রমনা পার্ক রাজধানী ঢাকার ঠিক মধ্যভাগে নগরের অক্সিজেন সরবরাহকারী হিসেবে নীরবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। নানা প্রজাতির গাছ, কৃত্রিম হ্রদ এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে পার্কটি নগরবাসীর এক প্রিয় ঠিকানায় পরিণত হয়েছে। এখানে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাসহ নানা শ্রেণী মানুষের আগমন ঘটে।
মুনিয়া ও শ্রাবণ নামের এক প্রেমিক যুগল রমনা পার্কের ভিতর প্রবেশ করল। তারা হাঁটতে হাঁটতে রমনা পার্কের কোন একটি জায়গায় এসে বেঞ্চের উপর বসল। কিছুক্ষণ পরই নয়/দশ বছরের একটি মেয়ে কতগুলো বকুল ফুলের মালা নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসল। মেয়েটির পরনে একটি ময়লা জামা ও একটি স্যালোয়ার। মেয়েটি অসহায় দৃষ্টিতে ডান হাতে একটি মালা নিয়ে শ্রাবণের সামনে ধরে বলল, সাব মালা নিবেন! মালা! বকুল ফুলের মালা। নেন না একটা মালা। দ্যাহেন কি সুন্দর ঘ্র্যান! আফারে খুব মানাইবো।
মুনিয়া মেয়েটির মিনতি মাখা কথা শুনে হেসে উঠল।
মেয়েটি আবার বলল, হাসবেন না আফা। হাছা কথা কইছি আফনারে মানাইবো। আর আফনারা যদি আমাগর কাছ থিকা মালা না নেন তাইলে আমরা খামু কি?
মেয়েটির এ সমস্ত মিনতি মাখা কথা শুনে শ্রাবণ ভাবতে লাগল, এত ছোট মেয়ে অথচ কত সুন্দর করে কথা বলে। মেয়েটির প্রতি তার মায়া হল। শ্রাবণ তাকে বলল, তোমার এখানে কয়টি মালা?
মেয়েটি গুণে বলল, সাব দশটা।
– একটি মালার দাম কত?
– পাঁচ ট্যাহা।
– সবগুলো মালা আমার কাছে দাও।
মেয়েটি সবগুলো মালা শ্রাবণের হাতে দিল। শ্রাবণ সবগুলো মালা মুনিয়ার গলায় ও খোঁপায় পড়িয়ে দিল। বাহ! পার্কের প্রকৃতি পরিবেশে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে মুনিয়াকে। এবার শ্রাবণ মানিব্যাগ থেকে একশত টাকার একটি নোট বের করে মেয়েটির হাতে দিল।
মেয়েটি আঙ্গুলের কর গুণে দেখল একটি মালার দাম পাঁচ টাকা হলে দশটি মালার দাম পঞ্চাশ টাকা হয়। মেয়েটি শ্রাবণের হাতে টাকাটা দিয়ে বলল, সাব মালার দামতো পঞ্চাশ ট্যাহা। আপনি একশ ট্যাহা দিছেন ক্যান?
– বাকিটা তোমাকে বকশিশ দিলাম।
– না সাব। আমি বকশিশ নেই না। বাপজান কইছে, চুরি করা পাপ। তাই চুরি করি না। ভিক্কাও করা ভালা না। তাই বকুল ফুলের মালা বেইচ্ছা ভাত খাই। মালার দাম যা হইছে তাই দ্যান। আমি বেশি ট্যাহা নিমু না।
মুনিয়া এবার জিজ্ঞেস করল আচ্ছা, তোমার পরিবারে কে কে আছে?
একথা বলতেই মেয়েটির দু’চোখে পানি এসে গেল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বাপজান আছে। কোন কাজকাম করতে পারে না। হাত পা ভাইঙ্গা লোলা হইয়া গ্যাছে। আমি মালা বেইচ্ছা যা পাই তা দিয়ে চলি। আজ থাইক্কা দুই বছর আগে আমার মা মইরা গ্যাছে।
– তোমার মা কীভাবে মারা গেছে?
– একসিডিন কইরা মইরা গ্যাছে। জানেন আমি তহন আরো ছুটো। একদিন মা-বাপজান আমারে নিয়া রিক্সা কইরা বাসায় যাইতেছে। তহন একটা বাস আইসা আমাগো রিক্সার উপর তুইল্যা দ্যায়। আমার মা তহন মইরা যায়। আর বাপজানের পা ভাইঙ্গা যায়। তহন আমি আল্লহর রহমে বাঁইচা যাই।
মেয়েটির দুঃখের কথা শুনে মুনিয়ার খুব মায়া হল। তাই সে তাকে আবার অনুরোধ করে বলল, বাকী টাকাটা নিয়ে যাও। এই টাকা দিয়ে তোমার বাবার জন্যে ভাল খাবার কিনে নিবে।
– না আফা না, ট্যাহা লাগব না। আমি ভিক্কা নেই না।
মেয়েটির কথা শুনে মুনিয়া ও শ্রাবণ আশ্চর্য হয়ে গেল। শ্রাবণ বলল, এটা ভিক্ষা নয় তোমাকে উপহার দিলাম।
শ্রাবণ বারবার টাকাটা দেওয়ার পরও সে তা নিচ্ছে না। এক সময় সে জোর করে তাকে টাকাটা দিয়ে দিল। মেয়েটি সালাম দিয়ে চলে যাচ্ছিল এমন সময় মুনিয়া ডাক দিল, শোন!
মেয়েটি কাছে আসতেই বলল, তোমার নাম কি?
– আয়না।
– সুন্দর নামতো! কে রেখেছে তোমার নাম?
– আমার বাপজান। জানেন সাব, আমার বাপজান আমার নাম আয়না ক্যান রাখছে?
– কেন?
আমি নাকি দেখতে আমার মায়ের মতো। তাই আমার বাপজান আমার নাম রাখছে আয়না। মায় বাপজানরে মরার আগে কইয়া গেছে, “আমি যদি মরে যাই তাহলে তুমি আর কোন বিয়া করবা না। আমাগো মাইয়াডারে দেইখ্যা থাকবা। আমাগো মাইয়ার মুখের দিকে চাইলে আমারে দ্যাখতে পাইবা।”
রচনাকাল: ৩১/০৮/২০১৫খ্রি:
২২টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
স্বাগত আপনি এখানে।
লিখুন নিয়মিত ও পড়ুন নিয়ম করে অন্যদের
সুন্দর উপস্থাপন।
লেখা ফেলে রেখে গেলে হবে না।
আমির ইশতিয়াক
ধন্যবাদ হেলাল। নিয়মিত লেখার চেষ্টা করব।
নূরু
আমির ভাই শুভেচ্ছা
আপনাকে এখানে পেয়ে ভালো লাগলো।
চমৎকার গল্পের জন্য ধন্যবাদ। -{@
আমির ইশতিয়াক
ধন্যবাদ নুরু ভাই। আপনাকে পেয়ে আমারও ভাল লাগল।
সাঞ্জনা চৌধুরী জুঁথী
এটা ঢাকা নগরীর প্রতিদিনের চিত্র। এভাবেই নিম্নবিত্ত মানুষদের জীবন চলে।আয়নার অনেস্টি ভালোলাগলো :)সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে।আরো লেখা চাই…শুভেচ্ছা নিবেন -{@
আমির ইশতিয়াক
ধন্যবাদ জুঁথী আপু। দোয়া করবেন। নিয়মিত লেখার চেষ্টা করব।
মৌনতা রিতু
এই হলো আমাদের দেশের একেবারে নিম্ন শ্রেণি মানুষের জীবন যাত্রা। আমাদের চারপাশে অসংখ্য আয়নারা আছে।একটু হাত বাড়ালেই হয়ত তারা ভালো জীবন পাবে।
আমির ইশতিয়াক
ঠিক বলেছেন রিতু আপু। সমাজের বাস্তবতা আমার গল্পে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।
অরুনি মায়া
যখন ছোট্ট শিশুদের হেসে খেলে লেখা পড়া করে সময় কাটানোর সময় তখন এমন দৃশ্য মনকে আহত করে |
সোনেলায় আপনাকে স্বাগত জানাই | আশা করি আমাদের সাথে থাকবেন এই পরিবারের একজন আন্তরিক সদস্য হয়ে -{@
আমির ইশতিয়াক
ধন্যবাদ আপু সুন্দর মন্তব্য করার জন্য। নিয়মিত থাকার চেষ্টা করব।
ভোরের শিশির
সোনেলায় আপনাকে নিয়ে লিখে রাখা Bio দারুণ Interesting!
স্বাগতম সোনেলায়। নিয়মিত লিখুন এবং অন্যদের পোস্টেও অংশগ্রহণ করুন।
শুভেচ্ছা। -{@
আমির ইশতিয়াক
ধন্যবাদ আপনাকে। নিয়মিত লেখার চেষ্টা করব।
ভোরের শিশির
🙂
মামুন
আপনার ব্লগ বাড়ি থেকে ঘুরে গেলাম। ছুঁয়ে দিলো আপনার গল্পটি।
শুভেচ্ছা রইলো…
আমির ইশতিয়াক
ধন্যবাদ মামুন ভাই। কেমন আছেন? শুভ কামনা রইল।
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
অসাধারণ (y)
আমির ইশতিয়াক
ধন্যবাদ ভাই।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
আমির ভাই স্বাগতম আশা রাখি আমাদের সাথে এমন সুন্দর গল্প নিয়ে আসবন বার বার। -{@
আমির ইশতিয়াক
ধন্যবাদ মনির ভাই। বার বার আসতে চাই সবার মাঝে। দোয়া করবেন।
নীলাঞ্জনা নীলা
আমির আপনাকে সু-স্বাগতম সোনেলা নীড়ে।
গল্পটা দারুণ লিখেছেন। আর এ দৃশ্য তো আমাদের দেশের খুবই পরিচিত দৃশ্য এবং চরিত্রও খুব সাধারণ।
একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো। আমি তখন ক্লাশ এইটে পড়ি, একটা ছেলে আসতো সব্জী নিয়ে বিক্রী করতে। আমরা তখন চা’ বাগানে থাকতাম। নিজেদেরই সব্জী বাগান ছিলো। কিন্তু ওই ছেলেটির সব্জী কিনতো মামনি। সে এই শীতের সময় সব্জী বিক্রী করে বই কিনতো। আমি কতোবার দিতে গিয়েছি এমনিতেই বই-কাগজ-কলম, নেয়নি। জানিনা আজ কোথায় সেই ছেলেটি। আমার পুরোনো বই নিয়ে যেতো সব্জী বিক্রী করে।
লিখুন আরোও। এ সমাজকে তুলে ধরুন আপনার কলমে।
আমির ইশতিয়াক
ধন্যবাদ নীলা আপু আপনার মূল্যবান মন্তব্যের জন্য। দোয়া করবেন আমার কলম যেন সমাজের বাস্তবতাকে তুলে ধরতে পারে।
মেঘলা আকাশ
কবি আমির ইশতিয়াক ভাইয়া সোনেলায় স্বাগতম আপনার গল্পটা দারুন কিন্তু শুভেচ্ছা নেবেন