শুভ দীপাবলি এবং শ্যামা মায়ের পুজোর শুভেচ্ছা...
শুভ দীপাবলি এবং শ্যামা মায়ের পুজোর শুভেচ্ছা…

আচ্ছা এই যে এলোমেলোভাবে অনেক কথা বলে যাই, আর যাঁরা পড়েন আমি ভাবি কেউ না কেউ তো বিরক্ত হয়েই থাকেন। কেউবা আবার খুব পছন্দও করেন। মাঝে-মধ্যে আমি সেই পছন্দ কিংবা অপছন্দের ঊর্ধ্বে উঠে লিখতে থাকি। কারণ এসব এলোমেলো কথার মধ্যেই এই সত্যিকারের আমি’টা যে থাকে। এই অক্ষরগুলোতে কোনো উপমা কিংবা ভণিতা কিছুই থাকেনা। শুধু পুরোনো দিনের অনেকগুলো সময়ের কিছু স্মৃতি থাকে। যেমন রবিবারে দীপাবলি উৎসব। ছোটবেলায় আমরা বলতাম দীপান্বিতা। কি যে আনন্দ এই উৎসবকে ঘিরে। স্নান সেরে নিয়ে নতূন জামা পড়ে সাধু-ক্ষিরোদের সাথে বাগানের ছোট্ট ছড়াতে(বাগানের ভাষায় খালকে ছড়া বলা হয়) যেতাম। ওখানে চৌদ্দ পুরুষের বাতি দেয়া হতো। মনে পড়ে বিকেল থেকেই মামনি সলতে তৈরীতে লেগে যেতো। চোখের নিমিষে প্রায় কয়েক’শো সলতে মাটির প্রদীপে সাজাতো। অবাক হয়ে যেতাম, এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে করে মামনি? আমাদের বাসায় দীপান্বিতার সময় বেশ কয়েকবার বরিশালের মা(দিদিমা) ছিলো। বরিশালের মা থাকাকালীন মামনিকে এসব করতে হতোনা। আসলে বরিশালের মা বলতো রেষ্ট নিতে। তখন মনে মনে ভাবতাম মামনিকে তো কেউ রেষ্ট নিতে বলেনা!

এই চৌদ্দপুরুষের বাতি আমার হাত দিয়েই ভাসিয়ে দেয়া হতো। কেউ কেউ বলতো মেয়েদের এটা করতে নেই। মামনি বা বাপি কখনোই ওসব মানেনি। যখন বেশ বড়ো হলাম মামনিকে বললাম এসব আমার একেবারেই পছন্দ না। চৌদ্দপুরুষ কি একা বংশের জন্ম দিয়েছে? মামনি কিছু বলেনি। তবে বরিশালের মা বলেছিলো, “সোনু কিছু নিয়ম আছে, যার কোনো দরকারই নেই। তবুও আছে। কারণ এসবের পরিবর্তন কেউই জীবনেও আনতে পারবেনা। এটাও একধরণের নিয়ম যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তুই বদলানোর চেষ্টা করবি, আসল ফল পাবিনা। দেখা যাবে তোকেই বের করে দিয়েছে সমাজ।” সত্যি বলতে কি বরিশালের মায়ের আধুনিক মন-মানসিকতাসম্পন্ন একজন মানুষ আমি কমই দেখেছি। ক্লাশ এইট পাশ করে বিয়ে হওয়া এই মানুষটির অনেক জ্ঞানী ছিলো। বরিশালের মাকে আমি বেশ মিস করি। নাহ এ কথাও কেউ বিশ্বাস করবে না।

আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও...
“আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও…” 

চৌদ্দপুরুষের বাতি সাজানো হতো কলাগাছ দিয়ে নৌকো বানিয়ে। যদিও ওই নিয়ম মানতাম না, কিন্তু দারুণ লাগতো ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর আলো ছড়িয়ে নৌকো এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। সেই দৃশ্য আজও স্পষ্ট এ জীবনে। তারপর বাসায় এসেই দীপান্বিতার আয়োজন। মনে পড়ে চা’ বাগানের মাঠের বেশ কয়েকটি বাসায় একরকম গোপন প্রতিযোগিতা হতো। কতো যে চেষ্টা থাকতো আমাদের বাসার প্রদীপগুলো যেনো অনেকক্ষণ থাকে। আর প্রতিবছরেই পরিবর্তন আনা হতো, সাজানোর জন্য নিত্য-নতূন ডিজাইন তৈরী করা হতো। প্রতিবারই ডেকোরেশনে বদল আনার চেষ্টা থাকতো। বাসার সামনে গেটের দু’দিকে চারটে আর পেছনের গেটে দুটি কলাগাছ পোঁতা হতো। ওহ আমাদের বাসায় একটা নিয়ম ছিলো, বন্ধ্যা কলাগাছ ছাড়া অন্য কোনো গাছ কাটা যাবেনা। তার জন্য যদি সাজানো নাও হয়, হবেনা। কিন্তু ঈশ্বরের কি অশেষ কৃপা প্রতিবছরই ছয়টা কলাগাছ পাওয়া হয়েই যেতো। তারপর সাজানো শেষ হলে রাত আটটার দিকে সলতে জ্বালানো হতো। বাগান মাঠে যে কয়েকটি বাসায় সাজানো হতো, তাদের মধ্যে রুবী আন্টি, হাবু কাকু, প্রদ্যুৎ কাকু আর আমাদের বাসা। বাগানে বেশ কয়েকবছর ছিলেন কৃষ্ণকাকু, উনারাও জ্বালাতেন। তবে প্রতিযোগিতায় প্রথম হতো হাবু কাকুরাই। কিছুতেই পারতাম না জয়ী হতে। প্রদীপ জ্বালিয়ে ভরা অমাবস্যার মধ্যে মাঠে বেড়ানো। সরে গেলেই বাগানের বাচ্চা ছেলেগুলো এসেই চুরী করে নিতো। মামনি ওদেরকে হাজার দিলেও ওদের স্বভাবই ছিলো চুরী করার। আমাদের প্রদীপ নিভে যায় কেন এতো তাড়াতাড়ি? মামনিকে জ্বালানো কিছু একটা করো মা প্লিজ। আর বাপিও পাহারা দিতো আমার সাথে। এই প্রদীপ জ্বালাতাম আমি, মামনি, সাধু বুড়া, ক্ষিরোদ। চোখে ভাসছে সাধু-ক্ষিরোদের কথোপকথন। “ওই বুড়া জ্বালাইতে জ্বালাইতে আবার ঘুমাইয়া পইড়ো না…” ক্ষিরোদ বলতো সাধু বুড়াকে। আর সাধু বুড়া বলতো, “আরে না না এখন ঘুমাইতাম কেনে?” সাধু বুড়া আর আমি পাহারা দিতাম সামনের গেটে, পেছনের গেটে ক্ষিরোদ। আজ এই পৃথিবীতে ক্ষিরোদ নেই, হুম সাধু বুড়া বেঁচে আছে।

তীর্থ'র ফটোসেশন...
তীর্থ’র ফটোসেশন…

শমশেরনগর আমার আত্মায় বসে আছে। এতো সুন্দর স্মৃতি, কতো আনন্দ, বাপি-মামনির প্রশ্রয় মিশ্রিত আদর, বাসায় কাজ করা মানুষগুলোর ভালোবাসা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, বেড়ানো কতো কতো স্মৃতি। আজ এখানে যখন আমি আর তীর্থ মিলে মোম জ্বালাচ্ছি, চোখের উপর উড়ছিলো সেই ফেলে আসা সন্ধ্যা, সেই সময়। ওই বাগান মাঠের নীলাটা একইরকম থেকে গেছে এখনও সেখানে। সবার কাছে সেই ছোট্ট, দুষ্টু, চঞ্চল, পটর-পটর করা মেয়ে এখনও। এইতো ২০০৩ সালে তখন মা হয়ে গেছি। তীর্থকে নিয়ে দীপান্বিতা, কি আনন্দ! ওর কাছে সব যেনো অদ্ভূত! চোখে ভাসছে কালো পাঞ্জাবী পড়া গালটু-গুলটু তীর্থ মামনির হাত ধরে আতশবাজি নিজের কাছে নেয়ার জন্য তারস্বরে চিৎকার। বাপি এসেই কোলে নিয়ে ভরা গলায় ডাক, “ও ভাইয়া বাজি জ্বালাইতেনি?” আর কি চাই তীর্থর! খুশীতে আত্মহারা। একজন মা আমি, অথচ তখনও কিন্তু সবার কাছে আমি শুধুই নীলা। কেবলই একজন নীলা।

"দীপালিকায় জ্বালাও আলো..."
“দীপালিকায় জ্বালাও আলো…”

হ্যামিল্টন, কানাডা
৩০ অক্টোবর, ২০১৬ ইং।

**আজ তীর্থ আর আমি দীপান্বিতা পালন করলাম বাসায়। তীর্থ মোম জ্বালালো। দেখে ভাবছিলাম আমার মতো আনন্দ ও কখনোই পেলোনা। সবাইকে জানাচ্ছি দীপাবলি এবং শ্যামা মায়ের পুজোর শুভেচ্ছা। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।

এলোমেলো কিছু কথা…**আঠারো**

৯৫৩জন ৯৫৩জন
0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ