কিছুদিন আগে একটি সাক্ষাৎকারমূলক লাইভ অনুষ্ঠানে কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন ভাই বলেছিলেন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্যিকের নাম আমীরুল ইসলাম। আসলেই তাই। তার প্রতিটি বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে তার শ্রেষ্ঠত্যের প্রমাণ। তার প্রতিটি বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে শিশুদের মন ও মননকে সম্মৃদ্ধ করার বহু বহু উপাদান। যদিও তিনি অধিকাংশ বই জন্য লিখেছেন শিশুদের জন্য, কিন্তু তার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে সব শ্রেণীর ও সব বয়সের মানুষের জন্য অনন্য শিক্ষা। তার ছড়া, তার গল্পের ভাঁজে ভাঁজে থরে থরে আঁকা আছে সমাজ সংস্কারের চিত্র। সেই বহুদিন আগ থেকেই তার লেখা অনেক বই পড়েছি আমি। কিন্তু এবার অনেক দেরীতে হাতে এসে পৌঁছেছিল “বৃষ্টি নিয়ে নিয়ে বিশটি গল্প” বইটি। চন্দ্রাবতী একাডেমির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ কামরুজ্জামান কাজল বইটি প্রকাশ করেছেন। প্রচ্ছদ ও বইনকশা করেছেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ধ্রুব এষ।

 

দেরীতে হাতে পেলেও বইটি পড়তে কিন্তু মোটেও দেরী করিনি আমি। এমনিতেই আমীরুল ইসলামের বই পেলে আমি নাচতে থাকি, তার উপর এই বইটিতে আছে বৃষ্টি নিয়ে অসাধারণ বিশটি গল্প। বৃষ্টি নিয়ে লিখলেও এর প্রতিটি গল্পে গল্পে গাঁথা আছে মা, মাটি, মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি অসীম ভালবাসা এবং অসাধারণ কিছু শিক্ষা। শিশুদের মনোজগতের ধনাত্মক পরিবর্তনে বইটি দারুনভাবে সহায়ক বলে মনে করি।

 

বৃষ্টির কাছেও যে কতকিছু শেখার আছে, তা এই বইয়ের প্রতিটি গল্প পড়লেই বুঝা যায়। “আষাঢ় শ্রাবণ দুই ভাইবোন” শিরোনামের প্রথম গল্পটিতে লেখক একদিকে মাসদুটির বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন, অন্যদিকে তাদের স্বাতন্ত্র্যও তুলে ধরেছেন। শ্রাবণের মেঘময় আকাশে যে গাছপালা-লতাপাতা, কাশবন-নৌকা, শুঁড়তোলা হাতি বা রবীন্দ্রনাথের ছবি ভেসে ওঠে সেটিও তুলে ধরা হয়েছে। তেমনি মানুষের মধ্যে যে স্বাতন্ত্র্য আছে তা তুলে ধরেছেন চমৎকারভাবে। একেকজনের পছন্দ, অপছন্দ, চাওয়া, পাওয়া, স্বপ্ন আলাদা আলাদা।

 

“বৃষ্টির গল্পে” ফুটিয়ে তুলেছেন গ্রীষ্মের ছুটিতে দাদাবাড়ির আনন্দ। গল্পটিতে একদিকে মাটির রাস্তা, পুকুরপাড়,বিস্তৃত মাঠ, দূরের নদীর সৌন্দর্য বর্ণনা করা হয়েছে, অন্যদিকে তুলে ধরা হয়ে হারিয়ে যাবার বেদনা। মানুষ বাড়ার সাথে সাথে কিভাবে নদী-প্রকৃতি ধ্বংস করা হচ্ছে সেটিও লিখেছেন সুচতুরভাবে। সারাগ্রামের মানুষের মধ্যে মায়ের আম বিলি করার কাহিনী দিয়ে লেখক পরোপকারের সুখের কথা তুলে ধরেছেন। মায়ের শাসনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি শিখিয়ে দিয়েছেন বৃষ্টিতে বেশি ভিজলে অসুখ হতে পারে। আবার শিশুদেরকে পৃথিবী বদলে ফেলার মন্ত্র শিখিয়ে বলেছেন “শিশুরাই একদিন সব বদলে দেবে, গড়ে তুলবে এক চমৎকার বাসযোগ্য পৃথিবী।

 

এভাবে গল্পে গল্পে তিনি বুঝিয়েছেন কিভাবে মানুষ ঘাসেদের কথা বোঝে, পাখিদের কলকাকলী ও নদীর কলতান বোঝে।

 

“মায়ের জন্য বৃষ্টি” গল্পে আমীরুল ইসলাম তার মায়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার নিদর্শন রেখেছেন। মায়ের মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান হয়ে কবরস্থানে কিভাবে তিনি অচেতন হয়ে পড়েছিলেন, সেটিও জেনেছি এই গল্প থেকে। পৃথিবীর প্রতিটি মা’ই যে সন্তানের কল্যান প্রার্থনা করেন তা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন “ইচ্ছে করে মাটির কাছে চলে যাই”। অর্থাৎ ইচ্ছে করে প্রয়াত মায়ের কাছে চলে যাই। আবার ঠিক পরের গল্পেই বৃষ্টিকে তিনি মায়ের সাথে তুলনা করেছেন। “অসংখ্য বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজবার সময় ওদের আদর দেখে মা মনে হয়। কোমল আদুরে, স্বপ্নমাখা লাবণ্যময়ী মা।” তাই বৃষ্টিকে তিনি বন্ধু হবার আকুতি জানিয়েছেন। এর পরের গল্পটিতে তিনি বৃষ্টিবিলাসী হুমায়ূন আহমেদের বৃষ্টিপ্রেমের কথা তুলে ধরেছেন। বৃষ্টি এলে তিনি কিভাবে সকলকে নিয়ে ভিজতেন, গাইতেন আর নাচতেন সেটি উল্লেখ করেছেন গল্পটিতে।

 

“গাছেরা ম্যাজিক জানে” গল্পে দাদুকে যাদুকর বললেও প্রকৃত যাদুকর বলা হয়েছে বৃক্ষ বা প্রকৃতিকে, যাদের যাদুর টানেই মাঝে মাঝে হারিয়ে যেতেন দাদু। তার কথা থেকেই জানা যায় ঘাসেদের জীবন আছে,সংসার আছে। ওরাও কথা বলে। চোখ ও মন থাকলে ওদের কথাও শোনা যায়। তেমনি পাখিদেরও ভাষা আছে, দেশ আছে। তবে শীতপ্রধান দেশ বা সাইবেরিয়ান অঞ্চলে বেশি শীত পড়লে ওখানকার পাখিরা বাঁচার জন্য আমাদের দেশেও চলে আসে। দাদুর উদ্ধৃতি দিয়ে এই গল্পটিতে আরও দেখানো হয়েছে কিভাবে গাছ পরিবেশের উপকার করে। আমরা বায়ূকে দুষিত করি, অথচ গাছ পরিবেশকে বিশুদ্ধ করে। গাছেরা আছে বলেই বৃষ্টি হয়। গাছেরা ম্যাজিক জানে। ইচ্ছে করলে মানুষও ম্যাজিশিয়ান হতে পারে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে।

 

“ধ্রুব এবং বৃষ্টি” গল্পটিতে খ্যাতিমান এই শিশুসাহিত্যিক বলেছেন, “যে চোখ স্বপ্ন দেখতে পারে সেখানে যে কত রং ছড়িয়ে থাকে তা কে জানে!” বৃষ্টির রং খুঁজতে খুঁজতে শিল্পী ধ্রুব এষ ঘুমিয়ে পড়ে, স্বপ্ন দেখতে থাকে। একটা ভেজা চঁড়ুই, বৃষ্টির ফোটা, সোনালী নদী, নীল পাহাড় ঘুরে তার ভাংলে দেখে জল আর ছাইয়ের রং একাকার হয়ে অপূর্ব এক বৃষ্টির ছবি হয়ে গেছে। “টুনটুনি আর রিমঝিম” গল্পে বৃষ্টির মেয়েদের নাম দেয়া হয়েছে ঝরঝর, রিমঝিম আর ঝিরঝির। গল্পটিতে টুনটুনি আর রিমঝিমের গভীর ভালবাসা প্রকাশ করা হয়েছে। “বৃষ্টি আমাদের বন্ধু” গল্পে লেখক লতাপাতা, রঙবেরঙের ফুল, ঘাসপাতা-গাছকে বৃষ্টির বন্ধু বলা হয়েছে। বৃষ্টি না হলে গাছেদের আনন্দ থাকে না, পাতা হলুদ হয়ে যায়। বৃষ্টি এলে এইসব বন্ধুরাও আনন্দে হেসে ওঠে। “বৃষ্টিতে আমার জ্বর আসে না” গল্পে বুয়ার ছেলে রমজানের জ্বর হয়। সে পলিথিনে ছাওয়া ঘরে থাকে। জ্বরের ঘোরে সে চলে যায় ফুলেদের দেশে, পরিদের দেশে। সেখানে আঁকাবাঁকা জলের প্রপাত, যেখানে কেউ যেতে পারে না। “বৃষ্টি যখন ছবি আঁকে” গল্পে আটিশ বাবা ঝুমকিকে ছবি আঁকার প্রেরণা দিয়ে বলে “যা আঁকবা তাই ছবি। কে কি কইল কিছু মনে করবা না। তোমার ছবি তোমার মত করে আঁকবা। প্রেরণা পেয়ে ঝুমকিও ভাবে সে যা খুশি তাই আঁকবে। ফুলের গন্ধ, পাখির গান, শিশিরের শব্দ সব আঁকবে। “রবীন্দ্রনাথ ও বৃষ্টির খেলা” গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বৃষ্টির চমৎকার বন্ধুত্বের বর্ণনা দিয়েছেন শ্রদ্ধেয় শিশুসাহিত্যিক আমীরুল ইসলাম। “বৃষ্টি নামে” গল্পে তিনি বৃষ্টির নানান স্বরূপ বর্ণনা করেছেন। ঝমঝম, ঝরঝর, ঝিরিঝির, রিমঝিম, টাপুর টুপুর, খটখটে, প্যাঁচপ্যাঁচে, রোদবৃষ্টিসহ বৃষ্টির নানারকম নাম শিখিয়েছেন তিনি।

 

“বৃষ্টির জন্য আকুলতা” গল্পে বৃষ্টিহীন দিনের রূঢ়তার চিত্র তুলে ধরেছেন খ্যাতিমান এই শিশুসাহিত্যিক। অনাবৃষ্টির গরমের দিনে কেরামত আলী তরমুজ খেয়ে তৃষ্ণা মেটায়। প্রচণ্ড গরমে মোউয়ের মাথা ধরে। তখন সে আর বলে না আয় বৃষ্টি ঝেপে ধান দেব মেপে। সে বৃষ্টি চায়, প্রয়োজনে যত খুশি ধান দিয়ে দিতে চায়। কেননা সে জানে বৃষ্টি এলে মায়ের মুখে হাসি ফুটবে, বাগানে ফুল ফুটবে, পাখিরা গান গাইবে, শীতল হবে সমগ্র ধরাতল। “তিনটি বৃষ্টিফোঁটা” গল্পে নিজেকে শ্রেষ্ঠ দাবী করা তিনটি বৃষ্টিফোঁটার মাটিতে বিলীন হবার কাহিনী দিয়ে মানুষকে শ্রেষ্ঠ দাবী না করার এক চমৎকার শিক্ষা দিয়েছেন তিনি। “ঈদ, বর্ষাকাল ও ঘাসফড়িঙের গল্প” শিখিয়েছে বর্ষাকালে কিভাবে আকাশ কালো হয়, বৃষ্টি নামে, কিভাবে ব্যাঙ ডাকে, পিঁপড়েরা রেলিং ধরে উঠে আসে, বইয়ের আলমারি থেকে বের হয় জবুথবু আরশোলা, মাটির গর্ত থেকে উঠে আসে কেঁচোর দল, কার্ণিশে ঝিমাতে থাকে বেড়াল। গল্পটিতে গরীব শিশুদেরকে ঈদে পাওয়া নিজের কাপড় বিলিয়ে তাদের সাথে সুখ উপভোগের চিত্র তুলে ধরেছেন দারুওনভাবে। ঘাসফড়িঙরাও বলে সবাই যদি খুশি না হয়, সেই আনন্দ মিথ্যে। তাই ঈদে চাই সবার আনন্দ।

 

“বৃষ্টি, মা ও নীল আকাশ” গল্পটিতে প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক আমীরুল ইসলাম মায়ের শাড়ির আঁচল যে কত প্রিয় সেটি তুলে ধরেছেন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। একটি বড় সংসারে একেকজনের রুচি ও চাহিদা একেক রকম। অথচ শত অভাবের মাঝেও দশভুজা মা যে কত সুনিপুণভাবে সবাইকে খুশি রাখেন তা বর্ণনাতীত। তাই মা’কে তিনি নীল আকাশ বলেছেন। বলেছেন বসন্তের সমীরণ, ফুল, পাখি, বর্ষার ঘণবৃষ্টি। মা যেন নদীর কলধ্বনি, বিস্তীর্ণ পথ, আনন্দধবনি। মা’ই যেন পৃথিবী। এই জগৎসংসারে মা-সন্তানের চেয়ে স্থায়ী ও গভীর কোন সম্পর্ক নেই। মায়ের ঋণ কখনোই শোধরাবার নয়। মা’ই জন্মসূত্রের রাণি। মাকে কখনোই কষ্ট দিতে নেই। তাই লেখক নির্দ্বিধায় বলেছেন “আমার মা বেঁচে থাকলে তোরা আমাকে পাইতি না”।

 

“বৃষ্টি নিয়ে বিশটি গল্প” বইটি বৃষ্টি নিয়ে লিখলেও প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক আমীরুল ইসলাম একদিকে যেমন শিশুদের মনোজগতকে উন্নত করার প্রয়াস পেয়েছেন, তেমনই সামাজিক সংস্কারের জন্য বপন করেছেন অসাধারণ কিছু শিক্ষার বীজ। এককথায় বললে “বৃষ্টি নিয়ে বিশটি গল্প” শিশুসাহিত্যে এক অনন্য শৈল্পিক উপস্থাপন।

———————–0 0———————-

১জন ১জন
0 Shares

২৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ