ক্রীতদাস প্রথা, নির্মম এক ইতিহাস পর্ব- ৬

রিতু জাহান ২৩ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ০৭:৫৩:০৪পূর্বাহ্ন বিবিধ ২৪ মন্তব্য

17467618_1895071280751370_1534038067_n-2
ক্রীতদাস শাস্তিঃআমেরিকা ছাপ মারা বা ট্যাটুঃ চুরির অপরাধে ক্রীতদাসদের কপালে ইংরেজি শব্দ “Far” এঁকে দেওয়া হতো। সাধারণত লোহার তৈরি ছাঁচ গরম করে কপালে ছ্যাঁকা দেওয়া হতো আর এতে কপালে স্থায়ী ছাপ পড়ত। “Far” শব্দটি এসছে ল্যাটিন শব্দ “Fure” থেকে যার অর্থ চোর। ট্যাট্টু দাগি অপরাধীদেরকে চিহ্নিত করার জন্যও ব্যবহৃত হতো। তাছাড়া, গ্লাডিয়েটর স্কুলে শিক্ষার্থীদেরকে ট্যাট্টু এঁকে দেওয়া হতো। সাধারণত তাদের মুখমন্ডল, হাত ও পায়ে আঁকা হতো।
খামারে পশুদের চিহ্নিত করে রাখার জন্যই ট্যাট্টু মূলত ব্যবহৃত হলেও ক্রীতদাসদের চিহ্নিত করতেও এই পন্থা অবলম্বন করা হতো। আমেরিকার লুসিয়ানাতে ব্ল্যাক কোড বা কোড অব নইর(Code of Noir) প্রচলিত ছিল, যার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ছিল ক্রীতদাসদের কান কেটে ফেলা, ঘাড়ের পিছনে ট্যাট্টু এঁকে দেওয়া, হাঁটুর উপরে রগ কেটে ফেলা ইত্যাদি। সাধারণত পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসদের ধরে এনে তাদের হাঁটুর উপর রগ কেটে দেওয়া হতো এবং ঘাড়ে ও পিঠে এই ট্যাট্টু এঁকে দিত।
17495580_1895071407418024_1516595129_n-2
ক্রীতদাসরা যেন পালিয়ে না যায়, সেজন্য তারা ক্রীতদাসদের এই কঠিন শাস্তি দিত প্রকাশ্যে।
একজন পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাস সাধারণত আর বিক্রয়যোগ্য হতো না। তাই তার মালিক তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কেটে দিত। তখন পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসদের ধরে আনার জন্য একটি নতুন ব্যবসাই শুরু হয়েছিল, যা ইংরেজিতে ফাগিটিভারি নামে পরিচিত। তাদের ব্যবসা প্রসারের জন্য তারা রিতীমতো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিত। এসব ক্রীতদাসদের ধরে এনে তাদের কপালে Fug শব্দটি এঁকে দেওয়া হতো। শব্দটি এসছে ল্যাটিন শব্দ Fugitivus”যার অর্থ পালিয়ে যাওয়া। তাদের কপালে এই “Fug”শব্দটি লিখে দেওয়া ছাড়াও তাদের হাড়ের জোড় ভেঙে দেওয়া হতো যাতে করে ভবিষ্যতে কোনোদিন আর এ জাতীয় চেষ্টা না করে। ক্রীতদাসদের গায়ে এসব ছাপ দেওয়ার কারণ ছিল স্থানীয়রা যেন চিহ্নিত করতে পারত। উত্তর ক্যারোলিনার একজন ক্রীতদাস মালিক, তিনি তার ক্রীতদাসদের বাম গালে স্ত্রি গরম করে ছ্যাঁকা দিয়ে দিয়ে এই Fug শব্দটি লেখার চেষ্টা করেছিল। দক্ষিণ ক্যারোলিনাতে ক্রীতদাসদের শাস্তি দেওয়ার জন্য অনেক নিয়মই অনুমোদিত ছিল। যেমন যখন কোনো ক্রীতদাস পালিয়ে যেতো, এটি যদি প্রথমবার হতো তবে তাকে ৪০ টি চাবুক মারা হতো। দ্বিতীয়বার পালিয়ে গেলে তার কপালে R শব্দটি দিয়ে ছ্যাঁকা দিয়ে বোঝানো হতো Runaway Slave.
17474502_1895071330751365_9125056_n
মারুনরা ছিল পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাস কিংবা মুক্ত ক্রীতদাস। মারুনরা মূলত ছিল আফ্রিকান রিফিউজি এবং তারা পাহাড়ের ওপর বসবাস করত। তারা আমেরিকা থেকে পালিয়ে সেখানে নতুন বসতি স্থাপন করে। তাদের পরবর্তী বংশধরগণও মারুন ক্রীতদাস  বা পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাস।
বৃটিশ স্থপতি ডিজাইনার রিচার্ড বিজেন্স ৭ বৎসর ওয়েস্ট ইন্ডিজের ত্রিনিদাদে বসবাস করে ১৮৩৬ সালে লন্ডনে ফিরে আসেন এবং ক্রীতদাসদের ওপর অনেকগুলো স্কেচ করেন। তিনি এই স্কেচ সম্পর্কে বলেন, সাধারণত বাড়ির বাইরে বিশাল এস্টেটের কোনো নির্জন স্থানে পায়ে শিকল পরিয়ে তাদের এমনভাবে রাখা হতো যে তাদের নড়াচড়া করতেও সমস্যা হতো। তাছাড়া তাদের টিনের তৈরি। মুখোশও পরিয়ে রাখা হতো এবং ময়লাযুক্ত খাবার খেতে দেওয়া হতো। মুখোশ পরিয়ে দেওয়ার করণে ক্রীতদাস শুয়ে ঘুমাতে পারত না। তখন তাকে বসে থাকতে হতো।
17474558_1895070200751478_765608576_n-2
ক্রীতদাস শাস্তি চেইনঃ এটি ছিল প্রায় ৩ ফুট লম্বা একটি শিকল, যার দুই মাথায় দুটি গোলাকার আংটা থাকত। ক্রীতদাসদের পায়ের গোড়ালি বরাবর এই আংটা আটকে দেওয়া হতো। খুব শক্ত হলেও এই শিকলটি খুব ভারী ছিল না। ফলে এটি পায়ে দিয়েও ক্রীতদিস হাঁটাহাঁটি করতে পারত। ঠিক অনেকটা হয়ত ডান্ডাবেড়ি পরানো বর্তমান দাগী কোনো আসামীকে পরানো হয়।
তবে বেশি হাটাহটি করতে গেলে পায়ের সাথে লোহার ঘর্ষণে চামড়া ও মাংস ছিঁড়ে যেতো, তাই ঐসব ক্রীতদাসদের একস্থানে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকতো না। আবার অনেক সময় লম্বা কোনো শিকল দিয়ে কোনো গাছঘর সাথে বেঁধে রাখা হতো।
17467687_1895070277418137_254026135_n-2
ক্রীতদাস শাস্তি নাবোটঃ নাবোট ছিল একটি বড় গোলাকার লোহার তৈরি রিং বিশেষ, যার ওজন ছিল ৬ থেকে ১০ পাউন্ড। এটি অত্যন্ত শক্তভাবে ক্রীতদাসদের পায়ের সাথে বাঁধা থাকতো।
17495587_1895071244084707_793188256_n-2
ক্রীতদাস শাস্তি, ক্রীতদাস কলারঃ কলার লোহার তৈরি একটি পাতলা চ্যাপ্টা অর্ধগোলাকার চাকতি বিশেষ। এরকম দুটি চাকতি দু পাশ দিয়ে একত্রিত করলে গোলাকার রূপ ধারণ করে, যা ক্রীতদাসদের গলায় পরিয়ে দেওয়া হতো। এই চাকতির বাইরের দিকে তিনটি গুচ্ছ স্পাইক একত্রিত করে লাগানো থাকে। প্রতিটি গুচ্ছে আবার তিনটি করে থাকে। প্রতিটি স্পাইক লম্বায় ৪-৫ ইঞ্চি হয়। চাকতিটির সামনের দিকে আবির একটি সরু পাত থাকে। এভাবে দুই দিকের পাতটি একত্রিত করে তাতে তালা কিংবা স্ক্রু লাগিয়ে তা ক্রীতদাসের গলায় পরিয়ে দেওয়া হতো।
ক্রীতদাসদের পায়ে শিকল দেওয়ার থেকেও এটি কঠিন শাস্তি। এই কলার পরে শোয়া কিংবা ঘুমানো ছিল অসম্ভব ব্যপার। ক্রীতদাসকে সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য এটিই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত।
17474490_1895071064084725_1942437688_n-2
ক্রীতদাস শাস্তিঃ স্কার্জিংঃ স্কার্জিং ছিল একটি খুবই কঠিন শাস্তি। স্কার্জ হলো ছোট হাতলওয়ালা একটি বিশেষ ধরনের চাবুক। এই হাতলের সাথে চামড়ার তৈরি সাধারণত ৩ টি শক্ত ফিতা লাগানো থাকত। এই ফিতার গোড়ার দিকে ছোট ছোট লোহার টুকরা কিংবা অন্য কোনো ধাতু অথবা শক্ত সূচালো কাঠের টুকরো বেঁধে দেওয়া হতো। তাই স্কাজ দিয়ে আঘাত করা মাত্রই চামড়া উঠে যেত। রোমানরা অনেক সময় ছোট পাথরের বদলে লোহার হুক ব্যবহার করত এই চাবুকে ফলে চামড়ার সাথে মাংস উঠে আসত। আর এভাবে হাড় বের না হওয়া পর্যন্ত স্কাজ দিয়ে আঘাত করা হতো। এভাবে কয়েকবার আঘাত করার পরেই কালো চামড়ার মানুষগুলো রক্তে লাল হয়ে যেতো, মৃত্যেুর কোলে ঢলে পড়ত কিছুক্ষণ পরেই।
17467801_1895070860751412_1695418233_n-2
এই স্কার্জ দিয়ে শাস্তি দেবার সময় সাধারণত ক্রীতদাসদের উলঙ্গ করে দেওয়া হতো এবং তারপর একটি বড় দড়ির একপ্রান্ত দিয়ে সামনের দিকে দুই হাত বেঁধে দড়ির অপর প্রান্ত একটি বিম কিংবা গাছের ডালের সাথে এমনভাবে বাঁধি হতো যে সে শুধু কেবল তার পায়ের আঙ্গুলের উপর দাঁড়াতে পারত। এটি ছিল হতভাগ্য ক্রীতদাসদের শাস্তি দেওয়ার প্রস্তুতি।
17496274_1895072077417957_1768591382_n-2

৯০৯জন ৮৯৮জন
0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ