দীর্ঘ শীতের আড়মোড়া ভেঙ্গে নিউইয়র্ক নগরীর প্রকৃতিতে এখন বসন্ত বাতাস বইছে। বাড়ির উঠোন জুড়ে ওলটপালট রোদ্দুর খেলা করে। প্রকৃতিতে ফুল ফুটতে শুরু করেছে। ডালে ডালে পাখিরা গাইছে। কখনোবা ডাল ছেড়ে উড়ে যাচ্ছে সুনীল আকাশের দিকে। পাখির গান ইদানিং কেনো যেন কান্নার মতো মনে হয়। হয়তবা নিজ মাতৃভূমিতে ক্রমান্বয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে গিয়েছে, সেই উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়। নয়তো হঠাৎ আসা প্রলয়ে লণ্ডভণ্ড হওয়া পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া চেনা-অচেনা অসংখ্য মানুষের কথা ভেবে। কিংবা যে পরিবার কোভিড- ১৯ মহামারীতে প্রিয়জন হারিয়েছে, সে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের ভয়াবহ মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কথা ভেবে। এমন ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়া আমার প্রতিবেশি জুলিয়া রবার্টের সঙ্গে দেখা হয় চলতি পথে মাঝে মাঝে পড়ন্ত বিকেলের সুনসান সময়টাতে। গত বছরের মধ্য এপ্রিলে করোনাক্রান্ত স্বামীকে হারিয়েছিল সে। অনেকদিন পর নিঃসন্তান জুলিয়া ঘরের বাইরে বেরুচ্ছে ইদানিং। ধূসর মলিনতায় ছেয়ে গেছে তাঁর রুপ লাবণ্য। কথাবার্তায় আগের সেই উচ্ছলতা নেই। সবকিছু কেমন অসংলগ্ন। হাসির গল্প করতে করতে আচমকা কেঁদে ফেলে। একাকীত্বের কথা বলে। নিঃসঙ্গতার কথা বলে। নিয়মিত মানসিক চিকিৎসা নেবার কথা জানায়।
আমরা কেউই সুনির্দিষ্টভাবে জানিনা কবে পৃথিবী তার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে। কবে মানুষ নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে বুকভরে শ্বাস নিয়ে মানুষের কাছাকাছি যাবে। গণমাধ্যমে গবেষকদের তথ্য থেকে জানা যায়, ” ভাইরাস থেকে যেসব রোগ মহামারী আকারে ছড়ায় সেগুলো বিভিন্ন কারণে এক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে করোনাভাইরাস দুর্বল হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।” প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষকে টিকার আওতায় আনা হচ্ছে। বিধায় কিছুটা স্বস্তির সঙ্গে মানুষ সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোয় যোগ দিচ্ছে। আর তা-ই কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বন্ধু নিরার সঙ্গে দেখা সাগর চায়নিজ রেস্তোরাঁয়। বলল, ‘ আমরা পরিবারের সদস্যরা যারা নিয়মিত নানাবিধ কাজে বাইরে যেতে হচ্ছে, তাঁরা ইতিমধ্যে প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছি। আমাদের দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার পরও কমপক্ষে ২ সপ্তাহ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা উচিত। কিন্তু মন তো আর মানে না। তাই এরই মাঝে রেস্তোরাঁয় ভাইবোনের পরিবারসহ খেতে এসেছি। দীর্ঘ এক বছরেরও অধিক সময় পর এমন পারিবারিক সম্মিলন হলো।’ আরেক বন্ধু ইয়াসমিন জানায় ভিন্ন কথা। দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেয়ার ২০ দিনের মাথায় সে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়। হাল্কা সর্দি আর মাথা ব্যাথা থাকায় কৌতূহলবশত বাসার পাশে হাসপাতালে টেস্ট করতে দিয়েছিল। বিকেলের দিকে জানতে পারে সে আক্রান্ত। কিন্তু স্বাদ গন্ধ সবই স্বাভাবিক ছিল। শারীরিক অসুস্থতা ছিল না। হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছিল, তাঁর আইসোলেশনে থাকার প্রয়োজন নেই।
আমরা প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছি মধ্য মার্চে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা পাওয়ার যোগ্য কিনা সেই পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সিকিউরিটির লোক আইডি চেক করে একটি রুমে পাঠাচ্ছিল সকলকে। বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি কাউকেই। টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় কিনা সেই ভয় কাজ করছিল। আমাকে যে বুথে যাবার জন্যে বলা হয়েছিল, কৃষ্ণাঙ্গ বিশালদেহী এক নার্স সেখানে প্রয়োজনীয় সারঞ্জামাদি নিয়ে অপেক্ষমান ছিলেন। দন্ত বিকশিত হাসিতে স্বাগত জানায় সে। এমন নির্মল হাসিতে আমার ভয়ডর উবে যায়। সব কর্ম সম্পাদন শেষে কিছু সময় বসিয়ে রাখা হয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় কিনা দেখার জন্যে। মধ্য এপ্রিলে দ্বিতীয় ডোজের জন্যে অ্যাপয়েনমেন্ট দিয়ে একটি কার্ড হাতে ধরিয়ে দেয়।
চলমান মহামারীর এক বছর পেরিয়ে গেল। কেমন করে যেন রাতারাতি বদলে গেল আমাদের যাপিত জীবন। কিন্তু তাই বলে পৃথিবীর কোনোকিছুই থেমে নেই। হতাশা, মানসিক চাপ এবং একঘেয়েমি কাটাতে মানুষ বেড়াতে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে করে ল্যাপটপ নিয়ে যাচ্ছে। আমার এক পুরনো সহকর্মীকে জানি, যে বেড়ানোর জায়গাগুলোতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ চালিয়ে নিচ্ছে। কথাপ্রসঙ্গে জানায়, হোটেলগুলো ভাড়ায় মূল্যছাড়ের আকর্ষণীয় অফার দেয়ায় সে অবকাশ যাপনের কেন্দ্র থেকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। হোটেলরুমের স্বচ্ছ কাঁচের ভেতরে বসে সমুদ্রের নীল জলরাশির কাছাকাছি থাকছে, কিন্তু চোখ রাখছে ল্যাপটপে। এতে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য চাঙ্গা থাকে বলে জানায়।
শীতপ্রধান এই দেশে আমরা মুখিয়ে থাকি বসন্ত আগমনের। আমাদের এখন মুখরিত সময় কাটানোর কথা। চারিদিকে নানাবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকার কথা কমিউনিটির সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষেরা। বৈশাখ, ঈদ, বইমেলা, আরও কত কী! কিন্তু এরই মাঝে বসন্ত, একুশ, স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানগুলো সবই হলো ভার্চুয়াল। আমরা প্রবাসীরা এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। এই যে মহামারী আমাদের নতুন এক বাস্তবতার দিকে, কৌশলী জীবনাচরণের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, এটিই এখন আমাদের নব্য স্বাভাবিকতা। এই স্বাভাবিকতাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা গেয়ে চলি জীবনের গান। কেননা আমরা যে তুমুলভাবে ভালোবাসি জীবন! ভালোবাসি এই বেঁচে থাকা। আমাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে জীবন যখন যেখানে যেমন, সেখানে তেমনভাবেই আনন্দে বাঁচতে শিখে গিয়েছি। অনেকটা কবিগুরুর সেই গানের মতো, জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণাধারায় এসো…।
সামনে মাহে রমজান। সিয়াম সাধনার পবিত্র এই মাসে আসুন আমরা স্রষ্টার কাছে প্রার্থনারত হই পৃথিবীর রোগমুক্তির।
রিমি রুম্মান
কুইন্স, নিউইয়র্ক
৯টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি
স্রষ্টা যেন আমাদের হেফাজত করেন।আমীন।
ছাইরাছ হেলাল
অবশ্যই আমরা স্রষ্টার কাছে করুনা ভিক্ষা করি, তিনি যেন আমাদের উৎরে দেন
সব বেদনা থেকে।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আল্লাহ ছাড়া সামনে আর কোন উপায় নেই।
শুভ কামনা।
হালিমা আক্তার
একমাত্র আল্লাহই পারেন আমাদের রক্ষা করতে | তিনি আমাদের সকলের সহায় হোন |
তৌহিদুল ইসলাম
সৃষ্টিকর্তার সকল দুরবস্থা কাটিয়ে পুরো বিশ্বকে আবার শান্তিময় করে তুলুন এটাই প্রার্থনা। আপনারাও ভালো থাকেন আপু।
নববর্ষ এবং মাহে রমজানের শুভেচ্ছা রইল।
আরজু মুক্তা
পুরা বিশ্ব আবার আগের মতো স্বাভাবিক হোক।
আমিন
সুপর্ণা ফাল্গুনী
স্বাভাবিক জীবন যাত্রা কবে যে পাবো এই অনিশ্চয়তা নিয়েই বেঁচে আছি বেঁচে থাকার লড়াইয়ে। সাবধানে থাকুন সুস্থ থাকুন। পহেলা বৈশাখের অফুরন্ত শুভেচ্ছা ও শুভকামনা
সৌবর্ণ বাঁধন
দুঃসময়ের দিনগুলো অদ্ভুত। ভালো বা খারাপের হিসাব নয় বরং এক চরম অনিশ্চয়তা ধূসর করে দিচ্ছে আমাদের প্রতিদিনের জীবন। অত্যন্ত সাবলীল গদ্যটি করোনা কালের প্রতিবিম্ব হয়ে থাকুক।
জিসান শা ইকরাম
করোনার কারনে থমকে গিয়েছে জীবন, চেনা জানা অনেকেই এই মায়াময় জগত হতে বিদায় নিয়েছে।
কিভাবে এই প্রাণঘাতী মহামারী থেকে পৃথিবী মুক্ত হবে জানি না।
দূর হয়ে যাক করোনা, পৃথিবী ছন্দ ফিরে পাক আবার।