
সক্কাল সক্কাল মেজাজটা বিগড়ে বকর বকর করেই যাচ্ছে মা। সবজিগুলো চটের থলে থেকে বেসিনের পাশে রাখতে রাখতে দীপার সাথে গরম গরম বাক্যব্যায়ে ব্যস্ত হাত চালাচ্ছে। দীপা ও মধ্যম গলায় জবাব দিয়ে যাচ্ছে আর মায়ের কাজে হাত লাগাচ্ছে।
: দীপা
: ও সুতপা দি! এসো না, বসো!
: নারে, কাল যে আচার দিয়েছিলি! বাটি টা দিতে এলাম। নে ধর।
কোলে আট মাসের ছেলেটার কান্না থামাতে থামাতে সুতপা’দি বেরিয়ে গেলো।
: ও কবে এলো রে?
মা জিজ্ঞেস করলো সুতপাকে উদ্দেশ্য করে।
: গত পরশু । বরের সাথে ঝগড়া করে চলে এসেছে।
: ঝগড়া করে চলেই যদি আসবে, তো পালিয়ে গিয়েছিলো কোন সুখে?
: মা! কেউ কি আর আগে থেকে বুঝতে পারে? মেয়েরা প্রেমে পড়লে এতশত ভাবে নাকি?
মা যেন রণমুর্তি হয়ে উঠলো। মুখ আর গলার জোড় বাড়িয়ে দিয়ে দু’কথা অকথ্যকথন ঝেড়ে দিলেন গল গল করে। যোগ করতে ছাড়লেন না-
: আর তুই এত আজকাল প্রেম- ভালবাসা নিয়ে বুলি কপচাচ্ছিস কেন বলতো? তুই যদি এমন পালিয়ে বিয়ে করার কথা ভাবিস তো, মেরে তোর ঠ্যাং ভেঙে ঘরে বসিয়ে দেবো জেনে রাখ।
দীপা ঘুরে মায়ের মুখের তাকিয়ে হেসে দিলো-
: আমি কি অমন গরীব কারো সাথে পালাবো ভেবেছো? আমি পালালে বড়লোক ছেলের সাথেই পালাবো। গাড়ি হবে, বাড়ি হবে, নিত্যনতুন শাড়ি গহনা!
লাল শাড়ির কালো পাড় গোঁজা কোমড়ের কাছে, মা তখন এক হাতে কিনে আনা টমেটো হাতে নিয়ে ঘোরাচ্ছেন, আরেক হাত কোমড়ে রেখে মাথা উপর নিচে দোলাচ্ছেন, দীপার কথা শেষ হতেই সজোড়ে ছুঁড়ে মারলেন দীপার মুখের উপরে…..
ডানপিটে দীপা মুখ হা করে মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন, ছুট দিলো বস্তির অন্য ছোটো ছোটো বালক দলের সাথে ডাঙ্গুলি খেলতে। সরু রাস্তার ধার ঘেসে খোলা মাঠে ছুটাছুটি করে পেটাচ্ছে ডাঙ্গুলি। ডাঙ্গুলির ছোট কাঠের টুকরোটা হঠাৎ গিয়ে উড়ে পড়লো রাস্তা দিয়ে চলন্ত মোটরবাইকে রাতুলের গায়ে। বাইক থামিয়ে রাতুল ক্যাবলাকান্তের মতো তাকিয়ে আছে তো তাকিয়েই আছে দীপার দিকে। দীপা পারে তো আধাহাত জিভ বের দুই দাঁতের মাঝখানে কেটে ফেলে। মালকোচা করে দোপাট্টা কোমড়ের কাছে গিট্টু মারা, কমলা হলুদ রঙা সালোয়ার কামিজে দীপাকে জ্বলন্ত অগ্নিস্ফুলিঙ্গ লাগছে। রাতুল যেন দুনিয়ার তাবৎ কোলাহল ভুলে অচেতন হয়ে আটকে গেছে দীপাতে। দীপা সামলে নিয়ে বাইকের কাছে এসে গলা চড়ালো……
: পাঁচশ টাকা ধার নিয়েছি বলে সময় নেই অসময় নেই যখন তখন তাগাদা দিতে আসতে হবে? কাল বিকেলে বাড়ি চলে এসো, দিয়ে দেবো।
রাতুল দাঁত কেলানো হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোফের মাঝখানে। গটগট করে সামনে থেকে চলে গেলো দীপা। রাতুল গমন পথের দিকে চক্ষু বিছিয়ে রাখলো বাইকের হাতলে হাত রেখে। বাড়ি যেতে বলেছে দীপা কাল টাকা আনতে। টাকা গোল্লায় যাক। দীপাকে আবার দেখতে পাবে ভেবেই চোখের তারায় ভীড় করতে শুরু করেছে চঞ্চল প্রজাপতির অগনিত রঙের মেলা। ঝাকড়া চুলো নিমাই সেই চোখের সামনে এসে রঙ ধুয়ে দিয়ে দাঁড়ালো। মাছি তাড়াবার মতো হাত ওড়ালো বাতাসে রাতুল।
নিমাই বলে উঠলো-
: জানে বেঁচে থাকতে চাস তো ভুলেও ও বাড়ি যাসনে কাল। টাকা তো দুরে থাক। দীপার দিকেও আর অমন করে তাকাস না।
রাতুলের কপালের চামড়ায় আগোণা ভাঁজ পরলো। চোখদুটো কুঁচকে গেলো নিমাইয়ের কথায়। কপালের ভাঁজে আর চোখে প্রশ্নের ছবি সেঁটে তাকালো নিমাইর দিকে।
: ও দীপা ভবতোষের বোন। চিনিস তো ভবতোষ কে?
ম্যাটিনি শো দেখে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরছিলো দীপা ওর আরো দুই বান্ধবির সাথে। তাপস, সুভাস, নিরঞ্জন, তপন এরকম আরো কয়েকজন সেদিন দীপা আর তার বান্ধবিদের টিজিং করছিলো পেছন থেকে। যমদূতের মতো হাজির হয়েছিলো সামনে ভবতোষ।
: কার দিকে অমন খিস্তি ছাড়লি রে মদনার দল? গোলাপি জামা পড়া মেয়েটাকে চিনিস তোরা কেউ?
তাপস জবাব দেবার সময় পায়নি। দাঁড়ি কাটা ক্ষুর আচমকা কপালের বাঁপাশ থেকে উপর হয়ে ত্যাছড়া ভাবে নেমে এসেছে ডানপাশের চোঁয়াল চিড়ে দিয়ে। বিভৎস চেহারা নিয়ে তাপস আজো ঘুরে বেড়ায় অন্য পাড়ার সীমানায়। দীপার ছায়া দেখলেও উল্টোদিকে দৌঁড়ে পালায়।
পুলিশ কোর্টকাচারি করার সাহসই হয়নি কারো! ভবতোষের নামে কাঁপে আশপাশের এলাকা।
ঠান্ডা গলায় নিমাই বর্ণনা করে গেলো রাতুলকে। রাতুল চোয়াল শক্ত আর সাপের মতো ঠান্ডা চোখে সব শুনে গেলো মুখে কিছুই বললো না।
দীপার মনে দাগ কাটার মতো চোখ আটকে যায়না যে কাউকে দেখে। স্বপ্ন দেখে যায়… কেউ হয়তো নিশ্চই কোথাও আছে…যাকে নিয়ে পালাবে শাড়ি গহনা বাড়ির বড়লোকি কোনো প্রেমিকের হাত ধরে। দীপা জানেনা প্রেম আর ভালবাসার মধ্যে ভালবাসা কারে কয়!
২২টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
যাক, এবারের লেখা পাঠক মন দিয়েই পড়তে পারবে বলে মনে করি।
প্রেম নামক অলীক ভালোবাসাবাসি কারে কয় সে রহস্য আজো উদ্ঘাটিত হয়েছে এমন কথা কেউ বলছে না।
বন্যা লিপি
প্রেম ভালবাসাবাসির রহস্য সব মনই খুঁজে চলছে অনাদিকাল ধরে। এটাও ঠিক যে, কেউ কেউ প্রেম এবং ভালবাসার আলাদা আলাদা নিজেদের মতো করেই ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। কারো মনে ধরলে বলেই ফেলেন, ” আসলে প্রেম এটা আর ভালবাসা ওটা” পরবর্তী লেখায় না হয় সেরকম কিছু লেখার চেষ্টা করা যেতেই পারে।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
বাপরে বাপ কি ভয়ানক ভাই! তবে ছোট গল্পে অনেক কিছু বলে দিলেন আপু বিশেষ করে মা -মেয়ের এমন কথার ঝাড়িঝুড়ি আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। ” ঝগড়া করে যদি চলেই আসবে তো পালিয়ে গিয়েছিলো কোন সুখে?” লাইনটা মনে হয় এমন হবে আপু , তাইনা? যদি টা আগে বসবে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা রইলো
বন্যা লিপি
আমি যখন কথপকথন স্টাইলটা ধারন করে লেখার চেষ্টা করি, তখন প্রতিটা চরিত্র নিজের মতো করে উপস্থাপন করতে পছন্দ করি সবসময়। মায়ের উচ্চারিত শব্দগুলো আপনি একটু বলার ঢংয়ে উচ্চারন করে দেখুন আমার লেখার ঢংয়ে! দেখবেন একদম ঠিক আছে, আমি ইচ্ছে করেই আগে পরে শব্দ বসিয়ে মা’য়ে একটা চেহারা উপস্থাপন করেছি। আমার চোখে তাই ছিলো। মন্তব্যে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন সবসময়।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
এই না হলে বন্যা আপু! সবকিছুতেই অন্যরকম সাধ পাবোই। ধন্যবাদ আপু। ভালোবাসা অবিরাম
সুপায়ন বড়ুয়া
প্রেম আর ভালবাসার মধ্যে ভালবাসা কারে কয় এইটা এখনো হয়নি জানা। দীপা যদি জানতে পারে তাহলে আমাদের ও জানা।
ভাল লাগলো শুভ কামনা।
বন্যা লিপি
ভালো থাকবেন। শুভ কামনা দাদা।
ফয়জুল মহী
সাবলীল সুন্দর উপস্থাপন । ভালো থাকুন।
বন্যা লিপি
ধন্যবাদ।আপনিও ভালো থাকুন।
সাদিয়া শারমীন
বাহ সুন্দর গল্প তো! ভালো লাগলো বেশ।
বন্যা লিপি
ধন্যবাদ।শুভ কামনা। ভালো থাকুন।
প্রদীপ চক্রবর্তী
বেশ ভালো লিখলেন দিদি।
দীপা জানলে আমাদেরও জানা হয়ে যাবে।
বন্যা লিপি
দীপার আগে মহা দীপারা জানতে পারেনাই তো আজকের দীপা কবে জানবে?
ভালো থেকো দাদা ভাই।শুভ কামনা।
পার্থ সারথি পোদ্দার
দীপার মেজাজে ভাই ভবতোষ রাতুলের চেয়ে ভালো ছেলে আর কি পাবে!ভালো লাগল,আপু।
বন্যা লিপি
ভাববার বিষয়! ধন্যবাদ।ভালো থাকবেন।
তৌহিদ
মা মেয়ের এমন কথোপকথন লেখায় উপস্থাপন করা চাট্টিখানি কথা নয়। মনে হয় মানসচক্ষে দেখছি সব সামনাসামনি। গল্প কিন্তু দারুন লেখেন আপনি আপু।
শুভকামনা সবসময়
বন্যা লিপি
ভাই, আমিও একটা মেয়ে লালন পালন করে বড় করে বিয়ে দিয়েছি অলরেডি। সে জায়গা থেকে এই দৃশ্য চিত্রায়িত করা আমার জন্য মজার বিষয় ছিলো। আমার ধারাবাহিক মা” পর্বে পরবর্তীতে কিছু কিছু এনেছি ইতিমধ্যে, আরো আনার ইচ্ছে আছে আগামীতে যদি বেঁচে যাই….
আপনার মন্তব্য আমার প্রেরনা হয়ে রইলো ভাই। অনেক কৃতজ্ঞতা। ভালো থাকবেন।শুভ কামনা।
বন্যা লিপি
দেখেন মন্তব্যে ভুল লিখলাম।এনেছি / পরবর্তীতে আরো কিছু আনার ইচ্ছে আছে।
হালিম নজরুল
আসলেই প্রেমে পড়লে কেউই অতশত ভাবে না।
বন্যা লিপি
বিয়ের পরই প্রেমিক আর প্রেমিক থাকে না, স্বামী হয়ে যায়। ভালবাসা/প্রেম জানলা দরজা খোঁজে পালবার। সুতপারা তখন স্বামীর ঘর ছেরে দিতে বাধ্য হয়।মন্তব্যে ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
সত্যিকারের ভালোবসার সত্যি অভাব
বন্যা লিপি
ওইটাইতো কেউ জানেনা, ভালবাসা কারে কয়? ধন্যবাদ ভাস্তি। ভালো থাকুন সবসময়।