বিকেলে ঘুমানোর অভ্যাস নেই । কিন্তু গত কয়েক রাতে ভালো ঘুম হয়নি , তাই ঠিক করলাম আজ আয়োজন করে ঘুমাবো । অনেক প্রস্তুতি নিয়ে যখনই বালিশে মাথা রাখলাম , তখনই সাফা ভাইয়ের কল ।
“ রবিন ! কোথায় তুমি ? ”
আমি বললাম , “ বাসায় ”
“ ফ্রি আছো ? ”
“ হ্যাঁ , কেন ?”
“ একটু সাগর পাড়ে যাবো । পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে চলে আসো । ”
সাফা ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্কটা শুধু বড় ছোট ভাইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না । আমরা খুব ভালো বন্ধুও বটে । তাই উনার কোন আবদারে না বলতে পারি না । তার কথা মতো ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হলাম । ভাই বাসার সামনে দাঁড়িযে , গায়ে ধূসর রঙের শাল । হাতে সিগারেট পুড়ছে ।
“ ভাই ! এটাতো মেয়েদের শাল । তবে আপনাকে ভালোই মানিয়েছে । ”
“ ধুর মিয়া ! তোমার দেখছি শাল সম্পর্কে কোন আইডিয়া নাই । এটা কাশ্মীরী শাল । গত শীতে মামা এনেছে । এটার দাম বাংলাদেশী টাকায় এগারো হাজার । আরেকটা কথা মনে রাখবে , একরকম শাল ছেলেমেয়ে সবাই পড়তে পারে । অবশ্য ধূসর রংয়ের শাল ছেলেদেরকেই বেশী মানায় ”
বাসার কাছেই বঙ্গোপসাগর । রিক্সায় দশ মিনিটে যাওয়া যায় । একটা রিক্সা ভাড়া করে রওনা হলাম , পি এইচ আমিন একাডেমীর পাশ দিয়ে । এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসার সময় আমি খুব স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি , এই স্কুলে কেটেছে আমার শৈশব , রয়েছে হাজারো স্মৃতি । আহা জীবন ! স্কুল জীবন !
আমি বললাম , “ ভাই ! এই কনকনে শীতের সন্ধ্যায় সাগর পাড়ে কেন যাচ্ছি ? ”
সাফা ভাই বললেন , “ কাজ আছে । ”
“ সূর্যাস্ত উপভোগ করবেন ? ”
“ না ”
“ তাহলে কি কাজ ? ”
“ গেলেই দেখতে পাবে । আপাদত চুপ করে বসে থাকো । ”
“ মানুষ কেন যে এই কাদা পানিতে ঘুরতে আসে ! ”
“ ধুর মিয়া ! কী বলো তুমি ! তোমার দেখি রুচি বলতে কিছুই নাই । আমি মনেকরি , এতো টাকা পয়সা খরচ করে সুন্দরবন কক্সবাজার না গিয়ে এই সাগর পাড়ে আসা উচিত । একসাথে দুটোই দেখতে পাবে । এখানে একপাশে সুন্দরী গেওয়া গাছের বন , অন্যপাশে বিশাল সমুদ্র ।”
কথা বলতে বলতে আমরা সাগর পাড়ে চলে আসলাম । রিক্সা থেকে নামার পর হাঁটতে হাঁটতে বনের কাছাকাছি আসতেই চারু আপুর সাথে দেখা। এতক্ষণ পরে বুঝলাম , এই অবেলায় সাফা ভাইয়ের সাগর পাড়ে আসার কারণ ।
চারু আপু সাফা ভাইয়ের খুব ভাল বন্ধু । তবে আমার ধারণা , উনাদের মধ্যে সম্পর্কটা বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি । যদিও দুজনের একজনও এটা প্রকাশ করে না । চারু আপুর সাথে উনার ছোটবোনও ছিল । বোনের নামটা এখন মনে করতে পারছি না । আমার একটা খারাপ অভ্যাস , খুব বেশি না মিশলে মানুষের নাম মনে রাখতে পারি না ।
সাগর পাড়ে সবসময় চা , বাদাম , ঝালমুড়ি বিক্রেতাদের আনাগোনা দেখা যায় । এক চা বিক্রেতাকে চার জনের জন্য চার কাপ রঙ চা দিতে বললাম । সাফা ভাই চায়ে চুমুক দেওয়ার সাথে সাথে একটা সিগারেটও ধরালেন । আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললাম , “ উফ ! ভাই , পাশে ছোটবোন বসে আছে , সিগারেট এখন ধরানোর কি খুব দরকার ছিল ? ”
আহমদ ছফার ‘ অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী ’ গল্পের দুরদানার সাথে চারু আপুর পোশাক পরিচ্ছেদ , কথাবার্তার বেশ মিল আছে । আর , আট-দশটা বাঙ্গালি মেয়ের মতো খুব বেশি রক্ষণশীল মাইন্ডের নয় ।
যা হোক, তারপর সবাই মিলে সবুজ ঘাসের ওপর গোল করে বসে আড্ডা দিতে শুরু করলাম। সাফা ভাইয়ের সাথে দেওয়া আড্ডাগুলো খুবই ভালো জমে । খুব রসিক মানুষ । তাছাড়া সাফা ভাইয়ের মধ্যে একটা অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে, চারপাশের মানুষদের খুব সহজে হাসাতে পারে।
আড্ডার মাঝে চারু আপু হঠাৎ ব্যাগ থেকে ছোট ছোট দুটো বক্স বের করলো । আপু আমাদের জন্য পায়েস রান্না করে এনেছে । তারপর, খাওয়া শেষে বায়না ধরেছেন , সাগরের পানিতে খালি পায়ে হাঁটবে । আপুকে সঙ্গ দিতে সাফা ভাইও গেল ।
দুজনের হাত ধরে খালি পায়ে হাঁটার দৃশ্য দেখে আমার খুব ঈর্ষা হলো । মনের মধ্যে একটা হালকা অভাব অনুভব করলাম । যদি চারু আপুর মতো অদ্ভুত এক পাগলি আমার লাইফেও থাকতো !
অবশেষে, কিছু বাদাম কিনে বাসার উদ্দেশে রওনা হলাম । সূর্য অস্ত যায় যায় অবস্থা। ফেরার মুহূর্তে সাগর ভরা জোয়ারের ঢেউগুলো দেখে মনে হলো , সদ্য একটি যুদ্ধ শেষ হয়েছে । চারদিকে নিস্তব্ধ । যেন হাজারও মৃত সৈনিকের রক্তের জোয়ারের ঢেউ এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে । স্পর্শ করতে চাচ্ছে , রাঙ্গাতে চাচ্ছে । থাক্ , আজ এতোটুকুই থাক্ ।
সাগর সাগর মহাসাগর যা-ই শুনি, মনের ভেতর একটা সাগরের ঢেউ আজও উঠে। সেই সাগরটা হলো বঙ্গোপসাগর। একসময় প্রতিদিন বিকালবেলা সাগর পাড়ে বসে থাকতাম, ঘুরাঘুরি করতাম। শামুক ঝিনুক ধরতাম। সময়টা ছিল ১৯৭৪-৭৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে। মাত্র ১২ টাকা রোজে নারায়ণগঞ্জ থেকে কক্সবাজার মহেশখালী গিয়েছিলাম এক ঠিকাদারির সাথে রাস্তার কাজে। আপনার লেখা পড়ে নতুন করে মনে পড়ে গেল সেসব কথা।
১৬টি মন্তব্য
আরজু মুক্তা
মাঝি পাড়া পার হয়ে কিছুদূর গিয়ে যে ঝাউবাগান ওখানে। মাছের যে গন্ধ। কাঁকড়া ভাজি খেয়েছেন? তবে ওখানকার সূর্যাস্তের দৃশ্যটা মনোরম। আমার বাসাও হালিশহরে।
ভালো লাগলো গল্প।
আকবর হোসেন রবিন
কাঁকড়া ভাজি অনেক খেয়েছি, তবে বাসায়। আম্মা খুব মজা করে ভাজি করতে পারে।
কাঁচা হাতের লেখা, তাও বললেন পড়ে ভালো লেগেছে; এইজন্য কৃতজ্ঞতা নিবেন।
তবে, আমার লেখা পড়ে ভুলত্রুটি পেলে তা ধরিয়ে দেওয়ারও অনুরোধ রইল।
মাছুম হাবিবী
লেখাটি অনেক ভালো লেগেছে। আসলে ভাই আমাদের এদিকে সাগর নাইতো, তাই সাগর পাড়ে ঘুরার অভ্যাসটুকুও নাই। তবে কোনো একদিন ঘুরবো।
আরেকটা কথা লেখার মাঝে ” ” চিহ্ন গুলো কম দেয়ার চেষ্টা করবেন। এতে করে লেখাগুলো স্পষ্ট বুঝা যাবে।
আকবর হোসেন রবিন
ওকে ভাই, বিষয়টা মাথায় রাখবো।
বন্যা লিপি
সাবলীল লেখা। বেশি বেশি লিখুন।
শুভ কামনা।
আকবর হোসেন রবিন
ধন্যবাদ আপু।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
লেখার বর্ণনা সাবলিল, ভালো লেগেছে। ভাবছি কালকে বন্ধের দিন জেলে পাড়া বীচে যাবো। অবশ্য গত দুই মাসে দুই বার গেছি।
আকবর হোসেন রবিন
বন্ধের দিনগুলোতে মানুষের খুব ভীড় থাকে। তাই বৃষ্টি হলে না আসাটায় শ্রেয়। কাদামাটি আর হৈ চৈ দেখে বিরক্ত হতে পারেন।
মনির হোসেন মমি
সাগর পাড়ে যায় যারা নাকি অনেক বড় মনের মানুষ হয় সত্যিই কি তাই? সাগরে জলে সাফা চারু হাটার অনুভবটা আপনার আফসোস রয়ে গেল।এমনটি হওয়া স্বাভাবিক।সাগর পাড় শুধু দুজন দুজনার। আশায় রইল সঙ্গী নিয়ে সাগর পাড় ঘুরার পোষ্টের।
আকবর হোসেন রবিন
আমিও আশাকরি একদিন সঙ্গী নিয়ে ঘুরবো। আপনাদের জানাবো।
মনির হোসেন মমি
ঘটা করে জানাবেন তাহলে একটা ভোজনঁও হয়ে যাবে।ধন্যবাদ। শুভ কামনা রইল ভাইয়া ।
নিতাই বাবু
সাগর সাগর মহাসাগর যা-ই শুনি, মনের ভেতর একটা সাগরের ঢেউ আজও উঠে। সেই সাগরটা হলো বঙ্গোপসাগর। একসময় প্রতিদিন বিকালবেলা সাগর পাড়ে বসে থাকতাম, ঘুরাঘুরি করতাম। শামুক ঝিনুক ধরতাম। সময়টা ছিল ১৯৭৪-৭৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে। মাত্র ১২ টাকা রোজে নারায়ণগঞ্জ থেকে কক্সবাজার মহেশখালী গিয়েছিলাম এক ঠিকাদারির সাথে রাস্তার কাজে। আপনার লেখা পড়ে নতুন করে মনে পড়ে গেল সেসব কথা।
আকবর হোসেন রবিন
আহা! কি দারুণ দিন ছিলো আপনার। আমার গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপে, ওখানেও মাঝেমধ্যে সাগড় পাড়ে ঘুরতে যেতাম। সাগড় পাড়ে গেলে মনটাও সাগড়ের মতো বিশাল হয়ে ওঠে।
সাখিয়ারা আক্তার তন্নী
ভাইয়া,মনের মধ্যেকার হালকা অভাব মাঝে, মাঝে অনুভব করা কিন্তু মন্দ নয়।
আকবর হোসেন রবিন
হ্যাঁ। এই অভাব আছে বলেই নতুন নতুন স্বপ্ন দেখতি পারি।
আকবর হোসেন রবিন
দেখতে