“নাই, নাই ভয়…”

“তুমি নিজেকে সাহায্য করো, তখন সকলেই সাহায্য করতে আসবে। তুমি নিজেকে অযত্ন দাও, কেউই তোমাকে এসে যত্ন করে দিয়ে যাবেনা”—এই নীতিতে বিশ্বাসী আমি। সত্যি বলতে কি, কেউই নি:স্বার্থভাবে পাশে এসে দাঁড়ায় না। কাউকে যখন খুব প্রয়োজন, তখন সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে কি কাছে পাই আমরা? এককথায় বলা যায়, “না।” সেই কঠিন সময়টাতে নিজেকেই পার করিয়ে নিতে হয়। যারা পারেনা, তারা আসলে চায় না। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটা লাইন আমি আমার জীবনে চলার পথে কাজে লাগানোর চেষ্টা করি, “টিকিয়া থাকা চরম সার্থকতা নয়। অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে।” কারণ কি? অভিযোজন। পরিবেশের সাথে ভারসাম্য রক্ষায় ডাইনোসরেরা সক্ষম হয়নি, কিন্তু তেলাপোকা আজও বিলুপ্ত হয়নি। আর আমরা তো মানুষ, সব অবস্থায় নিজেকে নিয়ে চলার ক্ষমতা রাখি।

২০০৮ সালে জাপান থেকে দেশে ফিরে গেলাম। যাবার পর বাপির হার্টঅ্যাটাক হলো, আমার হাতে কোনো টাকা নেই। তারপরেও Panic হইনি। যেদিন হাসপাতালে নিয়ে গেলাম একেবারে একা ছিলাম। হাতে মাত্র পাঁচশো টাকা, বাপিকে ভর্তি করালাম ওয়ার্ডে। খারাপ লাগলেও কিছুই করার ছিলোনা। খুব শান্তভাবে বিজয় কাকুকে ফোন দিয়ে বললাম ২০০০ টাকা কি হবে? যদি থাকে তাহলে আমায় দিলে ভালো হয়। একেকটি মুহূর্ত কীভাবে যাচ্ছিলো, আমি জানিনা। তবে বিশ্বাস থেকে একচুলও সরে যাইনি, বাপি সুস্থ হবেই। এই যে পজিটিভ বিশ্বাস আমার প্রতিটি পথে সঙ্গী হয়ে থাকে। যেদিন বাপির সার্জারি হলো, সেদিন হাসপাতালের লাউঞ্জে একেবারে একা বসেছিলাম সবাইকে পাঠিয়ে দিয়ে। অনেক যন্ত্রণা সেই সময়ে, এখন বাপির বুকটা কাটা হচ্ছে, যেখানে আমি মাথা রাখতাম। সার্জারি সফল হলো। বাপি সিঁড়ি ভাঙ্গতে পারবেনা, তাই সেভাবে বাসা খুঁজে চলছিলাম। বাসা পেলাম তাও দোতলায়। যাক বাসায় ওঠার পর সে সময়ই আমাকে বেলজিয়াম চলে আসতে হলো। বেলজিয়াম আসার পর এতোটাই অপরিচিত হোলাম নিজের কাছে, সারাদিন ফেসবুকের নেশা। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। আসলে আমি বাপি-মামনিকে অমন অবস্থায় রেখে আসতে চাইনি। ওদের সাথে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তরুণের পক্ষে খুব কঠিন ছিলো, দুই জায়গায় সংসার চালানো। যেদিন চলে আসি বাপির সেই অসহায়ভাবে দাঁড়ানো আর মামনির ছলোছলো চোখ আজ এখনও ভুলতে পারিনি। সেই যে একধরণের মানসিক যুদ্ধ করে যাচ্ছিলাম, কেউ তখন আমার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। শুধু মজা নিয়েছে পরিচিত থেকে অপরিচিত সকলেই। প্রায় সময়েই মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতাম। ডাক্তার বললো আমি নাকি মানসিক বিপর্যস্ততার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তরুণ যেনো আমাকে খেয়ালে রাখে। সে চেষ্টা করতো, বিভিন্ন জায়গায় নিয়েও যেতো। কিন্তু তারও তো চাকরী, সময় কোথায় ছুটির দিন ছাড়া? জীবনের ওই সময়টাতেও হেসেছি, মানুষের সাথে কথা বলেছি। বুঝতে পারতাম না আসলে আমি কী চাই! শুধু বাপি-মামনির কথা মনে হতো। ইচ্ছে করতো তাদের কাছে গিয়ে থাকতে। কিন্তু আমি আর্থিকভাবে একেবারে নি:স্ব।

এই যে লিখছি এখন, খুব কঠিন নিজের অসহায়তার কথা বলা। তবু বলছি, কেউ যেনো এমন যুদ্ধে নিজেকে সরিয়ে না নিতে পারে। মাঝেমধ্যে মনে হতো নিজেকে মেরে ফেলি। একটা সময় যদিও ফিরে পেয়েছিলাম এই নিজেকে, তবে সেটা অনেক যুদ্ধের পর। যে আমাকে ফিরিয়ে এনেছিলো জীবনে, তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এখানে বলা চলে কারো মাধ্যমে যদি সহজ পথ পাওয়া যায়, তাতে লাভের চেয়ে বরং ক্ষতি-ই হয়। কারণ যে পথটা খুঁজে এনে দেয়, একদিন সে-ই ওই পথে একলা ফেলে দিয়ে চলেও যেতে পারে। তাই আমি মনে করি, যা কিছুই হোক নিজেই নিজেকে সামলানো উচিৎ। আর আমি এখন সেটাই করছি। ভালো কোনটা, আর কোনটা মন্দ সেসব দেখিনা। যে কাজটা করলে মনের ভেতর উসখুস করে, That means something is wrong. আসলে আমরা বাস্তবের চেয়ে কল্পনায় ডুবে থাকতে ভালোবাসি। Jean Racine দারুণ একটা কথা বলেছিলেন, “Life is a comedy to those who think, a tragedy those who feel.” আবার ঠিক এই কথার পাশেই Anna Frank-এর উক্তিটি কেমন! “Feelings can’t be ignored, no matter how unjust or ungrateful they seem.” বাণী চিরন্তনী দেয়া সহজ, তাই না? আসলে খুব কঠিন। আমাদের আবেগ হিসেব করে চলতে জানেনা। আর তাই জীবনে আমরা সকলেই কোনো না কোনোভাবে ধাক্কা খাই। একটা সময় আসে যখন বুঝে ফেলি, তখন কিন্তু আর বিপর্যস্ত সময় থাকেনা। কারণ সেই পথ আমরা চিনে ফেলেছি। যাক বেলজিয়ামের বাস ফেলে কানাডায় এলাম। কাজও শুরু করলাম ম্যাকডোনাল্ডসে। কিন্তু তিনমাস পর কাজ ছেড়ে দিতে হলো, ওদের চাই ফুলটাইমার। আবার কাজ খোঁজা। Meat Factory তে কাজ পেলাম। এ জীবনে সবচেয়ে কষ্টদায়ক কাজ যদি করে থাকি, সেটা হলো এই ফ্যাক্টরীতে। সকালে মনে হতো চিৎকার করে কাঁদি, এতো ভয়ানক পরিশ্রম, পাঁচটি ঘন্টাকে লাগতো দশঘন্টার মতো। কিন্তু টাকার প্রয়োজন। একদিন চাকরী ছেড়ে দিলাম, দিয়ে এলাম হ্যামিল্টনে। হ্যামিল্টন আমাকে যা দিয়েছে, তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। উদাহরণটা এমন দিতে পারি, ছেলে-মেয়ে প্রেম করে বিয়ে করেছে, তাদের দুজনের মধ্যে ঝামেলা হচ্ছে। কিন্তু কাকে গিয়ে বলবে? সবাই ওদেরকেই দোষ দেবে। নিজের ইচ্ছেতেই এসেছিলাম হ্যামিল্টন, কিন্তু একটা সময় মনে হলো না এলেই বোধ হয় ভালো হতো। যাক আফসোস নিয়ে চলা আমার স্বভাবে নেই। পরের পর্বে বাকীটুকু, কেমন?

হ্যামিল্টন, কানাডা
৩০ নভেম্বর, ২০১৭ ইং।

২৫৩২জন ২৫২৪জন

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ