গল্পঃ “বৈশাখ”

রাসেল হাসান ১৪ এপ্রিল ২০১৪, সোমবার, ০১:৩০:০৬অপরাহ্ন গল্প, সমসাময়িক ২ মন্তব্য

আজকে খুব ভোর বেলা ঘুম ভাঙলো রহিমের। সূর্যের আলো বের হবার আগেই তিন চাক্কার রিক্সা নিয়ে ধুলো ময়লার ঢাকা শহরে বেরিয়ে পড়লো। রাস্তা একেবারেই ফাঁকা ফাঁকা। পরিচিত শহরটা কেমন যেন আজকে একেবারেই অপরিচিত লাগছে। রাস্তার মাঝে মাঝে নতুন রং করা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। লাল, হলুদ রঙ্গে সুন্দর করে কিছু কিছু জায়গাতে বড় বড় করে “শুভ নববর্ষ ১৪২১” লেখা। কিছু ছেলে পেলে দল বেঁধে এ গলি থেকে ও গলিতে দৌড়াদৌড়ি করছে। মনে হয় এই ছেলে গুলোই সারা রাত জেগে এসব আলপনা আঁকা আকি করেছে! রহিমের মাথায় এসব নিয়ে কোন চিন্তা নেই। মাথায় চিন্তা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে। তিন দিন ধরে ছোট মেয়ে “সাবিনা” বায়না ধরেছে একটা নতুন জামার জন্য! রহিম কিছুতেই রাজি হয়না, কিন্ত মেয়ের চোখের অশ্রু দেখে মন কে কিছুতেই দমিয়ে রাখতে পারলোনা রহিম! তাই কথা দিয়েছে ১ লা বৈশাখের দিন অবশ্যই একটা নতুন বৈশাখী জামা কিনে দেবে সে। এই কথা শোনার পর সাবিনার চোখে মুখে যে আনন্দের জোয়ার দেখতে পেয়েছিল রহিম তাতেই রহিমের দুঃখ কষ্টের টানাটির সংসারের কথা মুহূর্তের মধ্যে মন থেকে মুছে গিয়েছিল। একটি বারের জন্য হলেও মনে কিছুটা স্বস্তির ছোঁয়া পেয়েছিল রহিম। কিন্ত পরক্ষনেই ছেলের এক জোড়া নতুন জুতা কেনার বায়নার কথা শুনে মুখটা সাথে সাথেই মলিন হয়ে যায় রহিমের! মেয়েকে নতুন জামা কিনে দিতে পারলে তাঁকে কেন নতুন জুতা কিনে দেবেনা? তাই ছেলেটার পাগল করা বায়না! ছেলের মন রক্ষার্থে ওকেও কথা দিয়েছে রহিম এক জোড়া জুতা কিনে দেবে! দু’ দিন ধরে ঘরে কোন বাজার নেই! আজকে বাজারও করতে হবে। গত রাতে আবার স্ত্রী বলল,
ওগো কতদিন ভালো মন্দ খাইনা! একটু ভালো কিছু খেতে মন চাই! শুনেছি সবাই নাকি
বৈশাখে ঘটা করে আনন্দ করে পান্থা ইলিশ খায়! আমাদের তো ইলিশ কেনার মতো অতো সামর্থ্য নেই! শুধু পান্থায় খাবানি। কিন্ত শুধো পান্থা খেতে কেমন লাগে? একটু পুঁটি মাছ যদি পাও তাহলে নিয়ে এসো। সবাই মিলে একসাথে পান্থা পুঁটিই খেলাম! এক বুক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রহিম জবাব দিলো আচ্ছা তাই হবে!
রিক্সার সিটে বসে স্ত্রী সখিনার কথা চিন্তা করতে করতে, চার পাঁচজন তরুণ ছেলেদের দেখা মিললো রহিমের।
এদের মধ্যে একজন রহিমকে উদ্দেশ্যে করে,
এই মামু যাবেন নাকি..পুরো কথা শেষ করার আগেই রহিম তাদের জবাব দিলো যেখানে যান যামু, উঠে পড়েন!
পাঁচ জন নিয়ে চালাইতে পারবা?
হুম, পারবো! উঠে পড়েন…
একসাথে পাঁচটা ছেলেকে রিক্সায় উঠিয়ে চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে রহিমের। অনেক কষ্ট করে করে এক একবার প্যাডেল ফেলছে রহিম। শরীরের ঘাম ছুটে যাচ্ছে কিন্ত আজ কোন কষ্ট অনুভব হচ্ছেনা রহিমের! মাথার মধ্যে ছেলে শাহিনের নতুন জুতো কেনার দামের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে!
কত নিতে পারে এক জোড়া জুতা? লাস্ট গত ২ বছর আগে এক জোড়া জুতা কিনে দিয়েছিল
৩০০ টাকা দিয়ে সেই হিসেবে এখন আরো দুশো টাকা বাড়তে পারে! একদিনে পাঁচশো টাকা
কিভাবে ইনকাম করবো!? মেয়ের একটা নতুন জামা কিনতে দেড়শো টাকা তো লাগবেই?
বাজারের জন্য আরো দুই, তিনশো” অনেক চিন্তায় দু ফোঁটা চোখের জ্বল মনের অজান্তেই রহিমের চোখ দিয়ে বেয়ে পড়লো।
মামা! এখানে থামেন। মনে হয় কোন পিকনিক স্পটে চলে এসেছে রহিম। ছেলে গুলো রিক্সা থেকে নেমে একশো” টাকার একটা নোট দিলো! রহিম বলল, আমার কাছে তো ভাংটি নাই!
ছেলে গুলো পুরোটাই রাখতে বলল। পুরোটা রাখার কথা শুনে রহিমের মুখ হাঁসিতে ভোরে গেলো।
রহিম চলে যাচ্ছিলো এর মধ্যে আর দুই, তিনজন ছেলে দৌড়িয়ে এসে রহিম কে একটু সামনে যাওয়ার জন্য ঠিক করলো। তাঁরা এখানেই আবার ব্যাক আসবে। ছলেগুলো বক্স আনতে যাচ্ছে! গান বাজাবে।
কারো মনে খুশির জোয়ার আর কারো মনে দুঃখের বসবাস!

তাঁরা বক্স নিয়ে ফিরে এলো। রহিমের হাতে আরো একশ” টাকা ধরিয়ে দিয়ে ছেলেগুলো চলে গেলো। এখনো অনেক টাকার প্রয়োজন! রহিম রিক্সা নিয়ে টেনে চলে গেলো।

সারা দিন রিক্সা চালিয়ে সন্ধ্যার কিছু আগে আগে রহিম বাসায় ফিরলো। সকাল ধরে বসে অপেক্ষা করতে থাকা সাবিনা, শাহিন মন মরা হয়ে বস্তির মধ্যে ছোট্ট মাঠটার পাশে বসে অন্যোন্য ছেলে মেয়েদের আনন্দ উল্লাস দেখছে। প্রতিমধ্যে সাবিনা, শাহিনের মা দৌড়াতে দৌড়াতে ছেলে মেয়েদের সামনে এসে তাদের বাবার বাড়িতে ফেরার খুশির সংবাদ জানালো। বাবা ফেরার কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো দুই ভাইবোন। উৎফুল্ল মনে দৌড়িয়ে বাড়িতে ফিরলো সাবিনা, শাহিন। মেয়ের হাতে তাঁর নতুন বৈশাখী জামা তুলে দিলো রহিম। সাবিনা খুশিতে তিড়িং বিড়িং নাচ শুরু করলো। ছেলে শাহিনের হাতে জুতোর বদলে এক জোড়া চামড়ার স্যান্ডেল তুলে দিলো।
স্যান্ডেল দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো শাহিনের। রহিম বলল, “বাবা! মন খারাপ করিস না!
সাম্নের মাসে তোরে জুতা কিনে দেবো। এবার টাকায় কুলাতে পারলাম না! সাম্নের মাসে ঠিকই কিনে দেবো! বাবার মুখে এমন কথা শুনে মুহূর্তেই মুখের হাঁসি আবার ফিরে এলো শাহিনের।
ছেলের মুখে হাঁসি দেখে সারা দিনের গ্লানি যেনো ধূলিসাৎ হয়ে গেলো রহিমের। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালো রহিম, সখিনা বলল” আমার কিছুই চাওয়ার নেই! ছেলে মেয়ের খুশি দেখে আমার চাওয়া পূর্ণ হয়ে গেছে! স্ত্রীর এমন মধুর ভালোবাসা দেখে রহিমের শত কষ্টের মাঝেও হৃদয়ের মাঝে অজস্র ভালোবাসার পরশ লেগে ওঠে। এক টুকরো হাঁসির চাঁদ জেগে ওঠে মনের আকাশে।

উৎসর্গঃ
সেইসব খেটে খাওয়া মানুষদের কে, যারা হাজার কষ্টের মাঝে থেকেও একটি দিন একটি মুহূর্ত হাঁসি খুশির মাঝে নিজেকে বিলেয়ে দেই! এই বৈশাখ তাদের জন্যই!

৫৩৪জন ৫৩৩জন
0 Shares

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ