ক্রীতদাস শাস্তিঃ বেঁধে চাবুক মারা
ক্রীতদাস শাস্তি দেওয়ার সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি ছিল চাবুক দিয়ে মারা। ক্রীতদাস প্রভু তার বাড়ির আঙ্গিনায় একটি প্লাটফর্ম তৈরি করতেন এতে ক্রীতদাসদের বেঁধে চাবুক মারা হতো। যাতে করে চাবুক মারা সময় নড়াচড়া করতে না পারে। ক্রীতদাস নারী কি পুরুষ উভয়ের বেলাতেই উলঙ্গ করে তাকে চাবুক মারা হতো। আর অন্য ক্রীতদাসদের সম্মুখেই তা করা হতো, যাতে করে অন্যদের মনে ভীতির সঞ্চার হয়।
তবে অনেক ক্রীতদাস পালানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাদের উপর নেমে এসছে অমানুষিক নির্যাতন।
তেমনি একজন ছিলেন’গর্ডন’। গর্ডন দীর্ঘ সম মিসিপিসির এক কৃষিখামারে কাজ করছিল। তার মুক্তির কোনো আশাই সে দেখছিল না। তাই সে ১৮৬৩ সালে মুক্ত হওয়ার তীব্র বাসনায় মালিকের কৃষিখামার থেকে পালিয়ে যায়। আমেরিকার ক্রীতদাস মালিক ভূস্বামীরা তখন পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসদের ধরিয়ে আনার জন্য ব্লডহাউন্ড কুকুর পুষতো। এই কুকুরগুলোর বিশেষত্ব ছিল যে তাদের দৃষ্টির চেয়ে গন্ধ বেশি অনুভব করার শক্তি ছিল। তো গর্ডনকে ধরতেও তার মালিক প্রতিবেশি ও কুকুরসহ গর্ডনের পিছু ধাওয়া করলেন। গর্ডনও ছিল বেশ বুদ্ধিমান ক্রীতদাস। সে জানতো তাকে যখন তার ঘরে পাওয়া যাবে না মালিক এসব কুকুরদের দিয়ে তার গন্ধ শুকিয়ে পিছু ধাওয়া করবে। তাই সে পালিয়ে যাবার সময় বেশকিছু পেঁয়াজ সাথে নিয়েছিল। প্রতিবার গর্ডন কোনো খাল বা নর্দমা অতিক্রম করার পর সারা শরীরে পেঁয়াজ ঘষে নিতেন। তাছাড়া ধূলা ও কাঁদা তার শরীরে মিশে যাওয়ায় সে আর শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েননি। গর্ডন টানা ১০ দিন হেঁটে ১৩০ কিঃমিঃ পথ অতিক্রম করে লুইসিয়ানা প্রদেশে ব্যাটন রগ ইউনিয়ন সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে পৌছায়। আমেরিকার গৃহযুদ্ধকালীন সময়ে ইউনিয়ন সেনাবাহিনী তখন ফেডারেশন সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ফেডারেশন ক্রীতদাস প্রথার পক্ষে ছিল আর অন্যদিকে ইউনিয়ন ছিল বিপক্ষে। আমেরিকার লুইসিয়ানাতে তখন তাদের একটি ঘাঁটি ছিল। ইউনিয়ন ক্যাম্পে আসার পর অসুস্থ ও ক্লান্ত গর্ডনকে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে মেডিকেল চেকআপ করানোর সময় গর্ডনের পিঠে অসংখ্য চাবুকের ক্ষতচিহ্ন পাওয়া যায়। গর্ডন তাদের বলেন, তার মালিকই তাকে এমন চাবুক মারতো। এমন হয়েছিল যে তার মাংসও বিছানার সাথে লেগে যেতো। শুতেই পারতো না। দুই তিনমাস সময় লাগতো এক একবার চাবুক মারার ক্ষত সেরে উঠতে। তবুও এর ভিতরেই কাজ করে যেতে হতো।
এই পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাস গর্ডনের শুকিয়ে যাওয়া ফুলে ওঠা ক্ষত চিহ্নযুক্ত ছবিটি তোলেন ভ্রাম্যমান ফটোগ্রাফার উইলিয়াম ডি ম্যাকফারসন ও তারর সঙ্গী অলিভার। গর্ডনের পিঠের এই ক্ষতচিহ্নের ছবিটি হয়ে ওঠে ক্রীতদাস প্রথার বাতিলের জীবিত পোষ্টার। গর্ডনের ছবিটি গোটা আমেরিকাসহ গোটা বিশ্বেই আলোড়ন তোলে এবং ক্রীতদাস প্রথা বাতিলের আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। আমেরিকা গৃহযুদ্ধের সময়ে সেনাবাহিনীদের মধ্যে এই ছবি তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এই পোষ্টারটিই সারা বিশ্বের মানবতাবাদীদের এক পতাকাতলে নিয়ে আসে এবং শুরু হয় ক্রীতদাস প্রথা বন্ধের বিতর্ক ও আলোচনা। মাত্র কয়েকমাস আগেই প্রেসিডেন্ট লিংকন আফ্রিকান-আমেরিকানদের নিয়ে একটি ভিন্ন সেনা ইউনিট করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। গর্ডন সেই সেনাবাহিনীর ইউনিটের একজন প্রথমসারির সেনাসদস্যদের একজন হয়েছিলেন। আসলে গর্ডন যখন সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য আবেদন করেন তখন শারিরীক পরীক্ষার সময় তার এই ক্ষত ধরা পড়ে। তখন এই ছবির ফরমেটে অনেকগুলো কপি তৈরী করে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ক্রীতদাস প্রথার সকল আন্দোলনে গর্ডনের এই ছবিটি উপস্থাপন করা হতো। দি নিয়র্ক ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়, এই ছবিটি অন্তত ১০০,০০০কপি মুদ্রণ করে সকল প্রদেশেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এবং বাস্তবে উত্তর আমেরিকার ক্রীতদাস বিদ্রোহের মূর্তীমান প্রতীক হয়ে ওঠেন গর্ডন। তবে এইসব বিদ্রোহ ও অভিযানের সময় গর্ডন বিদ্রোহীদের হাতে একবার বন্দী হন। এবং তাকে অত্যাচার করে মরে গেছে মনে করে ফেলে রেখে যায়, কিন্তু সে যাত্রায়ও সে বেঁচে যায়। হাত পা বাঁধা অবস্থায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। পুনরায় ইউনিয়নের দলে যোগ দেন। পরবর্তীতে গর্ডন ইউনিয়ন সেনাবাহিনীর ট্রপস সিভিল ওয়ার ইউনিটে সার্জেন্ট পদে যোগ দেন। গর্ডন বীরত্বের সাথে তার কর্ম পালন করে। সত্য হলো ক্রীতদাস প্রথার বিলুপ্তির এক অন্যতম মহীরুহ ছিলেন গর্ডন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখকঃ আশরাফ উল ময়েজ
চলবে,,,,,,,,,,,,,,
২০টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
গর্ডনের ছবিটা দিলেনা কেন আপু? দেখতাম মানুষটাকে।
বহুদিন পর তোমার এই ধারাবাহিকটি পড়বার সুযোগ করে দিলে। ভালো করেই জানো ভীতিকর লাগতো ইতিহাস আমার কাছে। তুমি সহজ বানিয়ে দিচ্ছো।
অনেক ভালো থেকো শান্তসুন্দরী আপু। -{@
মৌনতা রিতু
গর্ডনের ছবিটা গতপর্বে দিয়েছিলাম দেখ। কি যে বিভৎস সেই ছবি আপু!
ইতিহাস অনেক মজার। আমার তো খুব প্রিয়।
ভাল থেকো আপু। (3 -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
আমার মামনি ইতিহাসের ভক্ত। মামনি তো ক্লাশ সেভেনের ক্লাশ টিচার ছিলো। বাংলা-অঙ্ক-সমাজবিজ্ঞান-ইংরেজি পড়াতো।
ছাইরাছ হেলাল
এ ঘটনাটি মোটেই জানতাম না,
ভালই-হলো কত্ত-কিছু জানতে পারছি, বেশি বেশি পড়তেই থাকুন!!
মৌনতা রিতু
আসলে পড়তে খুব ভাল লাগে আমার। পড়াগুলো যদি দিতে থাকি, মজাই লাগে অবশ্য।
ভাল থাকুন ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
দিন দিন, দিতে থাকুন, পড়ি-তো।
সঞ্জয় কুমার
অসাধারণ !!! রোমাঞ্চকর ইতিহাস । নতুন পর্বের জন্য সবসময়ই অপেক্ষা করে থাকবো ।
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ 🙂 শুভকামনা রইলো
নীহারিকা
অসাধারণ পোস্ট। কিন্ত কি ভয় নিয়ে যে পর্বগুলো পড়ি। গতপর্ব পুরোটা ভয়ে পড়তেই পারিনি।
মৌনতা রিতু
চশমা লাগিয়ে পড়ুন😝। ঘুরুন ঘুরুন। কেনাকাটা ভাগাভাগি হবে :p
মোঃ মজিবর রহমান
কি নিদারুন এক পথা ক্রীতদাস। মানুষ মানুষকে এভাবে অত্যাচার করতে পারে!?
পড়তে সাহসী মনের দরকার।
মৌনতা রিতু
দেখেছেন তো কতো সাহস আমার 🙂
আসলেই ভয়ংকর। ভাল থাকুন ভাই।
মোঃ মজিবর রহমান
হুম সাহসীনি বলতেই হয়। বোনটিকে
।
ইঞ্জা
উফফ কি ভয়ংকর, যারা ক্রীতদাসদের এমন করতো তারা কোন ভাবেই মানুষ ছিলো বলে আমার বিশ্বাস হয়না।
আপু আরো লিখেন, আরো জানতে চাই।
মৌনতা রিতু
ওকে ভাইজু। ভাল থাকুন। দিচ্ছি এখনই।
ইঞ্জা
আমিও যাচ্ছি দেখতে 😀
মিষ্টি জিন
মানব জাতীর ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় এই ক্রিতদাস প্রথা। কি ভয়ংকর, কি নির্মম ভাবে এদের শাস্তি দেয়া হোত।
কিছু গল্পে কিছু মুভিতে এই ক্রিতদাসদের ব্যাপারে জেনেছি। বাকিটা তোমার মাধ্যমে জানছি।
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
মৌনতা রিতু
এখনি দিচ্ছি। পড়ো। মন্তব্য শর্ট করলাম।
বাবু
লেখনী পড়তেই শরীরের পশমগুলো দাঁড়িয়ে গেলো। তখনকার দিনে ঐসব অত্যাচারী মানুষগুলি ছিল বনের হিংস্র জানোয়ারের চেয়েও হিংস্র। আরো লিখুন দিদি, আমরা জানি আপনার লেখা পড়ে ।
মৌনতা রিতু
আচ্ছা। অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।