
গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে ২১ শে ফেব্রুয়ারি অমর শহীদ দিবস যা এখন পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও। প্রতিবছর এইদিনে আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের কথার অঙ্গীকার করি। বাংলা ভাষা নিয়ে আমরা আবেগাপ্লুত হয়ে উঠি এদিনে। অফিস আদালতে জোর গলায় বাংলা ভাষা চালু করার কথা বলি, বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্যের বা অন্যান্য সেবা, ব্যাংক, বীমা, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সকল ইংরেজি সাইনবোর্ড বাংলায় লেখার কথা বলি। পাশাপাশি বিভিন্ন তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিকট থেকে ইংরেজি সাইনবোর্ড অপসারণের জ্বালাময়ী ঘোষণা আসে। আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিকে একটা নিছক, গতানুগতিক আনুষ্ঠানিকতার গণ্ডীতে আবদ্ধ করে ফেলেছি। নগ্ন পায়ে প্রভাত ফেরীতে অংশ নিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাওয়া। শহীদের বীরত্ব গাঁথা, আত্মত্যাগের মহিমা আলোচনা করা, শহীদ দিবসের তাৎপর্য আলোচনা করা, একদিন পায়জামা পাঞ্জাবী আর শাড়ী পরা, কালো ব্যাজ ধারণ করা, দোয়ার মাহফিলের আয়োজন করা আর সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু করার দাবী করা। মোটা দাগে বলতে গেলে পোষাক-পরিচ্ছদ, আচার আচরণে, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বা বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে এই দিনটিকে আমরা একটি নিছক, গতানুতিক আনুষ্ঠানিকতার ফ্রেমে আবদ্ধ করে ফেলেছি। অথচ পৃথিবীর কোন দেশে মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্যে কোন জাতি রক্ত দেয়নি। রক্ত দিতে হয়নি মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষা করার জন্য। সারা বিশ্বে শুধুমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে বাংলার দামাল ছেলেদের মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য আত্মত্যাগ। ১৯৫২ সালের এইদিনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য রাজপথে রক্ত দিয়েছিল ইতিহাসের পাতায় রক্ত গোলাপ হয়ে ফোটা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, আউয়াল, অহিউল্লাহরা।
জাতির জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক এবং বেদনাদায়ক হলেও একথা অনস্বীকার্য যে, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও এখনো জাতিকে দাবী করতে হয় সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু করার কথা। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ঘোষণা করেছে চট্টগ্রাম থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সহ সকল ইংরেজি সাইন বোর্ড অপসারণের। এটি যে একটি মহৎ উদ্যোগ তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। কিন্তু গত বছর শুরু করলেও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় এখনো অনেক ইংরেজি সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু ইংরেজি সাইনবোর্ডের ওপর কালো কালি দিয়ে মুছে দেয়া হলেও এসব প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো তাঁদের সাইন বোর্ড বাংলায় পুনরায় না লিখে সেই অবস্থায় রেখে দিয়েছে। এখানে সিটি কর্পোরেশনের গাফেলতি বা অবহেলা যতটুকু আছে তার চেয়ে বেশী অনুভূত হচ্ছে ওসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের দেশের প্রতি প্রেম আর ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা, হৃদয়ের টানের বড় অভাব। আমরা সমাজের সর্বস্তরে বা সর্বক্ষেত্রে দেখছি দেশের প্রতি, জনগণের প্রতি, দেশে ও রাষ্ট্রের সম্পদের প্রতি আন্তরিকতার খুবই অভাব। দেশের সম্পদ লুন্ঠন করে, জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করে, দেশের খাল বিল নদী নালা জবর দখল করে রাম রাজত্ব কায়েম করছে এক শ্রেণীর অসাধু মানুষ। নদী দূষণ হচ্ছে, পাহাড় পর্বত কেটে, পুকুর, জলাশয়, ডোবা ভরাট করে আবাসন প্রকল্প হচ্ছে। গাছ কেটে বন উজাড় করে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করার পাশাপাশি পরিবেশ প্রতিবেশের ক্ষতি করে দেশের জনগণের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিরূপ সমস্যার সৃষ্টি করা হচ্ছে। অতি সম্প্রতি মাননীয় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ নদী রক্ষার জন্য যে যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন তাতে আশা করি দেশের নদ নদী পুকুর ডোবা জলাশয় রক্ষায় সদাশয় সরকার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
একথা অনস্বীকার্য যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯৭১ সালের ষোলই ডিসেম্বর একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাঙ্গালী ফিরে পায় একটু মুক্ত স্বাধীন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। পাশাপাশি বাঙ্গালীর নিজস্ব এবং স্বতন্ত্র দেশজ, লোকজ কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতি পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা আমাদের বাঙ্গালীপনাকে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ধারণ করছি না। করছি না লালন পালন প্রকাশ আর বিকাশ। আমরা দেশীয় জিনিষ ব্যাবহার করিনা। দেশীয় টিভি চ্যানেল দেখিনা। বিজাতীয় সংস্কৃতি, বিজাতীয় জীবনধারা আমাদের পছন্দের তালিকায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির অপপ্রয়োগের কারণে। সাজ সজ্জা বা লাইফ স্টাইল বা ফ্যাশানের নামে দেশজ কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় বিধিবিধান ও রীতিনীতি অনুসরণ না করে উগ্র আর অশ্লীলতা আমাদের জীবনধারায় যুক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমাদের সন্তানদেরকে আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের ভাষার জন্য, মাতৃভূমিকে মুক্ত স্বাধীন করার জন্য শৌর্য, বীর্য, বীরত্ব গাঁথার কথা বলিনা। বাংলার পরিবর্তে ইংরেজীতে কথা বলে নিজেদের স্মার্টনেসের পরিচয় দিতে আমরা অপ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছি। অবশ্যই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঠিকে থাকার জন্য, আমাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য ইংরেজী ভাষার বিকল্প নেই। দ্বিতীয় এবং আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে অবশ্যই আমদেরকে রপ্ত করতে হবে, শিখতে হবে, জানতে হবে। বাঙালীদের বিশেষ বিশেষ দিনে আমরা বাঙ্গালী হই, বাঙ্গালী সাজি তারপর থেকে আমরা আর বাঙালি থাকিনা। আমরা আমাদের জীবন যাত্রায় দেশজ সংস্কৃতি ও বাঙ্গালীত্বকে গুরুত্ত্ব দেইনা এবং যথাযথ মূল্যায়ন করিনা। আমাদের বিশ্বাস সিটি কর্পোরেশনের ইংরেজি সাইনবোর্ড অপসারণের জন্যে আরও একটি বছর অপেক্ষা করতে হবেনা। যদি তা হয় তবে তা হবে ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি চরম অবমাননা এবং অবজ্ঞা। আসুন আমরা শুধু কথায় নয় আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতির চর্চা বিকাশ আর প্রসার ঘটাই।
ছবিঃ নেট থেকে নেয়া।
১৮টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
একুশ এলেই আমাদের নানান প্রেম জেগে ওঠে, খুবই সাময়িক এ প্রেম।
প্রতিবারের ন্যায় এই দিনগুলো ও অবলীলায় পার করে দেব, এটিই যেন আমাদের নিয়তি।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আনুষ্ঠনিকতার ছকে ফেলে দিয়েছি একুশকে। যদিও একুশেই পুঁতিত হয়েছিল এদেশের মুক্তি আর স্বাধীনতার বীজ। ধন্যবাদ ভাইয়া।
মনির হোসেন মমি
আসলে দিবসতো দিবসই শুধু নিয়মে চলা।দিবসকে ঘিরে যতটা না উৎসব ততটা মনে ভাষার প্রতি টান থাকলে এতো দিনে বাংলা ভাষা আরো অনেক আগেই জগৎ বিখ্যাত হয়ে যেত। লেখাটা বাস্তবতাকে মনে করে দেয়।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
খুব প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য করেছেন ভাই — দিবসকে ঘিরে যতটা না উৎসব ততটা মনে ভাষার প্রতি টান থাকলে এতো দিনে বাংলা ভাষা আরো অনেক আগেই জগৎ বিখ্যাত হয়ে যেত।
ধন্যবাদ।
বোরহানুল ইসলাম লিটন
মাতৃভাষার ব্যবহার সর্বত্র নিশ্চিত করা উচিত
রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই ভাষার মান রাখতে।
মূল্যবান উপস্থাপনায় মুগ্ধতা একরাশ।
আন্তরিক শুভেচ্ছা জানবেন সতত।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
সমস্যাটা এখানেই — মাতৃভাষার ব্যবহার সর্বত্র নিশ্চিত করা উচিত
রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই ভাষার মান রাখতে।
ধন্যবাদ মুল্যবান মতামতের জন্য।
ফয়জুল মহী
আগে বাংলা তারপর ইংরেজি, আরবী ও ফরাসী ভাষা শিখা দরকার । বড় লোকদের পোলারা বিদেশে থাকে বাংলা জানেই না।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
অবশ্যই আগে বাংলা ভাষাকে প্রাধাণ্য দিয়ে অন্যান্য ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা আছে। ধন্যবাদ।
তৌহিদ
অনেকদিন পরে ব্লগে বাংলা ভাষা বিষয়ক লেখা পড়লাম। একুশ এলে আমাদের অনেকের বাংলা প্রেম জেগে ওঠে আবার চলেও যায়।
ইংরেজি মাধ্যম দরকার অবশ্যই তবে তা মাতৃভাষাকে দমিয়ে রেখে নয়। চমৎকার লিখেছেন ভাই।
শুভকামনা রইলো।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আপনার সঙ্গে সহমত পোষণ করছি ভাইয়া —“ইংরেজি মাধ্যম দরকার অবশ্যই তবে তা মাতৃভাষাকে দমিয়ে রেখে নয়”। আপনার মতামতে আমি মুগ্ধ এবং অনুপ্রাণিত। ধন্যবাদ।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
বিদেশী সংস্কৃতি, ভাষা, পোশাক-আশাকে আমরা এতোটাই নিমজ্জিত যে আমরা ভুলেই যাই ভাষার জন্য জীবন দেয়ার কথা। যে লড়াইয়ে ভাই হারিয়েছি সে-ই একুশ আমাদের হৃদয়ে নয় ফ্যাশনে, আদিখ্যেতায় পরিণত হয়েছে। ফেব্রুয়ারী এলেই ভাষা নিয়ে উদ্দামতা দেখি অথচ শহীদদের নাম বলতে পারে না আজকের প্রজন্ম। আমাদের পরিবার এসব তথ্যকে উহ্য রেখে দেয়। বিদেশী সংস্কৃতি ও ভাষার ব্যবহারে ই আগ্রহী বেশি। হৃদয়ে ধারণ না করলে , স্কুল-কলেজে বাধ্যতামূলক না করলে এমন অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা অবিরাম । শুভ সকাল
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
দিদি আপনি অনেক মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ মতামতা দিয়েছেন। আপনার সঙ্গে একমত — “হৃদয়ে ধারণ না করলে , স্কুল-কলেজে বাধ্যতামূলক না করলে এমন অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই”।
ধন্যবাদ।
আলমগীর সরকার লিটন
যথাযথ বলেছেন অনেক শুভেচ্ছা রইল আলম দা
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
ধন্যবাদ ভাইয়া ।
আরজু মুক্তা
” আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি। তারপর ইংরেজি শিক্ষার গোড়া পত্তন। ”
একুশ আসলেই এটা করো সেটা করো। তারপর চুপ।
এইসব বাঙালিপনা বাদ দিতে হবে। একুশ ফ্যাশন নয়। অহংকার। এটা মনে রেখে কাজ করে যেতে হবে।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আপনার সুন্দর এবং যুক্তিপূর্ণ মতামতের জন্য অশেষ ধন্যবাদ ।
জিসান শা ইকরাম
এখনো আমাদের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য লিখতে হয়। এটি যে জাতি হিসেবে কতটা লজ্জার তা বিদেশ ভ্রমনে গেলে বুঝতে পারি।
এটুকু উপলব্দি হয়েছে যে, কিছু নাক উঁচু মানুষের কারনে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন আর সম্ভব নয়।
ভালো পোষ্ট।
শুভ কামনা।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আসলেই খুব দুঃখজনক বিষয় — ‘এখনো আমাদের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য লিখতে হয়’।
ধন্যবাদ ভাইয়া, সুস্থ আরে ভালো থাকবেন ।