আপনাকে ভুলি নাই , ভুলতেও পারবোনা

তার ছেঁড়া ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩, রবিবার, ০২:০৮:৪৫অপরাহ্ন বিবিধ ১১ মন্তব্য

দৃশ্যপট ১ => ১১ মাসের ফুটফুটে ( লোকমুখে শোনা ) এক বাচ্চা তার মায়ের কোলে বসে আছে । একজন ৪০ বছর বয়সী মহিলা তাকে কোলে নেয়ার চেষ্টা করছেন । কিন্তু বাচ্চাটি তার মায়ের কোল থেকে যেতে চাচ্ছে না । শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে যখন যেতে হল তখন সে গম্ভীর মুখে বসে আসে সেই মহিলার কোলে । সেই মধ্যবয়স্ক মহিলা তখন বলছেন , ” আরে আমার দাদাভাই , কি সুন্দর আমার দাদা ভাই । যেমন সাহেবের মত চেহারা , তেমন সাহেবের মত রাগ । হা হা হা । কি আমার সাহেব দাদাভাই , নানীর কোলে ভাল লাগে না , তাই না ? ” আর তখন সেই বাচ্চাটি তার সম্বলমাত্র ৫ টা দাঁত নিয়ে হেসে দিল ।

দৃশ্যপট ২ => সেই ১১ মাস বয়সী বাচ্চাটার বয়স এখন ৯ বছর । উত্তরাঞ্চলের শীতের মৃদু সকালে এক বিরাট বাড়ীর বিরাট আঙ্গিনায় দুরন্ত গতিতে ছুটে বেড়াচ্ছে সে । হাতের কাছে যাই পাচ্ছে তাই তার খেলার সামগ্রীতে পরিণত করছে । মূহুর্তের মাঝে সবকিছু এলমেলো করে ফেলছে । তাকে সামলাতে সবাই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে । বাড়ীর বারান্দায় বসে বসে এই কান্ডগুলো দেখছিলেন সেই মধ্যবয়সী মহিলা এবং তাঁর স্বামী । তাঁর স্বামী বলছেন , ” হায়রে খচ্চর চ্যাংড়া ! শিল্পীর ব্যাটাটা ক্যানা ভালই কচ্চর হওছে দিন দিন ! ” তখন সেই মহিলা মুচকি মুচকি হেসে বলছেন , ” তুমি চুপ করে থাক , চ্যাংড়া মানুষ দৌরঝাপ না কল্লে কি ভাল লাগে ! দাদাভাই আমার কদ্দিন পর পর আসে !!! ”

দৃশ্যপট ৩ => গ্রীষ্মকালের রাত । আকাশ পরিষ্কার । হালকা হালকা হাওয়া বইছে । আকাশে পূর্ণিমা । স্থান ওই উত্তরাঞ্চলের বিড়াট বাড়ীর আঙ্গিনা । বাচ্চাটির বয়স ১০+ । এই রাতের বেলাতেও সে স্থির হয়ে থাকছে না । আবার সেই বাচ্চার নানীর কারণে ছেলেটির মাও তাকে বকা দিতে পারছে না । সহ্যের সীমা যখন অতিক্রম করে গেছে , তখন ছেলেটির নানী সারা শরীরে কাঁথা মুড়িয়ে নিল । যেহেতু তখন গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ ছিল না , তাই তাকে ভূতুরে দেখাচ্ছি । তিনি এই অবস্থায় ছেলেটির সামনে গিয়ে তার হাত দুইটা শক্ত করে ধরে গলা মোটা করে বললেন , ” আমাকে চিনিস ? আমি ওই আড়া ( বাঁশবন ) এর মাঝের লম্বা গাছটায় থাকি । তুই খুব কচরামি করিস সেইটা আমার খুব ভাল লাগে । চল তোকে নিয়ে যাব আমার দেশে । ” এই কথা শুনে ছেলে ভয়ে কেঁদে তিনবার শপথ করে সে আর দুষ্টুমি করবেন না । ফলশ্রুতিতে সে মাত্র দেড় মাস দুষ্টুমি কমিয়ে দিয়েছিল ( ছেলেটির অভিভাবকের কাছে এটাই অনেক বেশি ) ।

দৃশ্যপট ৪ => ছেলেটি এখন কিশোর হয়ে গিয়েছে । বয়স প্রায় ১৪ । শরৎকালের রাত । সে আর তার বড় বোন মিলে তাদের নানীর দুইপাশে বসে আছে । তাদের নানী তাদের রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনাচ্ছেন । আর দুই কিশোর কিশোরী মুগ্ধ হয়ে তা শুনছে । ছেলেটির জীবনের এখন পর্যন্ত শোনা গানের গলার মাঝে সেই গলার সুরের মিষ্টতা এখনও সবার উপরে আছে ।

দৃশ্যপট ৫ => পারিবারিক জীবনে দুইটা কুলাঙ্গার সন্তানের কারণে তিনি সর্বদাই চিন্তিত থাকতেন । তাই অনাহার , অনিয়ম , দুঃশ্চিন্তায় তাঁর শরীর ভেঙ্গে পড়ে । ২০১২ সালের জুলাইয়ে তিনি পুরোদমে অসুস্থ হয়ে যান । মেডিক্যাল চেকাপে ধরা পড়ে , কিডনি ড্যামেজ , লিভার ফেইলার , পিত্তথলিতে পাথর এবং জন্ডিস ।

দৃশ্যপট ৬ => ২০১২ , ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ । মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন তিনি । বলা যায় , আল্লাহ তাকে বিনা চিকিৎসাতেই তুলে নিচ্ছেন । কারণ জন্ডিসের কারণে তাঁর কোন রোগেরই অপারেশন সম্ভব হয়নি । মৃতুর আগে তিনি বিশেষ কিছু বলে যেতে পারেননাই । ভোরের দিকে তিনি মারা যান । ( উনারা তিন বোনেরই মৃত্যুর পরোক্ষ কারণ ছিল জন্ডিস ) ।

দৃশ্যপট ১ , ২ , ৩ , ৪ এ যে ছেলেটির কথা বললাম , সেই ছেলেটি আমি নিজে । আর এই মহিলাটি আমার শ্রদ্ধেয় নানীমণি । আজ তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী ।সবাই তাঁর আত্নার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করবেন ।

না আমি শোকাহত নই । আমি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনত । আমার প্রতি আমার নানীর দুইটা ইচ্ছা ছিল যার কোনটাই আমি পূরণ করতে পারি নাই । যাইহোক , নানীমণি , আপনাকে অনেক ভালবাসি । আল্লাহ যেন আপনাকে বেহেস্তবাসি করেন ।

আমি কাঁদি নাই । আমি শোকে পাথরও হই নাই । আমি ক্রোধে , ক্ষোভে সেইদিন থেকে নানাবাড়ী যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি । এমনকি আজকেও আমি যাব না । কারণ আমার দুই মামা । তাদের দ্বায়িত্বে অবহেলার কারণেই আমার মিস্টি নানীকে তাঁর শেষ জীবনটা কষ্টে কাটাতে হয় ( টাকা পয়সার কোন অভাব ছিল না । আমার নানাভাইয়ের অঢেল সম্পদ ) ।

আমার নানীমণির অনেক গুণের মাঝে তিনটা গুণ হইল , তিনি সেলাই ফোঁড়াই এর কাজ খুব ভাল পারতেন । খুব ভাল গান গাইতে পারতেন । আর অনেক সুন্দর ও অনেক রকম পিঠা বানাইতে পারতেন ।

বিঃ দ্রঃ লেখাটি ২৮ ডিসেম্বরের । কিছু কারণের কারণে তা ২৯ ডিসেম্বর পোষ্ট করলাম ।

৭৪জন ৬০৮জন
0 Shares

১১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ