
আমরা জানি কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটা ইউনিয়ন। আজকে আমার পোষ্ট হলো তার উল্টো চিত্র নিয়ে। মানে আমি বলতে চাচ্ছি ১৫টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচং এর কথা। বানিয়াচং এ আমার যাত্রা মুলত “কমলা রাণীর সাগর দীঘি” দর্শন করার জন্যই। যাকে নিয়ে রয়েছে একটা অবিশ্বাস্য মিথ।
মিথ বা লোক কাহিনীটি এরকম- বানিয়াচং-এর পদ্মনাত রাজা বিয়ে করে প্রাসাদে তুলেছিলেন তরফ অঞ্চলের রাজকুমারী কমলাবতীকে। রূপবতী ও গুণবতী রাণীর প্রশংসায় কিছুদিনের মধ্যেই পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে প্রজারা। রাণীর ঘরে এক পুত্র সন্তান জন্ম নেয়ার পর পরই একদিন রাজা স্বপ্নে দেখেন- কে যেন তাকে একটা বড় দীঘি খনন করার আদেশ করছে। রাজা পরপর তিন রাত একই স্বপ্ন দেখে অবশেষে গন্ডমালীকে আদেশ দিলেন একটি বড় দীঘি খননের। তখন সাগরের মতো বিশাল এক দীঘি খনন করা হয়, তাই এর নাম হয় সাগর দীঘি । এদিকে রাজার হিংসুটে ছোট বোন কেউকা গন্ডমালীকে অর্থের লোভ দেখিয়ে দিঘির প্রথম কোপ রাণী কমলাবতীর নামে উঠাতে রাজী করায়। এক সময় দীঘি খননের কাজ শেষ হলে দীঘিতে পানি উঠছেনা দেখে রাজা দুশ্চিন্তায় পড়েন। রাণী এবার স্বপ্নে দেখলেন- এ দীঘিতে তিনি আত্মদান করলেই কেবল তাতে পানি উঠবে। এটা কেউ মেনে না নিলেও প্রজাদের পানির চাহিদার কথা চিন্তা করে রাণী কমলাবতী নিজেই সিদ্ধান্ত নেন- তিনি আত্মাহুতি দেবেন এবং সত্যি সত্যিই একদিন সুসজ্জিত হয়ে রাণী দিঘিতে নেমে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। রাণী যতো এগোন ততো পানি বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে এক সময় রাণী কমলাবতীর পুরো শরীরই পানির মধ্যে তলিয়ে যায়। আত্মদানের এ অসামান্য কাহিনীর ওপর ভিত্তি করেই সাগর দীঘিকে অনেকে কমলা রাণীর দীঘি নামেও অবহিত করেন।
এ দিঘি নিয়ে বাংলা ছায়াছবিসহ রেডিও মঞ্চ নাটক রচিত হয়েছে। এর পাড়ে বসে পল্লী কবি জসিমউদ্দিন ‘রাণী কমলাবতীর দিঘি’ নামে একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। সে কবিতাটি তার ‘সূচয়নী’ কাব্য গ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।
(২/৩) হবিগঞ্জ থেকে বানিয়াচং যাওয়ার পথে বাম দিকে সাতাই নদীতে জাল কিংবা বর্ষি দিয়ে মাছ ধরার এমন চিত্রগুলো বেশ মন কারে।
(৪/৫) চোখে পড়ে এমন গরু রাখালের পদচারণা। দেখে সত্যিই মনটা ভরে যায়।
(৬) বানিয়াচং এর একেবারে উপকন্ঠে এই ব্রীজটিকে বলে শুটকি ব্রীজ। নিচের সরু নদীটার নাম শুটকি নদী।
(৭) হবিগঞ্জ থেকে বানিয়াচং যাওয়ার গাড়িগুলোও কিন্তু বেশ।
(৮/৯) দুই পাশের এমন দেখেই বুঝা যায় বানিয়াচং সত্যিই অসাধারণ সুন্দর।
(১০) এক সময় আমরা চলে এলাম কাঙ্খিত সাগর দীঘির পাড়ে।
(১১) এত দূর থেকে এসে সাগরের পানির একটু স্পর্শ না নিলে কি হয়?
(১২/১৩) দীঘির মাঝামাঝি স্থানে দাড়িয়ে দুই দিকের দুটি ছবি। কথিত আছে দীঘির দৈর্ঘ ২ কিলোমিটার আর প্রস্থ্য ১ কিলোমিটার। বাস্তবে বর্তমানে ইহা আরো অনেক ছোট।
(১৪/১৫) মাছ ধরা, হাড়ি-পাতিল ধোয়া, গোসল সবই এলে কমলা রাণীর এই দীঘিতে।
(১৬) দীঘির শেষ প্রান্তে গাছের শেকড়ে বসে এই মিথের কথা ভাবলে মনটা কোথায় কোন সুদূরে হারিয়ে যা…….
সব শেষে এই দীঘি দেখতে গিয়ে পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের কবিতাখানি…….
——————————————————————–
কমলা রাণীর দীঘি ছিল এইখানে,
ছোট ঢেউগুলি গলাগলি ধরি ছুটিত তটের পানে।
আধেক কলসী জলেতে ডুবায়ে পল্লী-বধূর দল,
কমলা রাণীর কাহিনী স্মরিতে আঁখি হত ছল ছল।
আজ সেই দীঘি শুকায়েছে, এর কর্দমাক্ত বুকে,
কঠিন পায়ের আঘাত হানিয়া গরুগুলি ঘাস টুকে।
জলহীন এই শুষ্ক দেশের তৃষিত জনের তরে।
কোন সে নৃপের পরাণ উঠিল করুণার জলে ভরে।
সে করুণা ধারা মাটির পাত্রে ভরিয়া দেখার তরে,
সাগর দীঘির মহা কল্পনা জাগিল মনের ঘরে।
লক্ষ কোদালী হইল পাগল, কঠিন মাটিরে খুঁড়ি,
উঠিল না হায় কল-জল-ধারা গহন পাতাল ফুঁড়ি।
দাও, জল দাও, কাঁদে শিশু মার শুষ্ক কন্ঠ ধরি,
ঘরে ঘরে কাঁদে শূন্য কলসী বাতাসে বক্ষ ভরি।
লক্ষ কোদালী আরো জোরে চলে, কঠিন মাটির থেকে,
শুষ্ক বালুর ধূলি উড়ে বায় উপহাস যেন হেঁকে।
কোথায় রয়েছে ভাট ব্রাক্ষণ, কোথায় গণক দল,
জলদী করিয়া গুনে দেখ কেন দীঘিতে ওঠে না জল?
আকাশ হইতে গুণিয়া দেখিও শত-তারা আঁখি দিয়া,
পাতালে গুণিও বাসকি-ফণার মণি-দীপ জ্বালাইয়া।
ঈশানে গুণিও ঈশানী গলের নর-মুন্ডের সনে,
দক্ষিনে গুনো, শাহ মান্দার যেথা সুন্দর বনে।
আকাশ গণিল, পাতাল গণিল, গলিল দশটি দিক,
দীঘিতে কেন যে জল ওঠেনাক বলিতে নারিল ঠিক।
নিশির শয়নে জোড়মন্দিরে স্বপন দেখিছে রাণী,
কে যেন আসিয়া শুনাইল তারে বড় নিদারুণ বানী;
সাগর দীঘিতে তুমি যদি রাণী! দিতে পার প্রাণদান,
পাতল হইতে শত ধারা-মেলি জাগিবে জলের বান।
স্বপন দেখিয়া জাগিল যে রাণী, পূর্বের গগন-গায়,
রক্ত লেপিয়া দাঁড়াইল রবি সুদূরের কিনারায়।
শোন শোন ওহে পরাণের পতি ছাড় গো আমার মায়া,
উড়ে চলে যায় আকাশের পাখি পড়ে রয় শুধু ছায়া।
পেটরা খুলিয়া তুলে নিল রাণী অষ্ট অলঙ্কার,
রাসমন্ডল শাড়ীর লহরে দেহটি জড়াল তার।
কৌটা খুলিয়া সিঁদুর তুলিয়া পরিল কপাল ভরি,
দুর্গা প্রতিমা সাজিল বুঝি বা দশমীর বাঁশী স্মরি।
ধীরে ধীরে রাণী দাঁড়াইল আসি সাগর দীঘির মাঝে,
লক্ষ লক্ষ কাঁদে নরনারী শুকনো তটের কাছে।
পাতাল হইতে শতধারা মেলি নাচিয়া আসিল জল,
রাণীর দুখানা চরণে পড়িয়া হেসে ওঠে খল খল।
খাড়ু জলে রাণী খুলিয়া ফেলিল পায়ের নুপূর তার,
কোমর জলেতে ছিড়িল যে রাণী কোমরে চন্দ্রহার।
বুক-জলে রাণী কন্ঠে হইতে গজমতি হার খুলে,
কোরের ছেলেটি জয়ধর কোথা দেখে রাণী আঁখি তুলে।
গলাজলে রাণী খোঁপা হতে তার ভাসাল চাঁপার ফুল।
চারিধার হতে কল-জলধারা ভরিল দীঘির কূল।
সেই ধারা সনে মিশে গেল রাণী আর আসিল না ফিরে,
লক্ষ লক্ষ কাঁদে নরনারী আকাশ বাতাস ঘিরে।
* * *
কমলা রানীর এই সেই দীঘি, কার অভিশাপে আজ,
খুলিয়া ফেলেছে অঙ্গ হইতে জল-কুমুদীর সাজ।
পাড়ে পাড়ে আজ আছাড়ি পড়ে না চঞ্চল ঢেউদল,
পল্লী-বধূর কলসীর ঘায়ে দোলে না ইহার জল।
কমলা রাণীর কাহিনী এখন নাহিক কাহারো মনে,
রাখালের বাঁশী হয় না করুণ নিশীথ উদাস বনে।
শুধু এই গাঁর নূতন বধূরে বরিয়া আনিতে ঘরে,
পল্লীবাসীরা বরণ কুলাটি রেখে যায় এর পরে।
গভীর রাত্রে সেই কুলাখানি মাথায় করিয়া নাকি,
আলেয়ার মত কে এক রূপসী হেসে ওঠে থাকি থাকি।
২৫টি মন্তব্য
সুপায়ন বড়ুয়া
সুন্দর উপস্থাপনা আর প্রচ্ছদ ছবি দিয়ে
কমলা রানীর সাগর দিঘী খুব ভাল লাগলো।
শুভ কামনা।
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ দাদা, আপনার জন্যও শুভ কামনা সব সময়।
ছাইরাছ হেলাল
প্রায় অজানা আখ্যান পড়লাম দেখলাম।
বোনাস আমাদের পল্লী কবির কবিতা।
১৬ নং ছবিটি খুব সুন্দর।
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ বড় ভাই, এমন অজানাগুলো আমাকে চুম্বকের মতো টানে সব সময়। তাই তো সুযোগ পেলেই আমার ছুটে চলা……শ্রদ্ধা জানবেন ভাই।
তৌহিদ
বাহ এসবতো আমার কাছে অজানাই ছিলো। আজ জানলাম অনেককিছু। ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য ভাই। অনেকদিন পরে পল্লীকবির কবিতা পড়লাম।
ছবিগুলি অসাধারণ। দারুণ পোস্ট ভাই।
কামাল উদ্দিন
শুভেচ্ছা জানবেন তোহিদ ভাই, আপনাদের এমন উৎসাহ আমাকে অনুপ্রেরণা যোগায় সব সময়…..ভালো থাকবেন।
ফয়জুল মহী
অনন্যসাধারণ লেখা। শুভেচ্ছা । দোয়া রইলো আপনিও করবেন।
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ ভাই, ভালো থাকবেন।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
১০, ১৬ নং ছবি দুটি খুব ভালো লেগেছে। পল্লী কবির কবিতাখানি দিয়ে ষোলো কলা পূর্ণ করলেন। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ আপু, দোয়া করবেন ভবিষ্যতে যেন ১৭ কলা পূর্ণ করতে পারি 😀
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অবশ্যই দোয়া রইলো শুধু সতেরো না আঠারো, বিশ, ….. সেঞ্চুরি করেন।
সুরাইয়া পারভীন
সত্যিই কী রাণী আত্মহুতি দিয়েছিলেন নাকি এটি কল্পকথা মাত্র?
৮/৯ ছবিতে চোখ জুড়িয়ে যায়। সবগুলো ছবিই দারুণ
কামাল উদ্দিন
পুরোনো দিনের এমন মিথগুলো শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না।
নীরা সাদীয়া
বাহ্, এই ইতিহাস জানা ছিলো না। জেনে ভালো লাগলো। খুব সুন্দর কাহিনির বর্ণনা করলেন।
কামাল উদ্দিন
ইতিহাসে সত্যটা কতটা আছে সেটা অবশ্য ভাববার বিষয় আপু, শুভ কামনা সব সময়।
সঞ্জয় মালাকার
লেখা ও ছবি গুলো অসাধারণ লেগেছে দাদা,
কমলা রানীর সাগর দিঘী খুব ভাল লাগলো।
আপনার জন্য শুভ কামনা রইলো 🌹🌹
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ দাদা, সব সময় আমার পোষ্টে আপনার এমন উপস্থিতিতে সত্যিই অনুপ্রাণিত হই।
সঞ্জয় মালাকার
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় দাদা,
শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা নিবেন।
ভালো থাকবেন সব সময় শুভ কামনা।
সাবিনা ইয়াসমিন
ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম আমাদের দেশে অবস্থিত। আমি এটা জানতাম না। আপনার পোস্টের মাধ্যমে জানা হলো। রানী কমলাবতীর গল্প আমি পড়েছিলাম ক্লাস সেভেনে। ওটাকে রুপকথার গল্পই ভাবতাম। তবে গল্পের শেষটা পড়ে তখন খারাপ লেগেছিলো। দীঘিটা সত্যিই খুব সুন্দর। ঢেউগুলো শান্ত দেখাচ্ছে ছবিতে।
এই আবদ্ধতার দিন গুলোতে এমন পোস্ট পড়তে ভালো লাগে। মনে হয় একটু সময়ের জন্যে হলেও কোথাও থেকে ঘুরে এলাম।
ধন্যবাদ ভাই, ভালো থাকুন সবসময়।
শুভ কামনা 🌹🌹
কামাল উদ্দিন
মনটা বড় ছটফট করছে আপু। করোনার থাবায় আমাদের সব ছাড়খাড় করে দিল। শুভ কামনা জানবেন।
নিতাই বাবু
কমলা রাণীর সাগর দীঘি নিয়ে বিস্তারিত কিছুই জানা ছিল না, দাদা। শুধু এই নয়, আপনার ভ্রমণ পোস্ট এবং ছবি পোস্ট হতে অনেককিছুই জানা হলো। আশা করি আরও অনেক অনেক জানতে পারবো। সত্যি ছবি আর লেখায় অসাধারণ উপস্থাপন।
প্রার্থনা করি এই সময়ে সপরিবারে সবাই সুস্থ থাকুন, ঘরে থাকুন!
কামাল উদ্দিন
ঘরেই আছি দাদা, কিন্তু মনটা বড়ই উতলা……শুভ কামনা জানবেন।
হালিম নজরুল
অসম্ভব রকমের ভাল লাগল ভাই।
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ নজরুল ভাই, ভালো থাকুন সব সময়।
রেহানা বীথি
ভাই, এতকিছু জানতাম না, সত্যিই অভিভূত হলাম। ছবিগুলো দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। পল্লী কবি জসিম উদ্দীনের কবিতাটি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। আবার পড়তে পারলাম আপনার কল্যাণে।
ভালো থাকবেন ভাই সবসময়।