শমশেরনগর যেতে হবে। বাসার খবর নিতে হবে। বাপির কিছু কাজ ব্যাঙ্কে, সেসবও করতে হবে। তবে শমশেরনগরের নাম শুনলে একশ আটটা প্রজাপতি পাখনা মেলে মনের ঘরে। আমার কিশোরী-তরুণীবেলা ওখানে থেমে আছে। যাক সব ঠিক হলো। বড়ো মামার বড়ো ছেলে প্রীতম বললো, “দিদিভাই একা যেওনা। আমি যাবো তোমার সাথে।” হাসলাম, কিচ্ছু বললাম না। পরের দিন ভোরের বাস ধরে দুপুরে নামলাম শ্রীমঙ্গলে। শ্বাসে চা’পাতার গন্ধ। কিন্তু দেরী করলাম না, শমশেরনগর যাবো সি.এন.জি ঠিক করলো প্রীতম। সেই আগের মতো মাথাটা বের করে মুখে বাতাস লাগিয়ে সময় কতো দ্রুত পাল্টায়। বাজারে পৌঁছে গিয়ে দেখি, এই কি আমার শহর? ব্যাঙ্কের কাজ শেষ হতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে। ওই ফাঁকে দে-ছুট আমার বাগানের মাঠ, সেই বাসা, আর চারপাশ। আমরা যে বাসায় থাকতাম, সেখানে কুমকুম আপুর বড়ো ভাই শোয়েব ভাই থাকেন। ভাইকে দূর থেকে দেখেছি। খেয়াল করেননি, মটরসাইকেল করে চলে গেলেন। ভাবী ছিলেন। আর ভাবীর মেয়ে নিপুও ছিলো। নিপুর বিয়ে হয়ে গেছে। এই সেই নিপু যার জন্ম দেখেছি, যে পিচ্চিটা জানালা দিয়ে বান্ধবী, বান্ধবী বলে চিৎকার করে ডাকতো। সেই মেয়ে এখন…এই বাসাটায় অনেক আদর ছিলো আমার। চাচীর আদর আহ! কি কড়া আর রাগী চাচার আদরও পেয়েছি। চাচা-চাচীর ওই আদর সেখানে নেই বহুদিন হলো। এবার গিয়ে মনে হলো আমার জন্যে এখানে আর কিছুই নেই। একটু জল আর একটা বিস্কিট না খেলেই নয়, তাই-ই খেলাম। পাশের বাসায় এক ছুট দিলাম। সিকদার আঙ্কেলের বাসা। ছোট আন্টি এখানে নাকি আছে এখনও। অনেক বাইরে থেকে ডাক ও ছোট চাচী (ছোট আন্টি ডাকি, শুধু ভাব নিতে)আছোইন নি বাসাত? শুনতে পেলাম ছোট আন্টির গলা, “ওই পাগলী কোত্থেকে এলো? এটা তো ওই পাগলীর গলা।” বুকের ভেতর এমন এক আবেগ উথাল-পাথাল করতে লাগলো। নাহ এখনও কেউ আমার মুখ না দেখে কন্ঠ শুনেও চিনে নিতে পারে। এ যে কি আনন্দের! এই মানুষগুলোর জন্য আজ অব্দি অনেক কিছুরই বদল হয়নি। তাই হয়তো হারাতে হয়েছে যা আমি চেয়েছি। যাক সেসব কথা। দৌঁড়ে গলা জড়িয়ে ধরলাম। মনটা ভরিয়ে দিলেন একটা কথা বলে, “এই পাগলীর কন্ঠ কি ভোলা যায়? যে ভুলে, সে যে…”বাকীটুকু আর বললাম না। নিজের ভালো শুনতে ভালো লাগেনা আমার। সময় ছিলোনা। ব্যাঙ্কের ফোন। আন্টি ছাড়বেনা, ভাত খেয়েই যেতে হবে। হলোনা। ফেরার পথে ইন্টার ফ্রেন্ড কাইয়ূমের সাথে দেখা। সময় ছিলোনা, কিন্তু কথা দিতে হলো কাজ সেরে একটু হলেও দেখা করতে হবেই। ব্যাঙ্কে এলাম, কাজ সারলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামছি শমশেরনগর সুরাসর শিল্পীগোষ্টীর প্রতিষ্টাতা মীর লিয়াকত আলী চাচা আর বাপির কলিগ+আমার সহপাঠী বন্ধু জয়ন্তর বড়ো ভাই বাবুল কাকুর সাথে দেখা। যাক সময় ছিলোনা ওই হাই-হ্যালো। ওরই মধ্যে শেখরদা ছোট থেকে যাকে আমি ভাইফোঁটা দিয়ে আসছি, তার সাথেও দেখা করলাম। ফেরার পথে কাইয়ূমের ওখানে। অনেক জোর করলো খেয়ে যেতে, সময় ছিলোনা। সেদিন ঢাকা পৌঁছতেই হবে। তবে অনেক বছর পর শমশেরনগরের সেই প্রিয় দই খাওয়ালো কাইয়ূম। একটা Hug দিয়ে চলে আসতে আসতে ভাবছিলাম, এখনও কিছু থেকে গেছে এখানে আমার এই ছোট্ট মফস্বলে। নাহ মফস্বল কোথায়, দিন কে দিন যান্ত্রিক হচ্ছে মন। এ তো শহর! তারপর রওয়ানা দেবো, প্রাথমিক স্কুলের বন্ধু প্রদীপের সাথে দেখা। সেই একই রকম সহজ-সরল, একটুকুও বদল নেই। বুঝতে পারছিলাম সংসার জীবনে তেমন ভালো নেই প্রদীপ। শুধু বললো, “নীলাঞ্জনা বাসায় আসবে?” প্রদীপের মতো ছেলে এভাবে বলেনা, বরং জোর করে টেনে নিয়ে যায়। বললাম সময় নেই প্রদীপ, অন্যসময়, আবার এলে। তারপর বললো, “বেশ আছো।” বললাম হুম ভালো আছি। আজ আসি প্রদীপ? ভালো রেখো। বললো, এখনও ওভাবেই বলো, “ভালো থেকে ভালো রেখো?” বললাম হুম যাদের ভালোবাসি, তাদের জন্যে চলে আসে এই কথাটি।
শ্রীমঙ্গল আসতেই আমার রায়হান সেলিম স্যার অনুরোধ করলেন খেয়ে যেতে। স্যার একাই থাকেন। আর স্যারের অনুরোধ ফেলাটা আমার জন্য অনেক কঠিন। একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম। যা মজা লেগেছে ওখানকার দৈ। ইস এখনও জিভে জল চলে আসছে। বেশ কথা হলো, অনেক গল্প। এই স্যার তাঁর তুলনা শুধু তিনি নিজে। এতো ভালোবাসা আমি এখনও পাই, কতো বদলে গেছি। কিন্তু উনার কাছে সেই একই নীলা। আজও পাশে আছেন, জেনে গেছি আর ফেলতে পারবেনও না। এতোটাই বিশ্বাস, যা কখনো কখনো নিঃশ্বাস ফেলতে ভুল করেনা। বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা হলো। খারাপ লাগছিলো স্যারকে একা রেখে যখন চলে আসি। আজকের এই আমি’র পেছনে স্যারের অনেক অবদান। আমাদের বাসে উঠিয়ে দিলেন, বাসটা স্যারকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেলো।
স্যারের একটি লেখা না দিলেই নয়, এটাই ছিলো আমার কাছে। সেটাই দিয়ে দিলাম।
হয়তো
————— রায়হান সেলিম ।”
১৬ / ১০ / ২০১৫
শুক্রবার
ফল্গুর তীব্রতা ভালোবাসে বলেই
গোপন কাঁকড় এসে জমে জলের
অতলে
অবুঝ বলেই তো নিয়ত ঢেউ ভাঙে নদী
কতোটুকুই বা জানে তীররেখা তার
ছুঁয়ে যায়
অতলে রয়ে যায় চূর্ণ-বেদোনার অধরা রূপ !
বাতাসে দোলে কাশফুল
রাশি রাশি বিস্ময়
মায়াবী দিগন্ত থেমে যায় দৃষ্টিরেখায়
কিসের কুয়াশায় আবিষ্ট অনুভব !
বোঝা না বোঝার ঘাসফুলে সময় থমকে দাঁড়ায়
বিকেলের আবাহনে জানি হারাবে দুপুর
তাইতো পারিনা বোঝাতে
পারি কী ? হয়তো নয় ! হয়তো !!
হ্যামিল্টন, কানাডা
২৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ইং।
২৮টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
ভাল লাগলো আরেকবার পড়ে আবার হবে।
নীলাঞ্জনা নীলা
মজিবর ভাইয়া স্বাগতম। 🙂
ছাইরাছ হেলাল
সব সব জায়গা ঘুরেছেন!! স্বল্প সময়ে।
আপনার স্যারের লেখাটি সত্যি সুন্দর।
অতল তলে কিছু না কিছু জমা হয়ই।
নীলাঞ্জনা নীলা
ধন্যবাদ আপনাকে। আসলেই আমার স্যারের লেখার ভক্ত আমি সবসময়ই।
প্রিয় মানুষগুলো একেকটি স্থানকে আলোয় ভরিয়ে রেখেছে, যেতে তো হয়ই। ওটাই তো আমার সঞ্চিত সম্পদ।
মোঃ মজিবর রহমান
অতীত স্রিতি স্বরনের
মনে দাগ কেটে থাকে
মনের অজান্তে স্রিতি আওড়ায় মানুষ আমিও
নীলাঞ্জনা নীলা
পুরোনো দিনকে কেন সাদা-কালো বলে জানিনা। আমার কাছে এখনও রঙ ছড়ায় সেই সব দিন। বরং এখনকার সময়গুলো গহীন ধূসর।
ধন্যবাদ মজিবর ভাই।
মোঃ মজিবর রহমান
আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ আপু।
নীলাঞ্জনা নীলা
-{@
মরুভূমির জলদস্যু
পুরনো স্মৃতি অন্যরকম করে ডাকে, তাইনা!!
নীলাঞ্জনা নীলা
খুউব অন্যরকম। বারবার ছুটে যাই। কখনো ছবির মধ্য দিয়ে, কখনো স্মৃতির মধ্য দিয়ে।
অপার্থিব
ভাল লাগলো লেখাটি। একজন আদর্শ শিক্ষকের সঙ্গে কাটানো স্মৃতিগুলোই হওয়া উচিত একজন মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি। সাধারণত একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠিত হয় ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সে। এই বয়সে তার ব্যক্তিত্ব গঠন ও মানবিক বোধের সবচেয়ে ভাল শিক্ষা দিতে পারেন একজন আদর্শ শিক্ষক, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রেও তিনি বাবা -মার চেয়েও বেশি ভুমিকা রাখতে পারেন। সময় করে একবার সিলেট থেকে ঘুরে আসা দরকার।
নীলাঞ্জনা নীলা
স্যার এমনই একজন মানুষ, যিনি কোনোদিন কখনো কোনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। আবার অন্যায়কারীকে বোঝানোর চেষ্টা করে ফিরিয়েও এনেছেন শুদ্ধ পথে। আমাকে এতো ভালোবাসেন, পৃথিবীতে আমাকে সত্যিকারের যে ক’জন ভালোবাসে, স্যার একজন।
হুম একবার অবশ্যই সিলেট ঘুরে আসুন। আমার শমশেরনগর চা’ বাগানটাও দেখে আসবেন। যদিও সেই আমার সময়ের মতো নেই। শহর হয়ে গেছে।
ধন্যবাদ আপনাকে অপার্থিব সুন্দর মন্তব্যের জন্যে।
জিসান শা ইকরাম
একটি জীবনে মানুষের কত স্মৃতিই যে থাকে
আমরা কতটা আর মনে রাখতে পারি।
ভালো লেগেছে রায়হান সেলিম স্যারের সাথের স্মৃতি এবং তাঁর কবিতা।
স্মৃতিরা এমনি তরতাজা থাকুক আজীবন
শুভ কামনা
নীলাঞ্জনা নীলা
স্যারকে নিয়ে একটি পোষ্ট দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু দেবোনা। কারণ স্যার চাননা, যদিও মুখে বলেননি। কিন্তু স্যারের মন কিছুটা হলেও চিনি তো! বড়ো অন্তর্মুখী। নিজেকে প্রকাশ করতেই চান না। তবু দেখি, চেষ্টা চালাচ্ছি। আমার লেখার জীবনের আইকন তিনি।
হুম স্মৃতিরা আজীবন সবুজই থাকে। যেমন আমার নানা সেই আগের মতোই সবুজ আছে।
জিসান শা ইকরাম
এভাবে দেয়া যায় …………
আমি আসলে বলতে চাইনা স্যারের এই এই গুন 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
ভালো বুদ্ধি দিছো নানা। 😀 :c \|/ -{@
অনিকেত নন্দিনী
কেমন জানি গোপন হাতছানি আর দীর্ঘশ্বাসের অস্ত্বিত্ব টের পেলাম। 🙁
পেছনে ফেলে আসা ছোটোবেলার দিনগুলিতে ফিরে যেতে পারলে ভালোই হতো, তাইনা দিদি?
নীলাঞ্জনা নীলা
নন্দিনীদি দেশ আমার জন্যে। এই প্রবাস জীবন আমার নয়। হুম দেশভ্রমণের ইচ্ছে ছিলো, থাকার জন্যে! কখনোই নয়।
ছোটবেলায় নয়, আমার যেতে ইচ্ছে করে ১৯৯০ সালে। প্রজাপতির মতো ওড়ার দিনগুলো। ১৯৯০-‘৯২ নো ভাবনা-চিন্তা। আহা! 😀 🙂
নাসির সারওয়ার
জ্বালাই করে আসি।
নীলাঞ্জনা নীলা
কাকে জ্বালাই করে আসবেন ভাইয়ূ? ;?
আমি বুঝি নাই কিছুই ^:^
নাসির সারওয়ার
যাক, অন্তত একজনকে ধোঁকা দিতে পারলাম। তাও আবার যে সেই মানুষকে না।
আরে আপুনি, আমারতো মগজ প্রায়শই বাঁকাতেরা হয়ে যায়। তাই কামারের দোকানে যাই মাঝে মাঝে। গুনীজনেরা বলে, বেশী বোঝা ভালোনা। এই ফর্মুলাটা ভালো।
অনেক স্মৃতি কথাই বেশ মধুর যদি আমরা তা ভালো ভাবে সংরক্ষণ করে রাখি। যা আপনি ভালো ভাবেই রেখেছেন।
আপনার স্যারের লেখাটা বেশ ভালো লাগলো।
নীলাঞ্জনা নীলা
ভাইয়ূ আমাকে ধোঁকা দেয়া খুবই সহজ কিন্তু। এ আমার কাছের সব একান্ত আপনজনেরা জানে। তাই অনেক চিন্তা করে।
আপনার মগজ বাঁকাত্যাড়া হয়ে যায়! বলেন কি!!! তা কেমন এঙ্গেলে শুনি তো! আমার অবশ্য রেক্টাঙ্গেল। 😀
স্যার আমার জীবনের অনেক বড়ো পাওয়া। যাঁর প্রেরণায় এখানে আমি।
হ্যাপি নিউ ইয়ার ভাইয়ূ -{@
তানজির খান
“অতলে রয়ে যায় চূর্ণ-বেদনার অধরা রূপ”
ভাল লাগল প্রিয় ব্লগার। -{@ -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
স্যারের লেখা আমার খুব প্রিয়।
ধন্যবাদ ভাইয়া। -{@
অরুনি মায়া
ভাল লাগল ভ্রমণ কাহিনী | অনেক গুলো সুন্দর স্মৃতি আর কিছু হারিয়ে যাওয়া ক্ষণ | স্যারের কবিতা টাও চমৎকার |
ভাল লাগল আপু -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
স্যার আমায় এমন একটা অধিকার দিয়ে রেখেছেন, লেখাটি যে ব্লগে দিয়েছি সেটা জানিয়েছি অনেক পরে।
কিছুই বলেননি। মানুষের এতো ভালোবাসা পাই, যারা আমায় কোনো কারণ ছাড়াই অপছন্দ করে। তাদেরকে অনায়াসে তাই ক্ষমা করে দিতে পারি।
ভালো থেকো আপু। -{@
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
একশ আটটা প্রজাপতি পাখনা মেলে মনের ঘরে -{@ (y)কি কারনে 108টিই হলো নয়টি কেনো হলো না।আপনার স্যারের লেখখাাটি বেশ অর্থবহ বিরহময়।।
নীলাঞ্জনা নীলা
মনির ভাই কঠিন প্রশ্ন করে ফেললেন। আসলেই তো ১০৮ টা কেন? ১০৯ টা হলো না কেন? ভাবতে হচ্ছে। ;?
একটা কাজ করুন আপনি-ই উত্তরটা দিন প্লিজ।
স্যারের লেখা তুলনাহীন।