‘বিগত ০৭.০১.৫০ তারিখে আমি রোহনপুর থেকে গ্রেপ্তার হই এবং পরদিন আমাকে নাচোল থানা হেড কোয়ার্টারে পাঠানো হয়। কিন্তু পথে পাহারাদার পুলিশরা আমার ওপর অত্যাচার করে। নাচোলে ওরা আমাকে একটা সেলের মধ্যে রাখে। সেখানে একজন পুলিশের দারোগা আমাকে এ মর্মে ভীতি প্রদর্শন করে যে, আমি যদি হত্যাকান্ড সম্পর্কে সম্পূর্ণ স্বীকারোক্তি না করি, তাহলে ওরা আমাকে উলঙ্গ করবে।
আমার যেহেতু বলার মত কিছু ছিল না, কাজেই তারা আমার পরনের সমস্ত কাপড় চোপড় খুলে নেয় এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় সেলের মধ্যে আটকে রাখে। আমাকে কোন খাবার দেওয়া হয়নি। এমন কি এক বিন্দু জলও না। ঐ সন্ধ্যায় স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য এসআইএর উপস্থিতিতে সিপাইরা এসে বন্দুকের বাট দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতে শুরু করে। সে সময় আমার নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত পড়তে থাকে। এরপর ওরা আমার পরনের কাপড় চোপড় ফেরত দেয়।
রাত প্রায় বারোটার সময় আমাকে বের করে সম্ভবত এসআইএর কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। অবশ্য এ ব্যাপারে আমি খুব বেশি নিশ্চিত ছিলাম না। আমাকে যে কামরায় নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে আমার স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ওরা নৃশংস ধরনের পন্থা অবলম্বন করে। আমার চারপাশে দাঁড়িয়ে ওরা আমার পা দুটোকে লাঠির মধ্যে রেখে ক্রমাগতভাবে চাপ দিতে শুরু করে। ওদের ভাষায় আমার বিরুদ্ধে ‘পাকিস্তানী ইনজেকশন’ পন্থায় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছিল।
এ ধরনের অত্যাচার চলার সময় ওরা রুমাল দিয়ে আমার মুখ বেঁধে রেখেছিল এবং আমার চুল ধরেও টান দিচ্ছিল। কিন্তু আমাকে দিয়ে জোরপূর্বক কিছুই বলাতে সক্ষম হয়নি। এতসব অত্যাচারের দরুণ আমার পক্ষে আর হেঁটে যওয়া সম্ভব ছিল না। সিপাইরা আমাকে ধরাধরি করে সেলে নিয়ে গেল। এবার পুলিশের সেই দারোগা সিপাহীদের ৪টা গরম ডিম আনার নির্দেশ দিয়ে বলল যে, এবার মেয়েটাকে কথা বলতেই হবে। তারপর শুরু হল নতুন ধরনের অত্যাচার। ৪/৫ জন সিপাহী মিলে জোর করে আমাকে চিত্ হয়ে শুতে বাধ্য করল এবং ওদের একজন আমার গোপন অঙ্গ দিয়ে একটা ডিম ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। সে এক ভয়াবহ জ্বালা।
প্রতিটি মুহূর্ত অনুভব করলাম, আমার ভিতরটা আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। ১৯৫০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে আমার জ্ঞান ফিরে এলো। একটু পরে জনাকয়েক পুলিশ সঙ্গে করে আবার সেই দারোগার আগমন ঘটে। সেলে ঢুকেই সে আমার তলপেটে বুট দিয়ে প্রচন্ড জোরে লাথি মারে। আমি দারুণ ব্যথায় কুঁকড়ে গেলাম। এরপর ওরা জোর করে আমার ডান পায়ের গোড়ালি দিয়ে একটা লোহার পেরেক ঢুকিয়ে দিল। আমি তখন অর্ধ-চৈতন্য অবস্থায় মেঝেতে পড়ে রয়েছি। কোন রকম স্বীকারোক্তি না পেয়ে দারোগা তখন রাগে অগ্নিশর্মা। যাওয়ার আগে বলে গেল, আমরা আবার রাতে আসব।
তখন তুমি স্বীকারোক্তি না দিলে, একের পর এক সিপাহী তোমাকে ধর্ষণ করবে। গভীর রাতে দারোগা আর সিপাহীরা আবার এলো এবং আবারো হুমকি দিল স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য। কিন্তু আমি তখনও কিছু বলতে অস্বীকার করলাম। এবার দু জন মিলে আমাকে মেঝেতে ফেলে ধরে রাখল এবং একজন সেপাহী আমাকে রীতিমত ধর্ষণ করতে শুরু করল। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললাম…।”
তেভাগা আন্দোলনের বিপ্লবী নেত্রী ইলা মিত্র। দেশ মাতৃকার টানে ব্রিটিশ সামাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে শাসন থেকে মুক্ত করতে যে সব বিপ্লবী তাদের জীবনবাজি রেখে লড়াই সংগ্রাম করেছেন, নারী ও দরিদ্র অসহায় কৃষকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের অন্যতম ইলা মৈত্র।
ইলা মিত্রের সব ইতিহাস ঝিনাইদহে শৈলকুপা উপজেলার বাগুটিয়া গ্রামে। এ দেশের নারী সমাজ তাঁকে নিয়ে অত্যন্ত গর্ববোধ করলেও বাগুটিয়া গ্রামে আজও অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে পৈত্রিক বাস্তুভিটা। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অবহেলায় পড়ে থাকা তাঁর বাস্তভিটা যার সবকিছুই বর্তমানে ভূমিদস্যুদের দখলে।
তথ্যসূত্র:
– ড. নিবেদিতা দাশপুরকায়স্থ, মুক্তিমঞ্চে নারী, প্রিপ ট্রাস্ট, ১৯৯৯, ঢাকা।
– কানু স্যানাল,বিপ্লবী ইলা মিত্র,দৈনিক জনকন্ঠ,১৩ অক্টোবর, ২০১২,ঢাকা।
১৪টি মন্তব্য
আফ্রি আয়েশা
মহান এই বাঙালি বিপ্লবীকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
জয়তু ইলা মিত্র।।
নীলকন্ঠ জয়
ধন্যবাদ আফ্রি আপু। জয়তু ইলা মিত্র।
আদিব আদ্নান
শুধুই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি ।
নীলকন্ঠ জয়
ধন্যবাদ আদনান।
স্বপ্ন
শ্রদ্ধা জানাচ্ছি বিপ্লবী ইলা মিত্রকে ।
নীলকন্ঠ জয়
শ্রদ্ধা নিরন্তর। ধন্যবাদ।
জি.মাওলা
যেনে ভাল লাগল
নীলকন্ঠ জয়
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
মা মাটি দেশ
ইলা মিত্র এক প্রতিবাদী নারী ।সুন্দর তথ্যবহুল পোষ্ট।
নীলকন্ঠ জয়
ধন্যবাদ ভাইয়াকে। শুভেচ্ছা জানবেন।
খসড়া
একসময় ইলা মিত্র ছিলেন আমার স্বপ্ন কন্যা। খুব ভাল লাগল।
নীলকন্ঠ জয়
সত্যি তাই? তিনি সব নারীদের আদর্শ। স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক।
জিসান শা ইকরাম
স্যালুট বিপ্লবী নেত্রী ইলা মিত্র –
ভাবতে গর্ব হয় , আমরা এই মহান বিপ্লবীর উত্তরসুরি ।
শেয়ার দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
নীলকন্ঠ জয়
সত্যি ভেবে গর্বিত হই আমরা এই মহান বিপ্লবীর উত্তরসুরি। কিন্তু কতটুকু মূল্যায়ন করতে পারলাম তাকে? কিছুই না।
ভাইয়া জেনে খুশি হবেন যে সোনেলার পর লেখাটি “জলছবি বাতায়নে” প্রকাশ করেছিলাম। সম্পাদক সাহেব (কাবুল ভাই ,যাকে আমি গুরুজি বলে থাকি) লেখাটি পছন্দ করে আগামী একুশে সংকলনের জন্য নির্বাচন করেছেন।
প্রিয় ভাইয়ার জন্য ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা রইলো।