
সেই কবে শীত চলে গিয়েছে। এখন আর আগের মতো কুয়াশা এসে জমে না দূর্বাঘাসের উপর। নেই আজ এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি কাঁধে করে মনু মিয়ার খেঁজুরের রস বিক্রি করার সেই শীতের সকাল। দিনবদলের পালায় একে একে ঋতু গুলো ক্রমশ সরে যাচ্ছে।
সবে বসন্ত।
পাখি ডাকে, বাড়ির শতবর্ষের নিমগাছ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বাংলাঘরের পাশে থাকা বেলগাছ থেকে বেলফুলের সুগন্ধি নাকে আসে। অথচ দুজনে হারিয়ে ফেলেছে শৈশবের স্মৃতি।
রোদেলা দুপুরে মধু মাঠেঘাটে মন ভুলানো ভাটিয়ালি গান গেয়ে বেড়ায়। সে গানের রাগ নেই,রাগিণী নেই। আছে কেবল প্রেমে পড়ার স্বাদ। জনশূন্য দুপুর চারদিকে জুড়ে পাহাড়। সেসবের ফাঁক দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটা বহতা নদী। এ নদীর কোন নাম নেই।
যে নদীর কোন নাম থাকেনা সে নদী বড়ই অভাগা।
তাই পাড়ার লোকে নদীর নাম রেখেছে অভাগী।
শত কষ্ট বুকে ধারণ করে বহে চলে। এ একা চলার মাঝে অভাগী নদী খুঁজে পায় সুখ। নদীর তীরে বসে মধু বাঁশি বাজায়। যদি অভাগী নদী কষ্ট ভুলে সুখ পায়।
পাড়ার লোকেরা রোজই সেখানে স্নান করে। মধু কখনো পাহাড়ের দ্বারে, কখনো নদীর তীরে গরু চরায়।
আর হাতে বাঁশি নিয়ে বসে থাকে। কখনো দু এক কলি গান ধরে। মধু বেশ ভালো গান গায়। তার কণ্ঠে যেন অমৃত মেশানো। তা অনুভব করতে পারতো ময়নামতি। দুজনে একসাথে লেখাপড়া করলেও অভাবের সংসার কাটিয়ে মধু পাঠশালা ডিঙাতে পারেনি। এটা তার জীবনের বড় দুঃখ। এ দুঃখ ময়নামতি জানে।
জানে অভাগী নদী।
ময়নামতি তাকে বলত লেখাপড়া চালিয়ে যেতে। মাঝেমধ্যে মতি মধুকে খাতা কলম কিনে দিতো পাড়ার নানু মিয়ার টং দোকান হতে। এসবের বিনিময়ে ময়নামতি কেবল মধুর কাছে গান শুনতে চাইতো।
সে গান কখনো প্রেমের, কখনো বা মন ভুলানোর।
কিন্তু মধুর আর স্কুলে যাওয়া হলো না। অভাবের সংসারের তার এ স্বপ্নকে বিসর্জন দিতে হলো।
চৈত্রের এক মাঝামাঝি দুপুর। ভ্যাপসা গরম উপেক্ষা করে কৃষকের কাঁধ ভরা বোরো ধানের ভার। পাড়ার লুৎফুর মিয়ার সেতার বাজানো শব্দ তাদের কানে এসে বাজে।
এ যেন মন্ত্রমুগ্ধ ধ্বনি।
এই দুপুরে ময়নামতি মধুর জন্য দুধেলা গাভীর দই নিয়ে মাঠে যায়। মধুর হাত থেকে বাঁশি নিয়ে সেও দু এক কলি গান ধরে।
মধু ময়নামতির চুলের খোঁপায় গুঁজে দেয় পাহাড়িয়া ফুল। কখনো বা মধু, ময়নামতির চুলে বেণি বেঁধে দেয়। তাদের এমন ছেলেখেলা দেখে অভাগী নদী লুকিয়ে লুকিয়ে হাসে। মাঝেমধ্যে অভাগী নদী আনন্দে নিজের চোখেরজল মুছে।
সন্ধ্যা হলে একে একে সবাই ঘরে ফেরে। সূর্য পশ্চিমান্তে ডুবে। গাভীরদল গোষ্ঠে ফিরে। মাঝি দাঁড় ঠেকায়।
ধেয়ে আসে রমলা পিসির বাড়ি থেকে সিদ্ধ ধানের উষ্ণ সুগন্ধি। ময়নামতি সে সন্ধ্যায় ধূপের গন্ধে সুধা মাখে।
মধু যে দিনশেষে একা।
বড্ড ভারি একা।
বছর তিন – এক আগে তার বাবা মারা গেলেন বসন্ত রোগে। এই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতে গত ফাল্গুন মাসে মধুর মা মারা গেলেন শ্বাসকষ্টে। অভাবের সংসার ভালো করে বাবা -মায়ের চিকিৎসা করাতে পারেনি। আজ সে বড় একা হয়ে গিয়েছে। ঘরে গিয়ে কেবল মায়ের ছবি দেখে আর কাঁদে। কখনো কখনো কখনো না খেয়ে রাত কাটায়। তার আপন বলতে কেউ নেই। কেবল ময়নামতি ছাড়া! ময়নামতি তার সকল দুঃখকষ্ট বুঝে। এমনকি সান্ত্বনা দেয়। এ সান্ত্বনাটুকু পায় বলে মধু এখনো নিজেকে ঠিকিয়ে রেখেছে। মধু ময়নামতিকে ভালোবেসে নাম রেখেছে মতি। এ নামে মধু যেন স্বর্গীয় সুখ খুঁজে পায়। এমন নামে যখন মধু ডাকে তখন ময়নামতি হাসে।
আর শাড়ির আঁচলে মুখ ডাকে।
বড্ড লজ্জা এ, মতির।
কখনো এ লজ্জা ভেঙে মতি, মধুকে বলে কখন তোমার ঘরের বৌ কইরা নিবা?
মধু হাসে আর বলে নেবো নেবো কোন এক আসমানি চান্দের রাইতে। যে রাইতে আমাদের চাঁদের সাথে কথোপকথন হবে।
পাড়ার সকলে জানে ময়নামতি যে মধুকে ভালোবাসে। তাই পাড়ার লোকেরা মাঝেমধ্যে দুজনকে নিয়া ঠাট্টা করে। তবে এসবে দুজন কান দেয়না। মাঝেমধ্যে দুজন অভাগী নদীর তীরে বসে কবিতা লেখে। অভাগী নদী তাদের সাথে সখ্যতা বাড়ায়। কবিতা হয়ে ওঠে একে একে দীর্ঘস্থায়ী।
সময় বয়ে যায়। দিনশেষে পাখিদের মতো মধু আর মতি আপন আপন ঘরে ফিরে একে অপরকে কল্পনায় রূপ দেয়। রাত গভীর হলে অন্ধকার ছেঁয়ে যায় পুরো পাড়া। দূর থেকে ভেসে আসে মধুর মন ভুলানো বাঁশির সুর।
সে সুরে মতি নিজেকে স্থির রাখতে পারেনা। উন্মাদের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। মধু জানতো মতি তাকে বড় ভালোবাসে। কখনো আবার শূন্যতা এসে মতিকে গ্রাস করে। কখনো তার অন্তর কাঁদে মধুর জন্য।
মতির বাবা – মা ছাড়া ঘরে আর কেউ নেই।
তবে মতির মা মালতী ঠাকুরান জানতেন মতি যে মধুকে বড্ড ভালোবাসে।
ভোর হতে আর খানিক বাকি। সময়টা তখন বসন্তের মাঝামাঝি। কাকভোরে মৌমাছির দল ফুলের গা ছুঁয়ে যায়। মতি একে একে ফুল তুলে সাঁঝিতে রাখে। রোজকার দিনের মতো মতি আজ বেলি ফুলের মালা গেঁথে রাখে মধুকে দেবে বলে। ফুলের মালা যে মধু পছন্দ করে তা জানতো, মতি।
প্রতিদিনের ন্যায় সকাল হতে না হতেই মধু হাতে বাঁশি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সময় বয়ে গেছে বহুদূরে। গাছের শাখে শাখে বসে পাখিরা গান ধরে। পাশের বাড়ির মুন্নু হাতে গুনে গুনে পনেরোর নামতা পড়ছে। রোদ্দুর এসে ময়নামতির আঁচলে উঁকিঝুঁকি মারে। বসন্ত প্রায় শেষ হতে চললো।
এখনো দু একজায়গায় চোখ পড়লে শিমুল পলাশ দেখতে পাওয়া যায়। মাঝেমধ্যে মতি এসব ফুল নিজের মাথায় গুঁজে। আর তা দেখে মধু বলে আমার মতি কত্ত সুন্দর করে সাজে।
বৈশাখের এক মাঝামাঝি দিনে ঐ দূর পাড়া থেকে মতির বিয়ের সমন্ধ আসে।
সে এ বিয়েতে নারাজ।
মতি কেবল মধুকে জীবনসঙ্গী করতে চায়। কিন্তু তার বাবা মধুর সাথে তাকে বিয়ে দিতে চান না। আজকাল নিয়তি কেবল তাদের স্রোতের বিপরীতে হাঁটছে। এভাবে সময় কাটতে লাগলো। মতি দিনদিন আনমনা হয়ে যাচ্ছে। বেশ কদিন গত হলো মতি বাড়ি থেকে বের হতে পারছেনা।
মধু রোজই তাকে বাঁশির সুরে ডাকে। কিন্তু মতির সাধ্য নেই ঘর থেকে বের হওয়ার।
ইদানিং একসাথে বসা হয় না, দেখাও হয় না। অভাগী নদীও বাড়ায় না আর সখ্যতা।
কেবল ছোঁয়ে আছে শূন্যতার অসুখ।
এক দুপুরে মতি দুধ জাল দিচ্ছে উনুনের পাশে বসে। হঠাৎ করে মতির গায়ে আগুন জড়িয়ে পড়ে। চিৎকার করতে করতে মতি এক নিমিষে ছাই হয়ে যায়।
ঐ দূর মাঠে থাকা মধুর নাকে আসে মতির পোড়া মাংসের গন্ধ। শুনতে পায় পাখিদের ক্রন্দন।
কে জানতো মতির আজ এমন হবে।
মধু যে আজ জন্মের মতো একা হয়ে গেলো। চোখেরজল মুছতে মুছতে মধু অভাগী নদীতে তার রাখালিয়া বাঁশিটি বিসর্জন দেয়।
অভাগী নদী বলে পরজন্মে রাখালিয়া হয়ে জন্মাস, মধু। বাঁশির সুরে খুঁজে পাবে তোর মতিকে।
শেষবেলা মতি নিজের ভস্মীভূত ছাই দিয়ে লিখে গেছে পরজন্মে নদী হয়ে জন্মাব। তুমি হবে রাখালিয়া। তোমার কোলে মাথা রেখে শুনবো বাঁশির ধ্বনি।
দুঃখ ভুলে খুঁজব তোমায়,
সুখ পাওয়ার আশায়।
মধু জানেনা, অভাগী নদীর মতো মতিও একদিন নদী হয়ে যাবে। অবশেষে মধু অভাগী নদীতে নিজেকে বিসর্জন দেয়। মতির পরজন্মে রাখালিয়া হবে বলে।
দিনশেষে এক দুপুরের মতো অভাগী নদী অজস্র কষ্ট বুকে পোষে একা একা চলে।
সে একা চলার মাঝে একসময় অভাগী নদী সুখ পেত মধু ও মতির কাছে।
আজ কেবল শূন্যতার শোক।
..
ছবিঃ সংগৃহীত।
১৩টি মন্তব্য
আরজু মুক্তা
কমেন্টে পরে আসবো। ফাস্ট হলাম। মিষ্টি রাখিয়েন।
প্রদীপ চক্রবর্তী
আচ্ছা, দিদি।
শেষাংশ দুঃখজনক।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আহারে! কষ্টের গল্প। অধিকাংশ ভালোবাসাই সংসার করতে পারে না কোন এক অজানা কারনে। একজন হারিয়ে যায় অন্যজন তার শখের সূখ বিসর্জন দিয়ে আটকে থাকে ঋণ শোধ করে ভালোবাসার।
গ্রামীণ প্রেমের গল্প সুন্দর হয়েছে। শুভ কামনা।
প্রদীপ চক্রবর্তী
সত্যিই কষ্টের!
ধন্যবাদ আপনাকে।
ছাইরাছ হেলাল
দু-দু’টো মৃত্যু গল্পে করুন বাতাবরণ এনে দিয়েছে।
নিয়মিত লিখতে হবে।
প্রদীপ চক্রবর্তী
চেষ্টা অভ্যাহৃত।
সাধুবাদ, দাদা।
হালিমা আক্তার
দুঃখ জাগানিয়া গল্প।
প্রদীপ চক্রবর্তী
সত্যিই!
ভালো থাকবেন অনেক।
মনির হোসেন মমি
গল্পের শেষ পরিনতিটা ছিলো আচমকা হঠাৎ হওয়া।মৃত্যু দুটোর বর্ননাটা আরো একটু বিস্তারীত বলা যেত।অনেকটা ইজি হয়ে গেছে। তবে প্রকৃতি প্রেম সব কিছুই বেশ চমৎকৃত ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
প্রদীপ চক্রবর্তী
ফাইলে লেখাটা পুরোপুরিভাবে বিস্তারিত ছিলো কিন্তু সেখানে এখন দেখি সংযুক্ত করতে পারিনি।
.
নিশ্চয় পরবর্তী সিরিজে তুলে ধরব।
.
ভালো থাকুন, দাদা ।
সাবিনা ইয়াসমিন
মধু-মতিরা কেন হারিয়ে যায়!
গভীর ভালবাসা এক জনমে ফুরোবার নয়, তাইতো এভাবেই ঐশ্বরিক ভালোবাসারা জন্ম/জন্মান্তরে পরিনত হয় কেবলই কাছে আসার তাগিদে। এই জনমে মানুষ তো ঐ জনমে নদী।
তোমার লেখা প্রকৃতির যে রুপ-সুধার বর্ননা পাই তাতে মন তৃপ্ত হয়ে যায়।
আরও লিখো, নিয়মিত লিখো প্রদীপ।
শুভ কামনা 🌹🌹
তৌহিদুল ইসলাম
গল্পের শেষে এসে মধু মতির নির্মম সত্যকে জেনে ব্যথিত হলাল দাদা। আমাদের নিয়তিকে খন্ডানোর সাধ্য কারোরেই নেই।
অনেকদিন পরে চমৎকার একটি গল্প নিয়ে এলেন। আপনার লেখা দিনকে দিন ক্ষুরধার হয়ে উঠছে কিন্তু। নিয়মিত আপনার লেখা চাই।
শুভকামনা জানবেন।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
এমন গল্প পড়লে মনটা কেঁদে ওঠে, আপনার চমৎকার উপস্থাপনায় গল্পটি হয়ে উঠেছে অনবদ্য। প্রকৃতির এমন বর্ণনা মনটাকে ভালোলাগায় ভরিয়ে দেয়। এমন করুণ পরিণতি কারোরই কাম্য নয়। তবুও পরজন্মে মতি-মধুর মিলন যেন হয় ঐশ্বরিক। ভালো থাকুন নিরাপদে থাকুন শুভকামনা নিরন্তর