এক দুপুরে বাবার বাসায় দক্ষিণের জানালায় দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে এখান থেকে বাইরের কোলাহল, রিক্সা কিংবা গাড়ির হর্ন, হৈচৈ শুনতে চমৎকার লাগে। হঠাৎ দেখি রিক্সায় মামা-মামী ! গ্রাম থেকে ঢাকায় যাবার পথে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসা। কোলে ছোট্ট এক শিশু। নিঃসন্তান মামা-মামী’র কোলে ৫/৬ মাসের শিশুটিকে দেখে চম্কে উঠি। সিঁড়ি ভেঙে ঝড়ের বেগে নিচে গেইটে গিয়ে দাঁড়াই। ততোক্ষণে রিক্সাটিও এসে থামে। শিশুটি বড় বড় মায়াবী চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের দেখে। কপালের একপাশে বিশালাকৃতির এক কাজল কালো ফোটা। এতো মায়া ! আমরা আনন্দে আত্নহারা। আনন্দের বন্যা বইলো আমার অন্য কাজিনদের মাঝেও। নাম রাখা হলো ” লিরা “। লিরা’কে নিয়ে আমাদের আহ্ললাদের শেষ নেই। কমতি নেই আদর ভালোবাসার। পরদিন ওরা ঢাকায় ফিরে গেলো।
পড়াশুনার সুবাদে আমারও একদিন ঢাকায় আসা। হোস্টেলে সিট পেতে দেরি হচ্ছিল। মামার বাসা থেকে এসে যেয়ে ক্লাস করি। যতক্ষণ বাসায় থাকি, ছোট্ট লিরা’কে গল্প বলি। ছাদে এটা সেটা দেখিয়ে ভাত খাওয়াই। গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াই। ওর জন্যে আমাদের সবার অদ্ভুত এক টান। অস্বাভাবিক মমতা।
একদিন ঘটা করে লিরা’র জন্মদিন পালনের সিদ্ধান্ত হল। বাড়ি সাজানো হল। আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ করা হল। কেউ কেউ আড়ালে তির্যক মন্তব্য করছিলো, পালিত কন্যা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে বলে। কিন্তু সন্তানহীন দম্পতির ভেতরের ক্ষত, রাত গভীরে বুকচিরে বেরিয়ে আসা একাকি কান্না শুনবার কিংবা অনুভব করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা সম্ভবত কাউকে দেননি। গহীনের কষ্ট’রা গহীনেই চাপা পরে থাকে রাতের আঁধারে।
লিরা আধো আধো উচ্চারণে কথা বলতে শিখে। হাঁটিহাঁটি পা পা করে এঘর ওঘর হেঁটে বেড়ায়। এক দুপুরে সকলের অগোচরে খেলতে গিয়ে রান্নাঘরে গরম ডালের উপর পিছলে পরে। নির্ঘুম রাত কাটে সকলের। ক্ষত যতটা না শারীরিক, তার চেয়ে বেশি মানসিক। ভয়ে আতংকে আচমকা ঘুমের ঘোরে কেঁদে উঠে লিরা। আমরা তীব্র মনখারাপের মাঝে দিন কাটাই। একটা সময় লিরা সুস্থ হয়ে উঠে ঠিকই, কিন্তু মানসিক ক্ষতিটা সামলে উঠতে পারে না। স্কুলে ভর্তি হয়। কয়েক ক্লাস অবধি গিয়ে আর এগোতে পারে না। পড়া মনে রাখতে পারে না। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়।
অন্যের শিশুকে এমন নিঃস্বার্থ আদর ভালোবাসার জন্যে সৃষ্টিকর্তার পুরষ্কার স্বরূপ কিনা জানিনা, ক’বছর বাদে সবাইকে অবাক করে দিয়ে মামা-মামী’র আলোকিত ঘর আরো আলো করে দু’টি ছেলে জন্মায়। কিন্তু কোন এক দুর্বোধ্য কারনে লিরার প্রতি আমাদের সবার ভালোবাসা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়।
একদিন মামা অসুস্থ হয়। বেঁচে থাকবার শেষ সম্ভাবনাটুকুও শেষ হয়ে যায়। ক্ষণে ক্ষণে জ্ঞান হারায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে যায় জ্ঞানহীন। হঠাৎ হঠাৎ জ্ঞান ফিরে এলে কেবলই লিরাকে দেখতে চায়। আমি ফোন করলে ডুকরে কেঁদে উঠে। বলে, লিরা’র জন্যে বেঁচে থাকবার তীব্র আকাংখা তাঁর। হাজার মাইল দূরের এই শহরে ফোনের অন্য প্রান্তের আমি স্তব্দ হয়ে বসে থাকি। নয়ন জলে ভাসি। নৈশব্দ ঘিরে থাকে ঘরের আনাচ কানাচ। রাতের অন্ধকারের হাত ধরে ভোরের আলোর দিকে হেঁটে যাই একা, একেলা…
যমে-ডাক্তারে লড়াই শেষে প্রিয় মামা সব মায়া ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। বড় অসময়ে। বড় বেশি অবেলায় !
সময় গাড়ায়। আমরা নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠি। লিরা শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে এখন তরুণী। পৃথিবীতে কেউ কারো শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে না। লিরা’র সামনে তাঁর আব্বু’র জায়গাটায় অসীম এক শুন্যতা। দেশে গেলে প্রতিবার ওকে দেখতে যাই। বুকে টানি। জড়িয়ে ধরি। বলি, আমাকে চিন্ছো ? লিরা লাজুক হেসে বলে, ” তুমি রিমি আপু ” ভেতরটা কেঁপে উঠে। প্রাণপ্রিয় মামা’কে মনে পরে। হাসির আড়ালে কষ্ট লুকাই। লিরা এটা সেটা খাবার এগিয়ে দেয়। খাই। খেতে খেতে চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠে সেইসব দিন ___ যেখানে ছোট্ট লিরা’কে আমি ছাদে হেঁটে হেঁটে ভাত খাওয়াই আর গল্প বলি_____ “এক ছিল রাজকন্যা। সবাই তাকে অনেক ভালোবাসে। অ-নে-ক…”
৩১টি মন্তব্য
আবু খায়ের আনিছ
সময়ের কাছে আমরা সবাই অসহায়।
রিমি রুম্মান
সময় সময়ের মত করে গড়ায়…
জীবন জীবনের মত…
সীমান্ত সৈকত
কোন লেখা পড়ার পর পাঠক যদি একটু আনমনা হয়ে ঐ লেখা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবে… লেখা টা পড়া শেষ হয়ে গেলেও লেখার রেশ যদি অনেক্ষন থেকে যায় পাঠকের মনে…… তবে এটাই লেখকের সার্থকতা…
উপরের লেখাটা পড়ে সত্যি মনটা কেমন যেন হয়ে গেল …
অনেক বড় একটা সময় কে অনেক গুলো অনুভুতি কে ছোট্ট এই লেখার মাঝে বন্ধি করে ফেলেছ আপি
লিরার জন্যে শুভকামনা রইল
রিমি রুম্মান
সুন্দর মন্তব্য। অনুপ্রানিত হলাম। শুভকামনা আপনার জন্যেও … -{@
স্বপ্ন
আপু অদ্ভুত এক মায়ায় মনটা নেচে উঠলো।আপনার মামা অনেকের চোখ খুলে দিয়েছেন বলতে হবে।মামাকে আল্লাহ্ শান্তি দিক।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। তবে পৃথিবীতে ভাল মানুষগুলো কেন যেন খুব কম আয়ু নিয়ে জন্মায়। 🙁
অরুনি মায়া
একেই বলে মায়া। মাঝে মাঝে মনে হয় মা হবার জন্য হয়ত সন্তান জন্ম দেবার প্রয়জন সব সময় হয়না,,,,,, মা অনেক ভাবেই হওয়া যায়।।শুধু প্রয়োজন একটু মায়া,,,,,,
রিমি রুম্মান
অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তানের মত করে অনুভব করা __ এমনটি সহসাই দেখা যায় না। সেদিক থেকে লিরা অনেক ভাগ্যবতী যে এমন একটি পরিবার পেয়েছে।
জিসান শা ইকরাম
লিরার কথা পড়তে পড়তে কেমন এক ঘোড় লেগে গেলো
মায়াটাই আসলে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে
রক্ত সম্পর্কহীন লিরার প্রতি মায়াটা সবার চেয়েই বেশী ছিল
আপনার মামা অনেক ভালো একজন মানুষ ছিলেন।তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
লেখায় প্রকৃত অবস্থা বুঝাতে আপনার জুরি নেই।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন সবসময়।
শুন্য শুন্যালয়
আপনার মামা কে অন্তর থেকে প্রার্থনা জানাচ্ছি। যে মায়া মমতায় একটা মেয়েকে তিনি লালন করেছেন, বিধাতা তার প্রাপ্য সবটুকু পূন্য যেন দান করেন। অসময়েই সবাই চলে যায়, যাদের প্রয়োজন সবচাইতে বেশি। লিরা রাজকন্যা যেভাবে আদরে ছিল, বাঁকি জীবনটাও তার এমনি যাক, শুভকামনা।
আপনার লেখা এফোঁড় ওফোঁড় করে আপু।
রিমি রুম্মান
লিরা ভাল আছে সবার ভালবাসায়। কিন্তু যাকে হারিয়েছে, সে শূন্যতা শেষ নিঃশ্বাস অবধি পূরণ হবার নয়। ভাল থাকবেন আপু।
নীতেশ বড়ুয়া
আপনাদের ফেলে আসা দিনগুলোর গল্প আর বর্তমানের অনুভূতিগুলো বারেবারে অনুভূত হয় খুব বেশী ভাবে…
সবার জন্য ভালবাসা আর শান্তি কামনায় -{@ (3 -{@
রিমি রুম্মান
ভাল থাকবেন আপনিও। শুভকামনা নিরন্তর।
নীতেশ বড়ুয়া
-{@ রিমু আপু -{@
মেহেরী তাজ
আপনার লেখা বরাবর প্রাণ ছুঁয়ে যায়।
আপনাদের রাজকন্য ভালো থাকুক।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন আপনিও। সবার ভালবাসার কথা জানাবো রাজকন্যাকে।
ব্লগার সজীব
ঘটনার মাঝে ঢুকে যাই আপনার লেখা পড়ে।
রিমি রুম্মান
আপনাদের জন্যে লিখি ছোট ছোট অনুভূতিগুলো। অন্যের সন্তানকেও নিজের সন্তানের মত মায়া ভালবাসায় জড়িয়ে রাখা যায় চাইলেই। শুধু প্রয়োজন সুন্দর একটি মন।
ছাইরাছ হেলাল
দিনে দিনে গড়ে ওঠা সহজাত টান এড়ানো অনেক কঠিন।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। এই টান আছে বলেই পৃথিবী এখনো বাসযোগ্য।
সিকদার
কোথাকার কোন কন্যা নাম তার লিরা । মা নাই বাবা নাই । তারে ভালবাসে সবাই ।পালক বাবা মরণ কালেও খোজে লিরা কই ? মা ভালবাসে, ভাই ভালবাসে, ভালবাসে ভাল না বাসার মানুষগুলোও । কে দিল লিরার এত ভালবাসা স্নেহ মায়া মমতা পাওয়ার অধিকার । হে মহান প্রভু তোমার তরে মাথানত করি তুমি মহান তুমি রহমান তুমি রহিম । হদয় ছুয়ে যাওয়া লিরার জন্য শুভ কামনা।
রিমি রুম্মান
সুন্দর লিখেছেন। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসায় আপ্লুত হই। সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
অরণ্য
লিরার জন্য শুভ কামনা। ওর দুই ভাইসহ পুরো পরিবারের জন্য শুভ কামনা রইল।
আমি ভাবছি আমার ছোট বেলাতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে হয়তো অনেকে আপনার মতই ভাবতো।
ভাল থাকবেন।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকবেন আপনিও। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা আছে বলেই পৃথিবী আজ সুন্দর। শুভকামনা জানবেন।
নীলাঞ্জনা নীলা
লিরা, চোখের সামনে ভাসছে মেয়েটির মুখ। শান্ত গভীর চোখ।
অনেক ভালোবাসা মেয়েটির জন্যে।
আমার বন্ধুর একটি বোন আছে, কেউ জানতো না যে ও পালিত। এখন কতো বড়ো হয়ে গেছে। ওটাকে কোলেও নিয়েছি। পথে কুড়িয়ে পেয়েছিলো। কেউ ওকে ফেলে গিয়েছিলো। পিচ্চিটার কথা মনে পড়ে গেলো।
আপু আপনার জন্যে -{@
রিমি রুম্মান
লিরাকে ভাল একটি পরিবার থেকে আনা হয়েছিল। অনেকগুলো সন্তান, কিন্তু বাঁচিয়ে রাখার জন্যে ন্যূনত্বম চাহিদাগুলো পূরণ করবার সামর্থ্য ছিল না পরিবারটির। সৃষ্টিকর্তা কাউকে অঢেল দেয়। কাউকে দেয় না। অদ্ভুত এক বিধান। ভাল থাকবেন আপু। -{@
লীলাবতী
আপনার লেখাটি আমাকে ভিন্ন এক ভালোবাসায় জগতে নিয়ে গেলো আপু।
রিমি রুম্মান
ভালবাসাময় জগতে ভাল থাকুন। শুভকামনা নিরন্তর…
আজিম
বরাবরের মতোই সুন্দর উপস্থাপনা, যাতে আর সবার মতোই মুগ্ধতা রেখে গেলাম।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন সকলকে নিয়ে। শুভকামনা রাশি রাশি…