দু’পাশে সুবিন্যস্ত ফসলের ক্ষেত। হলুদ আর সবুজের সমারোহ। মনে হচ্ছে শিল্পীর নিপুন তুলির আঁচড়ে আঁকা অসীম সৌন্দর্যের লীলাভূমি। বিস্তীর্ণ সর্ষে ক্ষেতের ফুলে ফুলে সুরভীতে মেতেছে আকাশ বাতাস। মৌমাছিদের মধুসংগ্রহের কোলাহল। আশশেঁওড়া সাইবাবলার কোল ঘেষে বয়ে চলা মেঠো পথে এখন খুব বেশী লোকের আনাগোনা নেই। বেশ কিছুটা পথ হেঁটে এসেছি আমি আর অনিক। গাঁয়ে পৌঁছতে আর খুব বেশী পথ বাকী নেই। আর মাত্র এই মাঠটি পেরোলেই প্রিয় জন্মভূমি। বেশ কিছুটা হাটলেও অনিকের তেমন ক্লান্তি আসেনি। কেননা শহুরে পরিবেশে বেড়ে ওঠা অনিক ইতিমধ্যেই খুবই মুগ্ধ। গাঁয়ের পরিবেশ প্রকৃতিতে মন ভরে গেছে ওর। তাছাড়া এমন মুক্ত বাতাস খোলা আকাশ দেখার খুব বেশী সু্যোগ হয়না ওর। তাই পায়ে চলা মেঠো পথটাও ওর খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে।
মাঠের প্রায় শেষপ্রান্তে রাস্তার মোড়ে একটা বুড়ো বটগাছ। পাশেই একটা স্কুল। খেলার মাঠের কোণায় একটি চায়ের টং দোকান।’ অনিকের সখ হল ওখানে একটা চা খাবে। তাই দুজন বসে পড়লাম সামনে রক্ষিত মাঁচার উপর। ওখানে আগে থেকেই বসে ছিলেন আমাদের সকলের প্রিয় কাশেম স্যার্। উনার সাথে কুশল বিনিময়ের পর আমরা চায়ে চুমুক দিচ্ছি। এমন সময় একটা লোক এসে দাঁড়ালো দোকানে। মাথায় একটা চাঙারী(বড় ঝুড়ি)। লোকটির পিছনে একটা দশ বারো বছরের ছেলে। ছেলেটির মাথায় একটা মাঝারি গোছের ঘাসের বোঝা। দুজন মাথায় থাকা বোঝাগুলো নামিয়ে বসে পড়লো মাঁচার উপর।
লোকটির মুখে বেশ মাঝারি গোছের দাড়ি। গায়ে ছেড়া ময়লা একটা জামা, হাতে নিড়ানী আর মাথায় একটা মাথাল। আর ঐ ছেলেটির গায়ে ধুলোকাদা মাখা স্যান্ডো গেঞ্জি ও মাথায় একটা পুরণো গামছা। চা দোকানদার লোকটিকে বলল
-আজ কিন্তু চা দিতে পারবোনা ইনু, তোমার মেলা টাকা বাকী হয়ে গেছে।
-আচ্ছা ভাই দিয়ে দিবুনে, তয় আমার ছেলেডারে এক গ্লাস পানি দাও না সিদ্দিক ভাই। রোদে ওর গলাটা একেবারে শুকিয়ে গেছে।
-নাহ তোমাগে জ্বালায় আর ব্যাবসাপাতি করা যাবেনা।
বলেই দোকানদার একগ্লাস পানি এগিয়ে দিল। ছেলেটি ঢকঢক করে এমন দ্রুত পানিটা খেল যেন সারা জীবনের তৃষ্ণা মিটলো তার। ততক্ষনে অনিক চাঙারীতে কি আছে দেখে নিয়েছে। এবার আমাকেও ওগুলো দেখাতে লাগলো।
-দেখো বাবা,কি সুন্দর সুন্দর বেগুন, আম আর শসা।
-ও তাইতো,তুমি খাবে নাকি?
এই যে ভাই কোথাকার ওগুলো? তুমি বেচবে?
চা দোকানদার সিদ্দিক মিয়া একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলল “ওগুলো খেয়োনা বাবা, ওতে সব বিষ মিশানো আছে।” অনিক এবার একটু অবাক হয়ে বলল
-এসব ফলমূল শাক সবজিতে বিষ আসলো কোথা থেকে? এসব জিনিসে কেউ কখনো বিষ মেশায়।
-তুমি জাননা বাবা।মানুষ এখন সব পারে। নিজের লাভের লোভে মানুষ মানুষকে খুন করতেও দিধা করেনা। এই যে এত সুন্দর ফলমুল দেখছোনা, এগুলোতে সব বিষ মিশানো। এই যে সুন্দর সুন্দর আম দেখছো, এর মুকুল থেকে শুরু করে অধিক ফলনের লোভে পাঁকার আগ পর্যন্ত অনেকবার বিষ দেয়া হয়। আবার পাকার পরেও ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার লোভে ওতে ফরমালিন নামের এক ধরনের বিষ মিশায়, যাতে ওগুলো না পঁচে যায়। এমনি করে সব ফলমুল-শাকসবজিতেই বিষ প্রয়োগ করে। পোঁকামাকড়ের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য নানান ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু এগুলো যে আপনার আমার মত মানুষই খাবে তা তারা ভুলে যায়।
-তা এসব বিষ মিশানো ফলমুল খেলে মানুষ মারা যায় না?
-তাতক্ষনিক হয়তো কেউ মরবেনা। তবে ভবিষ্যতে এই বিষগুলো নানান ক্ষতি করে থাকে।জীবনের নানান সময় নানান রকম রোগ দেখা দেয়। গর্ভবতী মায়েরা এইসব বিষের প্রভাবে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দেয়। আবার শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। অনেক সময় শিশুরা মানসিক প্রতিবন্ধীও হতে পারে। শুধু কি তাই এসব বিষপ্রয়োগের ফলে নানান ধরনের উপকারী কীট পতঙ্গ মারা যায়। আবার বৃষ্টির পানিতে মিশে এই বিষ নদী, খাল, বিল, পুকুরে গিয়ে পড়ে।ফলে সেখানকার মাছ, ব্যঙ-ব্যাঙাচিসহ নানান জাতের প্রাণী মারা যায়। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
-তাহলে ওগুলো উনি কি করবেন?
-কি আর করবে। গরীব মানুষ, অন্যের কাজ করে খায়। এলাকার চেয়ারম্যানের বাগানে কাজ করে এল। পারিশ্রমিক হিসাবে ওগুলো দিয়েছে, তাই নিয়ে এসেছে।কিছুক্ষণ পর এখানে হাট জমলে ওগুলো বিক্রি করবে। তাতে যে পয়সা পাবে তা দিয়ে অল্পসল্প চাল ময়দা কিনে নিয়ে যাবে। এভাবেই ওদের সংসার চলে।
-তাই বলে জেনেশুনে মানুষ মানুষের ক্ষতি করবে? ওগুলো বেচলে কত টাকাই বা হবে। ও বাবা, তুমি বরং কটা টাকা দাওনা, আমরা ওগুলো কিনে নিয়ে মাটিতে পুতে দেবো। তাতে কারো ক্ষতিও হবেনা। আবার উনাদের দিন চলে যাবে।
সিদ্দিক মিয়া অনিকের কথা শুনে খুব খুশী হল। বলল—-
-ইনু,ছোট সাহেব তো সব কিনে নিল। তুমি খুশী তো?
লোকটা এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। এবার সে একটু নড়েচড়ে বসলো। একটা তৃপ্তির হাসি হেসে বলল
-তোমার নাম কি বাবা? বাড়ি কোথায়?
-আমরা খুলনায় থাকি। এখানে বেড়াতে এসেছি। তা আপনাদের বাড়ি কোথায়? ওর নাম কি? কোন ক্লাসে পড়ে ও?
-গরীব মানুষের আবার পড়াশোনা। ওর নাম স্যাদু। সখ করে নাম রাখিছিলাম সাহাদাৎ। আমিও পড়াতি পারলামনা, ওও পড়তে পারলোনা।জান তো বাঁচাতে হবে বাবা। লেখাপড়া আর হল কই। লোকে এখন সবাই স্যাদু বলেই ডাকে।
-লেখাপড়া করতে পারলোনা কেন? কি সমস্যা ছিল।
-গরীব মানুষের অনেক সমস্যা বাবা। পেটের দায় বড় দায়। এই পেটের দায়ে আমিও জীবনে কিছু করতে পারিনি। ওরও কিছুই হলনা।সবই কপাল বাবা।
-লেখা পড়া করতে তো এখন কোন খরচ হয়না, বইপত্রসহ সব খরচই সরকার দেয়।
-তা দেয়, কিন্তু সংসার তো চালানো লাগবে।
-তার মানে?
-সে অনেক কথা বাবা। আমার আর ওর কপাল প্রায় একই রকম। ছোট বেলায় আমার বাপও আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল।ছাত্র হিসাবে ভালই ছিলাম। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেনী পর্যন্ত আমি দ্বিতীয় ছিলাম। কিন্তু পড়াশোনা করতে পারলাম কই। একদিন ক্লাসে বেসে পড়াশোনা করছিলাম। এমন সময় বাড়ি থেকে একটা সংবাদ আসায় আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে হল। কে জানতো ওটাই ছিল আমার স্কুলের শেষ দিন।ফিরে দেখি আমার মা মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। বাবা অসহায় হয়ে ছুটোছুটি করছে। কোন উপয়ান্তর না পেয়ে বাবা আমাকে বাড়িতে রেখে মাকে নিয়ে জিলা শহরের বড় হাসপাতালে নিয়ে গেল। কিন্তু মা ফিরে এল লাশ হয়ে। ডাক্তার নাকি বলেছিল শিক্ষা আর সচেতনতার অভাবে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। মাকে কবরে শুইয়ে দিয়ে আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। কিন্তু শোকে দুঃখে দুইদিন যেতে না যেতেই বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। সংসারে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। বাবার চিকিৎসা আর সংসার কিভাবে চলবে। আমি অসহায় হয়ে এর ওর কাছে ধরনা দিয়ে বাবার চিকিৎসার চেষ্টা করলাম। লোকের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে আমাদের সংসার চলে। মেম্বার,চেয়ারম্যান, গ্রামের বড় মিয়ারা কেউ আমাদের অসহায়ত্ব দেখেও সাহায্য করতে এলোনা।অনেকদিন ভুগেছিল বাবা। তার দেখভালের জন্য তার পরামর্শে অল্প বয়সে বিয়েও করেছিলাম। কিন্তু কপালের লিখন কি আর খন্ডন করা যায়। একদিন বাবাও চলে গেল পরপারে। আমার জীবন এমনিভাবেই পাল্টে গেল।অথচ শুনেছি আমার বন্ধুরা এখন একেকজন কত বড় বড় মানুষ হয়েছে।
কথা বলতে বলতে ইউনুসের দুইচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। ততক্ষণে আমার আমার চোখদুটোও জলে ভরে উঠেছে। কেননা এই ইনুই ছিল আমার ক্লাসের দ্বিতীয় সেই ইউনুছ।অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!
এতক্ষণ অনিক বাবুর বুকটাও কষ্টে কেপেঁ উঠেছে। সে সাহাদাতকে বললো-
-তুমি যাবে আমাদের সাথে? তোমাকে আমাদের স্কুলে ভর্তি করে দেব।
-আমি চলে গেলে বাবাকে দেখবে কে?আমার তো মা নেই। বাবা ক’দিন পরপরই খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই আমার আর ওসব হবে না ভাই। আমাকে এখানেই থাকতে হবে।বলতে বলতে ছেলেটিও হু হু করে কেঁদে উঠলো।
———————–0 0————————-
২৪টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
নিয়তির কি নির্মম পরিহাস একসাথে পড়েছে, ভালো ছাত্র ছিলো তবুও সে আজ মাথায় মাথাল, ছেঁড়া ফাটা কাপড় পড়ে ঘুরে বেড়ায়। খাবারে বিষ মিশিয়ে এভাবেই অন্যের জীবন হুমকিতে ফেলে কিছু মানুষ নামের পশু। মেম্বার, চেয়ারম্যানেরা গরীব লোকদের সাহায্য করতে খুব কমই এগিয়ে আসে। এরা হলো রক্তচোষা। ছোট গল্পে অনেক নির্মমতা ধুলে ধরলেন। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন
হালিম নজরুল
মনোযোগ দিয়ে গল্প পড়ে সুন্দর মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
আতা স্বপন
এমনতর সামাজিক সমস্যগুলো নিয়ে লিখা আরো প্রত্যাশা করি। খুব ভাল লাগল। আল্লাহ হেফাজত করুন।সুস্থ থাকুন। ধন্যবাদ
হালিম নজরুল
আপনিও ভাল থাকুন সবসময়।
ফয়জুল মহী
অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর লেখা । মননশীল অভিব্যক্তি ।
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ প্রিয় ভাই আমার।
ইঞ্জা
দারিদ্র্যতার করাল গ্রাসে কত শত ইউনুস যে এইভাবে তাদের জীবন হারাচ্ছে তার খবর কে বা রাখে, লেখাটি পড়ে মন ভাড় হয়ে গেলো ভাই।
হালিম নজরুল
চেষ্টা করেছি জীবনের কিছু বাস্তব চিত্রকে গল্পে রূপায়িত করতে। ধন্যবাদ ভাই।
ইঞ্জা
শুভকামনা ভাই
ছাইরাছ হেলাল
দারিদ্র আর ক্ষুধার কাছে কিছুই দাঁড়াতে পরে না,
অনেক দিন পড়ে হলেও গল্প পড়ে ভালই লাগল।
হালিম নজরুল
আপনার ভাল লেগেছে জানলে লেখাকে সার্থক সার্থক মনে হয়। ধন্যবাদ জনাব।
প্রদীপ চক্রবর্তী
দারিদ্র আর ক্ষুধা মানুষকে উপরের দিকে আগাতে দেয় না।
কিছু স্বপ্ন , স্বপ্নই থেকে যায়।
লেখাটি পড়ে ভালো লাগলো দাদা।
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ দাদা, সাথে থাকার জন্য।
কামাল উদ্দিন
দুঃখে যাদের জীবন গড়া তাদের আবার দুঃখ কিসের। গ্রামের বিষ মেশানো গল্প পড়লাম, আমরা কি আবার কোনদিন মানুষ হতে পারবো কিনা জানিনা।
হালিম নজরুল
এত অমানুষের ভীড়েও কিছু মানুষ রয়েছে ভাই।
কামাল উদ্দিন
হুম, ধন্যবাদ
রেহানা বীথি
যখন গ্রামে যাই, দেখি একসময়ের খেলার সাথীরা, যারা আমারই সমবয়সী, যেন অনেকটাই বুড়িয়ে গেছে। আসলে প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে করতে বয়সের আগেই বার্ধক্য হানা দেয় ওদের শরীরেে। সেই সময় দেখেছি সবাইকে স্কুলে যেতে, অথচ এখন তারা যেন হেরে গেছে একেবারেই। বড় কষ্ট হয়।
সুন্দর লিখলেন।
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ বীথি আপু। ভাল থাকুন সবসময়।
জিসান শা ইকরাম
অত্যন্ত গরীবদের বেঁচে থাকাটাই মুখ্য, একারনেই পড়াশুনা আর হয়না। ইউনুস এরও হয়নি, তার ছেলেরও হবে না।
শুভ কামনা জানবেন ভাই।
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ ভাই। শুভকামনা রইল।
আরজু মুক্তা
আমাদের কাছে পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটি।
পরিবার আগে।
নিজের কথা পরে ভাবি। একেবারে স্বার্থহীন ছেলেটা
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ আপু সাথে থাকবার জন্য।
তৌহিদ
গল্পে চমৎকার একটি বিষয় এনেছেন যা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। খাদ্যে বিষ মেশায় অনেকেই। এটা উচিত নয়। এর ফলে আমাদের নানাবিধ বিকলাঙ্গতা তৈরি হচ্ছে। আসলে তারাও অসহায়। টাকা রোজগার না হলে তাদের পরিবার চলবে কিভাবে। সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকলে আমরা ফ্রেশ জিনিশ খেতে পারতাম।
ভালো থাকবেন ভাই।
হালিম নজরুল
অন্তহীন ভালবাসা ও শুভকামনা ভাই।