ভ্রমণগল্পের বড় ফ্যান কিন্তু আমি।
ভালো থাকুন দাদা।
ইঞ্জা
ভালোবাসা জানবেন ভাই, সত্যি বলতে কি, আমি যা ভ্রমণ করেছি তার প্রায় সবই ব্যবসায়িক কারণে, ফলশ্রুতিতে ঘুরে বেড়ানো হয় না, যদি ঘুরে বেড়াতাম তাহলে প্রায় সময়ই দেখতেন ভ্রমণ কাহিনীতে ভরপুর থাকতো আমার ব্লগ।
হালিম নজরুল
এমন সুন্দর পোস্টের জন্য ধন্যবাদ দিতেই হচ্ছে।
ইঞ্জা
নিরন্তর ধন্যবাদ ভাই, আপ্লুত হলাম।
প্রদীপ চক্রবর্তী
আহারে
এসব দেখতে খুবি মন চায় দাদা।
পিসার হেলানো টাওয়ারের রুপ অসাধারণ।
আপনার ভ্রমণকাহিনী আমি প্রথম পড়লাম পূর্বে হয়তো এমন লেখা আরও লিখেছেন?
সত্যিই খুবি ভালো লাগলো দাদা।
এমন ভ্রমণকাহিনী নিয়ে লেখা আরও চাই দাদা।
ইঞ্জা
দাদা, ভ্রমণ কাহিনী পড়তে চাইলে আমার ব্লগ পেইজে প্রচুর পাবেন, ইটালি ভ্রমণের তো কয়েক পর্বই আছে, আছে তাজমহল, চায়না নিয়ে বেশ কিছু ধারাবাহিক।
ধন্যবাদ অবিরত দাদা।
মাহবুবুল আলম
ইঞ্জা ভাই!
আপনার এ ভ্রমণকাহিনি পড়ে অনেক সমৃদ্ধ হলাম।
অনেক অনেক ভাল লাগলো লেখাট।
শুভেচ্ছা রইল।
ইঞ্জা
আন্তরিক ধন্যবাদ ভাই, ব্যবসায়িক কারণে আমি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছি, তাই ভ্রমণের কিছু স্বাদ সবার সাথে শেয়ার করছি।
মোহাম্মদ দিদার
উপস্থাপনের ধরণ বেশ সুন্দর। ছবি গুলো দেখেও বেশ ভালো লাগলো। জানলাম অজানা কিছু। ভালো লাগলো, ভালো লাগার মতোই ছিলো।
ইঞ্জা
আন্তরিক ধন্যবাদ ভাই, ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে বলেই সেই স্বাদ আপনাদের সাথেও শেয়ার করলাম।
সায়মা নুর নাতাশা
বাপি…
আমি অনেক মজা নিয়ে পড়েছি লিখাটা।
পড়ার সময় মনে হচ্ছিলো…আমি তিন গোয়েন্দা সিরিজের কোনো এক অংশ পড়ছি।
বাহ!!!!!!!!!!!!!!
আমার জন্মের কতো আগে তুমি ঘুরে চলে এলে!!!!!!!!
তখন থেকেই এই হেলানো পিসা ছিলো!!!!!!!!!
পড়ে অবাক হয়ে গিয়েছি আমি।
তোমার ভয় দেখে আমার ও ভয় লাগছিলো
আবার মজাও পাচ্ছিলাম।
তুমি এমনভাবে লিখাটা উপস্থাপন করেছো…পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো আমার সামনেই ঘটে যাচ্ছে ঘটনা গুলো।
মনেক মজার একটা লিখা দিলে… <3
ইঞ্জা
ইটালির ফ্লোরেন্স শহরটা আমাকে অনেক কিছুই দিয়েছে, এখানেই আমার পড়ালেখার সমাপ্তি হয়েছে, এইখান থেকেই সেই তোমার হলুদ টেম্পো নিয়ে আসতাম দেশে, বুঝতে পেরেছো মা।
সায়মা নুর নাতাশা
হুউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউম…
অনেক স্মৃতি তাহলে তোমার এখানে…
ইঞ্জা
হারে মা।
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
বাহ্! খুব চমৎকারএকটি ভ্রমণকাহিনী!
ইঞ্জা
ধন্যবাদ নিরন্তর, একবার পারলে ঘুরে আসুন।