
(পর্ব দুই)
সেদিন মিথুন তাড়াতাড়ি অফিস থেকে এসেছেন শরীরটা ভালো নেই। একশো এক ডিগ্রি জ্বর। ঔষধ খেয়ে মাত্রই বিছানায় শুয়েছেন কিন্তু শরীরটা পোড়ে যাচ্ছে তাপে। মিথুন ডক্সিকে ডেকে বললেন একটা রুমাল ভিজিয়ে এনে দাও শরীর মুছতে হবে। কিন্তু ডক্সি এলো বাজারের ব্যাগ নিয়ে এসে শুরু করলো কথার তুফান। ” ঘরে বাজার নেই চাল নেই তরকারি নেই। এদিকে পার্মানেন্ট মেহমান তোমার মা তো আছেই। বলি আমি কি হাতেমতায়ী যে সব খরচ আমাকেই বহন করতে হবে। উঠো বাজারে যাও ডং ধরে শুয়ে থেকো না আর”।
মিথুন প্রতিত্তোরে কিছুই বললো না শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ক্রীতদাসের মতো। কিন্তু মিথুনের চোখে তখন ভেসে উঠলো সেই বিশ্বস্ত চোখ দুটো যে চোখ দুটো ভালোবাসার স্বপ্ন বুনে সবুজ ফসলের মাঠে দেখিয়ে ছিলো সমুদ্রের অনন্ত ঢেউ। যে ঢেউ একবার বুকে লাগলে প্রেম জীবন্ত হয়ে আশ্রয় নেয় একে অপরের বিশ্বাসে ভরসায়। খোদার আরশ ছুঁয়ে মহাশূন্যে ভেসে উঠে ভালোবাসার ঘর।
এর মধ্যেই মিথুনের মা রুমাল ভিজিয়ে এনে মিথুনের শরীর মুছে দিচ্ছে যত্নে। মা আর ছেলে যে ভালোবাসাটা ভাগ হয় না কখনোই কোনদিন। প্রশান্তির শীতল ছায়ায় যখন আচ্ছন্ন চোখ দুটো তখন ডক্সির গলায় কচমচ কাঁপছে জানালার কাচ। মিথুন মাথা উঁচু করে ডাইনিং টেবিলের দিকে গেলো।
খোকার গ্লাসে পানি পান করছেন বলে মাকে ডক্সি তীব্র তিরস্কার করছেন। লজ্জায় জননী মাটি হয়ে মিশে যাচ্ছে মাটির সাথে। মিথুন ব্যাপারটা ভালোভাবে নিতে পারলেন না। শুধু ধমকের সুরে বললেন, “সাদিনের গ্লাসে পানি খেয়েছেন মা তাতে কি এমন অশুদ্ধ হলো ;তুমি এতো চেচামেচি করছো কেন” ?
শুরু হলো আবার কথার বুলি। “তোমার মায়ের নোংরা মুখের পানি খাওয়া গ্লাসে আমার ছেলে পানি খাবে কেন “? এই বলে গ্লাসটা জানালা দিয়ে ছুড়ে মারলো ডক্সি। একখণ্ড পাথর যেভাবে জলের তলে তলিয়ে যায় তেমনি মায়ের মুখখানা তলিয়ে গেল চারদেয়ালের ইটের ভেতরে। বলতে পারা না পারার মতো একটা অস্ফুট কষ্ট ঠিক যেন এক নিরাপদ ব্যাক্তির ফাঁসির মঞ্চের মতো কঠিন ও নিষ্ঠুর।
মায়ের এই কষ্টটা মিথুনকেই ইঙ্গিত দিলো মিথুন তখন মা’কে ডেকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। সাধারণ দৃষ্টির ভাষায়, মিথুন তার মাকে অনুধাবন করালো কিভাবে তার জীবন সংসার পোড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে মিথুন মা’কে বললো মা তুমি দু একদিন পর বাড়ি চলে যাও মা। মা ও তাতে সম্মতি জানালো।
কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে মা এক অসহায় মা একমাত্র পুত্র সন্তানের ছায়ার আশ্রয় ছেড়ে কোথায় যাবে কার কাছে যাবে। মানুষ বৃদ্ধ হলে এখন সম্ভবত সে আর কারো পিতা বা মাতা থাকে না শ্রেফ একটা ঝামেলা হয়ে উঠে হয়ে উঠে একটা বাড়তি বোঝা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে বোঝাটা আর কেউ মাথায় নিতে চায় না।
পরদিন সকালে মিথুন অফিসে চলে গেলো। অফিসে যাওয়ার পর বাজারের ব্যাগ দিয়ে মা’কে বাজারে পাঠালো ডক্সি। প্রায় দু’ঘন্টা পর দুজন প্রতিবেশী ধরাধরি করে মা’কে বাসায় নিয়ে এলো এবং তারা বললো “রাস্তার পাশে পড়েছিলো সম্ভবত কোন সিএনজি ধাক্কা মেরে চলে গেছে “। তখনও মায়ের কপাল বেয়ে রক্ত পড়ছে হাতে ও কোমড়ে জখমের চিহ্ন। কিন্তু মা’কে কোন হাসপাতালে ভর্তি না করে চিকিৎসা না দিয়ে ব্যথায় কুঁকড়ানো বৃদ্ধ মা’কে নাপা খাইয়ে শুইয়ে দিলো পাথর মনের ডক্সি। এদিকে এ ঘটনা মিথুনকেও ফোন করে জানালো না সে।
মিথুন রাত নয়টার দিকে বাসায় এলো। প্রতিদিনের মতো টেবিলে খাবার দিলো কাজের মেয়ে। কিন্তু মিথুন টেবিলে বসে মায়ের অনুপস্থিতি টের পেয়ে বুয়াকে জিজ্ঞেস করলো মা খেয়েছেন? বুয়া বললো উনি তো অসুস্থ শুয়ে আছেন! মিথুন খাবার টেবিল থেকে উঠে মায়ের কাছে গেলো। মা মিথুনকে সব বললো। মিথুন তখন ডক্সিকে কেনোকিছু না বলে মা’কে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে চলে গেলো। ভর্তি করার দু’ঘন্টা পর তার মা মারা গেলো এবং সময় বিলম্বে হাসপাতালে নিয়ে আসার জন্য, ডাক্তারদের কাছে মিথুন হেয় প্রতিপন্ন হলো। হাজারো দুঃখ ব্যথা আর ভালোবাসার মতো অসহ্য নির্যাতন মাথায় নিয়ে মিথুন মা’কে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সৎকার করে আসলো।
মা চলে গেছে ছয়মাস হলো। ঘরটা এখন জেলখানার মতো লাগে। নিজেকে লাগে ফেরারি আসামির মতো। নিজের মা’কে হত্যার মতো মারাত্মক একটা অপরাধ বোধ বুকে নিয়ে মিথুন ঘুরে বেড়ায়।
যা কাউকে বলা যায় না অথচ সহ্য করাও যায় না। যে পাপ কেউ জানে না অথচ নিজে জানে সেই পাপ ভরা জোছনার চান্দের মতো সবসময় চকচক করে।
(চলবে)
১৩টি মন্তব্য
ফয়জুল মহী
মুগ্ধকর ভাবনা অনন্য লিখনী।
দালান জাহান
ধন্যবাদ ভাই শুভেচ্ছা
আরজু মুক্তা
ভালো লাগলো।
দালান জাহান
ধন্যবাদ কবি শুভেচ্ছা
সুপর্ণা ফাল্গুনী
খুব খারাপ লাগলো, মাকে মেরে ফেললেন! ভালো থাকুন। শুভ কামনা রইলো
দালান জাহান
ধন্যবাদ কবি। খারাপ আমার ও লেগেছে কিন্তু সত্যটাও তো তুলে আনতে হবে।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
হুম ঠিক বলেছেন। ধন্যবাদ ভাইয়া
বন্যা লিপি
বাস্তবতার নিরিখে গল্পের পটভূমি! চলুক এগিয়ে, মিথুলের পরবর্তি পরিস্থিতীর উপরে নজর রইলো।শুভ কামনা।
দালান জাহান
অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি কবি।
হালিম নজরুল
মা চলে গেলে খারাপ লাগবেই। কিন্তু গল্পের প্রয়োজনে লেখক তো মাকে হারাতেই পারে। চলুক পরবর্তী পর্ব।
দালান জাহান
ধন্যবাদ ভাই শুভরাত্রি
ইসিয়াক
চলুক ।সাথে আছি……….
শুভকামনা রইলো
দালান জাহান
ধন্যবাদ ভাই শুভেচ্ছা ও শুভরাত্রি