আমার ভালবাসা
পর্ব ২
.
ওরা বাড়তে লাগল আদর যত্নে,সীমাহীন ভালবাসায়। আমার সকালটা শুরু হয় ওদের দেখে। একটু না দেখলেই চারপাশে খুঁজতে থাকি,আবার চুরি হয়ে গেল কিনা। এভাবে চলতে চলতে আরেকটা বাচ্চা কে যেন হাপিস করে দিল। এবার রইল মাত্র দুটো ছানা। কষ্টটা মেনে নিলাম। ওদের দুটি মুখের দিকে তাকিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল। একজন হল প্রিন্স,আরেকজন প্রিন্সেস। এবার আরো সাবধান হলাম। আমার বাড়ির পেছনে কতটা খালি মাঠের মতন আছে,বাউন্ডারীতে ঘেরা। তাদেরকে খাবার দাবার দিয়ে সেখানেই রাখি, দূরে গেলে খুঁজে এনে আবার সেখানেই রেখে দেই। একটু পর পর জানালার দিকে তাকাই,দেখি ওরা ঠিক আছে কিনা। কখনো মা, কখনো বাবা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে একনজর দেখে তারা ঠিকমতন আছে কিনা। একদিন হল কি, ওদেরকে রোজকার মত বিকেলে ছাদে তুললাম। তখন মা ছাদের রেলিং এ প্রিন্সেসকে বসিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,
“তোরা নানা জায়গায় চলে যাস কেন? আমাদের জায়গাটাতে থাকতে পারিস না? তোদেরকে না দেখতে পেলে আমরা কত টেনসন করি,খুঁজে আনতে হয়। তোরা আর কোথাও যাসনে, কেমন?”
আমি সেদিন খুব হাসলেও পরদিন থেকে দেখি ওরা দূরে কোথাও যায় না। বাউন্ডারীর এপাশে নয়ত ওপাশে থাকে। তারমানে আমার ধারনা ঠিক,তারা মানুষের কথা বোঝে।তারা মাঝে মাঝে পায়ে খুব কাঁদা নিয়ে ফিরত। তখন আমি তাদের পা বেসিনে ধুইয়ে দিতাম। একদিন পা ধোয়া ও পানি খাওয়ার ফলে প্রিন্সেসের গলার লোমগুলো ভিজে যায়। আমার বোন বলল,
“এর তো ঠান্ডা লেগে যাবে!”
সে একটা কাপড় নিয়ে এল, আমি সেটা দিয়ে তার গলাটা মুছে দিলাম।সেও গলাটা তুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল,যেন ভালভাবে মুছে দিতে পারি।তারপর খাঁচাতে রাখলাম।
কিছুদিন পর এল শীতকাল। হঠাৎ করে একদিন রাতে প্রচন্ড শীত পরল।এরই মধ্যে এদের সাথে নতুন ফুটফুটে আরেকটি ছোট প্রিন্সেস যোগ হয়েছে, যে ওদের মত পুরো সাদা নয়।মাথা থেকে গলা অব্দি সাদা,গায়ে সাদা কালো ছোপ ছোপ।সে ওদের দুজনকে দেখে সব শিখে গেছে, কি করে আমার হাত থেকে কাড়াকাড়ি করে খাবার খেতে হবে, কি করে আমার কোলে চড়তে হবে,বুঝে গেছে আমি কোন ভয়ঙ্কর কিছু নই,বরং তাদের পরম আপনজন। তো সে রাতে আমি ভাবছিলাম,শীতে আমার এ অবস্হা কম্বলের নিচে থেকেও, তাহলে ওদের কি হবে? কিন্তু ওদের জন্য কি করব,তা বুঝতে পারছিলাম না। যা ভাবা তাই সত্যি হল, প্রিন্সটার ঠান্ডা লেগে গেল। ও শুধু ঝিমোয় আর ঝিমোয়। গায়ে জ্বর,কিছুই খেতে চায় না।আমার বাবা ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে ওষুধ আনলেন। ওষুধটা তেঁতো,তাই খেতে চায়না। তারপর সেটা ভাতের সাথে মিশিয়ে তাকে জোর করে মুখ হাঁ করিয়ে খাবার তুলে খাইয়ে দেয়া হল। এ কাজটা করলেন আমার বাবা। আর আমি তাঁকে সাহায্য করলাম।এরকম করে রোজ খাওয়াতে গিয়ে তার ভাইরাসটা আমার মাঝে চলে এল,আমারো জ্বর হল।বাবা হাল ছেড়ে দিলেন আমার অসুস্থতা দেখে।তবু গায়ে জ্বর নিয়েই আমি আর আমার ছোটবোন তাকে মুখে তুলে খাওয়ালাম।তাকে দৃষ্টির আড়াল করিনা,একটু পরপর দেখি কি অবস্হা, কতটুকু উন্নতি।আর প্রিন্সেসরাও তাকে ছেড়ে যায় না,গেলেও একটু পরপর এসে তাকে দেখে যায়।এরাও মানুষের সাথে থেকে মানুষের মতই পারিবারিক সম্পর্ক শিখে গেল কিনা কে জানে। এভাবে সেবা করতে করতে প্রিন্স এক সপ্তাহের মাথায় সেরে উঠল।যেদিন সুস্থ হয়ে বাকি দুটির সাথে প্রিন্সও বাহিরে গেল,আমার সে কী অানন্দ!
এবার শুরু হল প্রিন্সের নতুন দুষ্টুমি।আমার বাবার একটা ছোট্ট ফার্মেসি অাছে, সেখানে গিয়ে বাবাকে বসতে দেখে প্রিন্স বুঝে গেল এটা তারই ভাগের সম্পত্তি,সুতরাং সে এখানে যখন খুশি আসতে পারে,যা খুশি করতে পারে। তো সে বাবার টেবিলে গিয়ে ওড়ে ওঠে জুড়ে বসে। কখনো বাবার পাশের চেয়ারে বসে থাকে রাজার হালে।বাবাও কি আর করবে, তাদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে দোকানে রাখে।খাবার না পেলে লাথি মেরে বাটি উল্টে দেয়। টেবিলের ওপর বসে বাবার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাকায়,মানেটা হল
“খাবার কেন শেষ?তুমি এনে রাখনি কেন? জান না,আমি এই সময় তোমার দোকানে বেড়াতে আসি?”
এবার প্রিন্স ধীরে ধীরে কুক্কুরুক কুক…….. জাতীয় ডাক দেয়া শিখল।ফজরের আযানের আধা ঘন্টা অাগে থেকে প্রিন্স তার এ নতুন ডাকটি শুরু করে,তাদেরকে খাঁচা না খুলে দেয়া অব্দি ডেকেই যায়।পুরো বাড়ি মাথায় করে ডেকে ডেকে। তিন তলার সিঁড়ি ঘর থেকে তার এ চিৎকার পুরো বাড়িতে শোনা যায়।তারপর আবার বিকেল হলে বাউন্ডারীর ওপর উড়ে এসে বসে। যখন তারা উড়ে তখন সাদা রঙের ডানা দুটো ভারী সুন্দর দেখায়। দেয়ালের মাথায় বসে সেই কুক্কুরুক কুক….করতে থাকে,যতক্ষণ আমি না ডাকব,ততক্ষণ। যখন আমি বলব “অায় অায় অায়………” সাথে সাথে নেমে আসবে দেয়ালের মাথা থেকে।এসে একদম সিঁড়ি গেটের সামনে দাঁড়াবে।তারপর গিয়ে তালা খুলে দিলে তারা সোজা ছাদে চলে যাবে,সেখানে কিছু খাবে,আমার সাথে সময় কাটাবে,কোলে চড়বে তারপর খাঁচায় গিয়ে ঘুম দেবে।যেদিন আমি প্রিন্সকে কম আদর করব, প্রিন্সেসদের কোলে নেব, সেদিনই রেগে যাবে প্রিন্স। আমাকে কামড়ে দেবে। ওদেরকে কোলে নেবার পর অার কোলে আসবেনা প্রিন্স। আমাকে কামড়ে নেমে যাবে কোল থেকে। তবে কামড়টা দেবে শুধু পায়ে, খুঁজে খুঁজে একদম পায়ে, যেন কোন ক্ষতি না হয় আমার।
.
একদিন হল কি, আমার বাবা কতগুলো মুরগী রাখছিলেন বিক্রেতার কাছ থেকে, খাবার উদ্দেশ্যে।প্রিন্স সেটা দেখে ফেলল।দেখে ভাবল,নতুন আরো মুরগী রাখছে,তাহলে তো তাদের আদর কমে যাবে। সেই ভেবে নতুন মুরগীগুলোকে কামড় দিতে লাগল। দু ‘তিন জন মিলিয়ে প্রিন্সকে ফেরাতে পারেনা। তারপর যখন দেখল নতুনদের জবাই করা হয়ে গেল, তখন মনে শান্তি নিয়ে চলে গেল।
.
চলবে………..
৩২টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
এতো দেখছি তোমাদের পুরো পরিবারই এই প্রিন্স ও প্রিন্সেসদের সাথে নিয়ে ছিল,
তোমার আম্মার কথা শুনেছে ওরা! অবাক হলাম খুবই, গলার পানি মুছে দেয়ার জন্য গলা বারিয়ে দিত, তোমার আব্বুর দোকানে নিয়মিত যেত,
তুমি না ডাকলে সন্ধ্যায় আসতো না, প্রিন্সেসদের আদর করলে প্রিন্স রাগ করতো। এরা আসলেই বুঝে যায় সব কিছু, কথা বলতে পারেনা।
গভীর মায়া সব প্রাণীই বুঝতে পারে।
তুমি সহ মায়াময় তোমার পরিবারের সবাইকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
লেখো নিয়মিত।
নীরা সাদীয়া
একদম। ওরা আসলেই সব বুঝত। কথা বলতে পারত কিনা তা জানা যাবে পরবর্তী পর্বগুলোতে। আশা রাখি আপনাদের পাশেই পাব। শুভরাত্রি দাদা।
আবু খায়ের আনিছ
ওরে বাবা, সাহস আছে দেখছি প্রিন্সের, স্বজাতীকে জবাই করার পরেও সে খুশি হয়।
প্রথম পর্ব পড়েছিলাম ফেইজবুকে, দ্বিতীয়টা পড়লাম ব্লগে, বেশ কম্বিনেশন হচ্ছে কিন্তু।
নীরা সাদীয়া
আমার গল্পে আপনাদেরকে পাশে পেয়ে উৎসাহিত হলাম। অনেক ধন্যবাদ। পরের পর্বে আমন্ত্রণ রইল।
নীলাঞ্জনা নীলা
প্রাণীরা মুখে কিছু বলতে পারেনা, কিন্তু সব বোঝে।
আপনার ধারাবাহিক এই পোষ্টটি ভালো লাগছে বেশ।
চলুক।
নীরা সাদীয়া
হুম,এরা সবই বোঝে। আপনাদের পাশে পেয়ে উৎসাহিত হলাম। আশা করি পরবর্তী পর্বগুলোতেও পাশে পাবো। অনেক ধন্যবাদ।
নীলাঞ্জনা নীলা
আছি, লিখে চলুন।
ব্লগার সজীব
দুই পর্বই একসাথে পড়লাম। ভালবাসার প্রকাশ যে শুধু মানুষের জন্য হতে হবে তা নয়। যে কোন প্রানীর জন্যই তা হতে পারে। আপনি নিজের জ্বরের মধ্যেও এদের জ্বরের কথা ভেবেছেন! অদ্ভুত মেয়ে তো আপু আপনি।
নীরা সাদীয়া
ঠিক বলেছেন। ভালবাসা যে কোন প্রানির প্রতিই হতে পারে। আপনাদের পাশে পেয়ে উৎসাহিত হলাম। আশা করি পরবর্তী পর্বগুলোতেও পাশে পাবো। অনেক ধন্যবাদ।
মেহেরী তাজ
আপনার প্রিন্স প্রিন্সেস ভালো আছে…….!
চলুক পড়ছি নিয়মিত।
নীরা সাদীয়া
হয়ত ভালই অাছে। ভাল থাকবেন আপনিও।
আপনাদের পাশে পেয়ে উৎসাহিত হলাম। আশা করি পরবর্তী পর্বগুলোতেও পাশে পাবো। অনেক ধন্যবাদ।
বায়রনিক শুভ্র
প্রিন্স তো সেই স্মার্ট । (3
নীরা সাদীয়া
সত্যিই খুব স্মার্ট।
আপনাদের পাশে পেয়ে উৎসাহিত হলাম। আশা করি পরবর্তী পর্বগুলোতেও পাশে পাবো। অনেক ধন্যবাদ।
প্রহেলিকা
বেশ সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন। ভাল লাগলো পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়। আরেকটা কথা আপনার উপস্থাপনার ধরণ বেশ বলিষ্ঠ। পড়তে গেলে খেই হারিয়ে যায় না। সুন্দর!
নীরা সাদীয়া
আপনাদের পাশে পেয়ে উৎসাহিত হলাম। আশা করি পরবর্তী পর্বগুলোতেও পাশে পাবো। অনেক ধন্যবাদ।
শুন্য শুন্যালয়
এতো মায়া মমতা পরিবার থেকেই যে পেতে হবে। গৃহপালিত পশুপাখিগুলো এক সময় পরিবারের অংশ হয়ে যায়। কী সুন্দর করে গুছিয়ে লিখলেন। প্রিন্স তো দেখি একটা মানুষের ছানা 🙂 আদর, রাগ, হিংসা সব রয়েছে। অনেক ভালো। এখন থেকে তো নিয়মিত প্রিন্সের খবর নেবো। 🙂
নীরা সাদীয়া
ওদের প্রায় প্রতিটি আচরণই ছিল মানুষের মত,না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না আপু।
আপনাদের পাশে পেয়ে উৎসাহিত হলাম। আশা করি পরবর্তী পর্বগুলোতেও পাশে পাবো। অনেক ধন্যবাদ।
ছাইরাছ হেলাল
আপনার এ মায়াময় লেখা পড়তে পড়তে ওদেরকে-তো নিজেদের একজন
মনে করতে শুরু করে দিচ্ছি,
মায়া আর ভালোবাসা সবাই বুঝতে পারে, পশু-পাখীও এর বাইরে নয়।
নীরা সাদীয়া
ghj সে আমার পরম পাওয়া। ঠিক বলেছেন। ওরা সবই বোঝে।
আপনাদের পাশে পেয়ে উৎসাহিত হলাম। আশা করি পরবর্তী পর্বগুলোতেও পাশে পাবো। অনেক ধন্যবাদ।
অরণ্য
ভালো দেখা ও ভালো লেখা।
নীরা সাদীয়া
আপনাদের পাশে পেয়ে উৎসাহিত হলাম। আশা করি পরবর্তী পর্বগুলোতেও পাশে পাবো। অনেক ধন্যবাদ।
নীহারিকা জান্নাত
পশু-পাখিও আদর ভালোবাসা বুঝে। রাগ-অভিমান দেখায়। কিন্তু তোমার প্রিন্সেসরা মনে হয় একটু বেশিই আবেগী ছিলো। তোমাদের আচরণ দেখেই হয়তো ওরা শিখেছে এসব।
ওদের গল্প শুনতে ভালোই লাগছে।
নীরা সাদীয়া
হুম। ওরা মানুষের সাথে থেকে থেকে মানুষের মতই আচরণ করত।
শুভকামনা রইল দিবানিশি
ইঞ্জা
অবুঝ প্রাণীও আদর বুঝে, মায়ের কথা শুনে, আপনি অন্য দুজনকে কোলে নিলে প্রিন্স রাগ করে পায়ে ঠোকর দেয়, বাহ দারুণ তো।
নীরা সাদীয়া
ওরা সবই বুঝত আমার ধারনা। ওরা যে কতটা ভালবাসতে জানে তা ওদের সাথে না মিশলে বোঝা যাবে না।
শুভকামনা রইল দিবানিশি
ইঞ্জা
লিখে যান আপু আপনার অব্যক্ত কথাগুলো
চাটিগাঁ থেকে বাহার
আপনাদের তিনজনকে দেখে ভালই লাগল। গল্প সুন্দর হচ্ছে। -{@
নীরা সাদীয়া
অনেক ধন্যবাদ। শুভ সন্ধ্যে। আগামী পর্বে আমন্ত্রণ রইল।
গাজী বুরহান
খাবার না পেলে
লাথি মেরে বাটি উল্টে দেয়।
টেবিলের ওপর বসে বাবার দিকে
তাকিয়ে মাথা ঝাকায়,মানেটা হল
“খাবার কেন শেষ?তুমি এনে রাখনি
কেন? জান না,আমি এই সময় তোমার
দোকানে বেড়াতে আসি?”
.
এপিক!!
নীরা সাদীয়া
ব্যপারটা আসলে সে তাই বোঝাতে চাইত। আমার মনে হত আমি তাদের মনের কথা বুঝতে পারছি।
ধন্যবাদ। শুভসন্ধ্যা।
নিতাই বাবু
সম্মানিত ‘নীরা সাদীয়া’ দিদি, ঠান্ডার ঔষধ খাইয়ে দিয়ে খাঁচায় রাখা ভালো ছিল ।
লেখনী পড়ে বেশ মজা পেলাম দিদি ।
নীরা সাদীয়া
দাদা, ওদেরকে ঠান্ডার ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল। আর তারা দিনের বেলায় খাঁচায় থাকতে চাইতো না। চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করত। তাই বাধ্য হয়ে ছাড়তে হত। আর এক জায়গায় বন্দী থাকলে ওরা নিজেদের বিষ্ঠার জীবানুর মাঝে নিজেরাই বসে থাকবে, এতে আরো অসুবিধে হত।