রাত আনুমানিক বারোটা। খালেদার চোখে ঘুম নেই। মনটা ছট ফট করছে। ইচ্ছে হল বাইরে বের হতে। রুম হতে বারান্দায় আসতেই দেখে কাজের মহিলা মর্জিনা বিবি বারান্দায় বসে আছে। তার চোখে পানি। খালেদা মর্জিনা বিবির দিকে এগিয়ে গেল।
– আচ্ছা দিদি আপনি এখনও ঘুমান্নি!
মর্জিনা বিবি চোখের পানি আঁচল দিয়ে মুছে বললো, ঘুম আইতেছে না তাই এহানে বইসা আছি।
– কি হয়েছে আপনার?
– কিছুই হয়নি। এমনিতেই।
– আপনি কাঁদছেন কেন?
– কই কাঁদলাম।
– আপনি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছেন। আরো অনেক দিন দেখিছি আপনাকে এভাবে কাঁদতে? এর কারণ কি বলবেন?
– কেরে কাঁদি তা কি হুনবেন?
– হ্যাঁ। কেন শুনবো না? আজ আমি আপনার কান্নার রহস্য জানতে চাই।
– সে এক বিরাট কাহিনী।
– সংক্ষেপে বলেন।
– তাইলে হুনেন।
মর্জিনা বিবি তার জীবনের ইতিহাস বলতে লাগল খালেদা তার পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
আজ থাইকা ৩০ বছর আগের কথা। আমি তহন যুবতী। আপনার এহন যেই বয়সটা তহন আমার এই বয়সটা ছিল। তহন আমার লগে আমাগো গ্র্যারামে একটি পুলার সাথে আমার প্রেরেম হয়। হের নাম ছিল হাসু। সব পোলামাইয়ারা জন্মের সময় কাঁন্দে। হে নাকি জন্মের সময় খুব হাসছিল, এললেগি এর মা এর নাম রাখছিল হাসু। আমাগোর প্রেরেম যহন হয়ে যায় তহন বাড়ির হগলতে জাইন্না ফালায়। আমার মা হাসুকে খুব পরছন্দ করতো। তাই আমাগো প্রেরেমে মা কোনো বাঁধা দিত না। একদিন মা হাসুদের বাড়িতে আমার বিয়ার প্ররস্তাব নিয়া যায়। প্ররথম হাসুর মা-বাপ রাজি হইছিল না। পরে রাজি হইয়া গেছে।
এতটুকু বলেই মর্জিনা বিবি থামল।
খালেদা আরো জানার জন্য বললো, তারপর।
আবার মর্জিনা বিবি বলতে লাগল, তারপর বিয়া হল। বাসর রাতে আমি যহন ঘুমডা দিয়ে বসে থাহি তখন হাসু আমার কাছে আহে। হে তহন আমার ঘুমডা ফালাইয়া বললো, এইভাবে ঘুমডা দিয়া আছ ক্যান? মনে হয় আর কোন দিন দেহনি। আমারে দেখে কি তোমার শরম করছে?
আমি তহন বললাম, কি যেন কন শরম কিহের।
কতক্ষণ চুপ থাকার পর হাসু বললো, এই আমারে ফালাইয়া যাইবা নাতো?
তোমারে ছাইড়া কোত্তাও যাইব না।
তারপর আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা হয়। পরে আমডা দুইজন দুইজনকে ঝাপটাইয়া ধইরা হুইয়া পড়লাম।
এইটুকু বলেই মর্জিনা বিবি বললো, আর কইতে পারুম না। শরম লাগে।
– না দিদি আজ আমি আপনার পুরো কাহিনীটা শুনব।
– আইচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে হুনেন।
কিছু দিন পর আসল ঈদ। ঈদের আগে হাসু আমার জন্যে একটা লিপিস্টিক আনল। আমার হাতে দিয়া কইল, এই হচ্ছে তোমার ঈদের উপহার। আর অহন তোমার ঠোঁটে লিপিস্টিক মেখে আমার গালে একটা চুমা দিবা। তহন আমার গালে দাগ বসবে। ফলে আর কেউ আমার দিকে নজর দিতে পারবে না।
আমিতো তহন শরমে মরি। কি করুম সোয়ামীর কথা কি অমান্য করা যায়। তাই ওরে তহন আমি চুমা দেই।
তারপর থেকে আমাগো সংসার ভালাই চলছিল। কিছুদিন পর হাসুর কলেরা হয়। এই কলেরাই আমার হাসুরে পর পারে নিয়া যায়। আমি তহন হের লাশের উপর পইড়া কাঁনতে থাহি। এমন সময় আমার হরি আইসা আমার চুলের মুঠি ধরে কয়, আহহারে কি রসের কান্না কানতাছে। এই হতভাগিনী আমার পুলাডারে খাইছে। পোড়া কপালী ভাগ আমার বাড়ি থেকে।
আমি তহন যাইতে চাইলাম না। তহন আমার হওর-হরী জোর কইরা আমারে গলা ধক্কা দিয়া ঘর থেকে বাইর কইরা দেয়। আর তহন আবার বলে, আজকে আমার পুলারে খাইছস পরে আবার আমডার মাথা খাইবি। যা ভাগ এ বাড়ি থেকে।
একথা গুলো বলেই মর্জিনা বিবি কাঁদতে লাগল।
খালেদা বললো, তারা আপনাকে এত অত্যাচার করছে? তারা কি মানুষ ছিল না পশু? আচ্ছা দিদি এর পর কি হয়েছিল শুনি।
মর্জিনা বিবি আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললো, তারপর থেকে ৩০ বছর মাইনষের বাড়িতে কাম করি। বাপের বাড়িতেও যাইনা। পরে আপনার বাপ আমারে আপনাদের এনে আনে। জানি না আর কয় দিন এহানে থাকতে হবে।
খালেদা এবার বলল, আপনি কী আর বিয়ে করেন নাই?
– না। আমার বাপ-মাই আমারে বিয়া দিবার লাগি অনেক চেরেস্ট্রা করছে কিন্তু তাগো সব চেরেস্ট্রাই বাদ হইছে।
– কেন বিয়ে করেনি?
– আমি জানি মাইয়া মাইনষের বিয়া একবারই হয়। তাই এইডাকে আমি ভাগ্য বলে মাইন্না নিলাম। আর আমি হাসুকে খুব বেশি ভালোবাসতাম তাই আর কারোর সাথে বিয়া বইতে পারি নাই।
এতটুকু বলে মর্জিনা বিবি বললো, চলেন আজকে আর না। আর একদিন বলমু। এহন মেলা রাইত হইছে। এখন শোওন গিয়ে।
রচনাকাল: ০৫/১০/২০১৫খ্রি:
৪টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
মর্জিনা বিবির গল্প পড়লাম।
শিক্ষিত হোক আর শিক্ষিত না হোক সমাজের সমস্ত স্তরের মর্জিনাদের একই অবস্থা।
নতুন লেখা দিন, যা সোনেলার কথা ভেবে লেখা।
শুভ কামনা।
আমির ইশতিয়াক
ধারাবাহিক ভাবে গল্প আসবে। সঙ্গে থাকুন। ভালো থাকুন।
নীহারিকা
এমন অনেক মর্জিনা আমাদের আশেপাশেই আছে, আমরা খবর রাখি না। স্বামী মারা গেলে অনেক পরিবারই বউকে আর রাখতে চায় না। তাদের কাছে সে তখন বোঝা।
ভালো থাকুক মর্জিনা বিরিরা। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আত্মসন্মান নিয়ে বেঁচে থাকুক তারা।
আমির ইশতিয়াক
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য।