স্বনির্ভরতা মানে কেবল অর্থ উপার্জন নয়। স্বনির্ভরতা মানে রোজকার জীবনের যে কোন কাজে অন্যের উপর নির্ভরশীল নয়, এমনটি বোঝানো হয়। যুগ যুগ ধরে আমাদের বাঙালি সমাজের রীতি হয়ে এসেছে যে, সংসারে একজন নারী অবধারিতভাবে সব কাজ করবেন, অর্থাৎ সন্তান লালন-পালন সহ পরিবারের প্রতিটি সদস্যের দেখভাল করবেন। গৃহিণীরা রান্না করবেন, কাপড় কাঁচবেন আর পরিবারের কর্তা অর্থ উপার্জন করবেন, বাজার করবেন, এমনটিই আমাদের সমাজ সংসারে চিরকাল দেখে এসেছি। কিন্তু বিদেশে আসার পর সব রীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আমাদের সংসার জীবন শুরু হয় ভিন্ন স্রোতে। স্বামী বাহিরে চাকুরির পাশাপাশি রান্না করেন, ঘরদোর পরিষ্কার করেন। আমি বাহিরে চাকুরি করে এসে লন্ড্রি করি, বাজার করি। এভাবেই আমরা আমাদের দৈনন্দিন কাজকে ভাগ করে নেই। অর্থাৎ যার দ্বারা যে কাজ সহজ হয়, সে-ই সেই কাজটি করে গিয়েছি যত্নের সাথে। যেহেতু দেশে বাবার সংসারে থাকবার সময়ে লেখাপড়ার বাহিরে অন্য কোন কাজ খুব একটা করা হয়নি কখনো, তাই রান্নার বিষয়ে পুরোপুরি অজ্ঞ ছিলাম। বিধায় এই দায়িত্ব তিনিই নিজের কাঁধে তুলে নেন। এ নিয়ে আমার অনুযোগের শেষ ছিল না। বাবার বাড়িতে করিনি তো কী হয়েছে, চেষ্টা করলে অবশ্যই রাঁধতে পারবো। এ বিষয়ে আমার স্বামীর ভাষ্য ছিল, আগে দেখো, শিখো তারপর না হয় করা যাবে। সময়ের সাথে সাথে এ কাজটিও শেখা হয়ে যায় একদিন। প্রবাসের কর্মব্যস্ত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠবার পর একটা সময় আমাদের আর কাজ ভাগাভাগি করা হয়ে উঠত না। কোন কাজই কারো জন্যে নির্দিষ্ট থাকতো না। যখন যার সময় হতো, তারই করে ফেলা হতো সে কাজটি। সন্তানদের স্কুলে মিটিং, ডাক্তার এপয়েনমেন্ট কিংবা রান্নার কাজটি করার জন্যে কেউ কারো দিকে তাকিয়ে থাকা হতো না। যার সময় হয়েছে সে-ই করে ফেলেছি। এ তো গেলো আমার সময়ের কথা। কিন্তু আমার পূর্ববর্তী সময়ে আমার কর্মজীবী মাকেও দেখেছি সংসার এবং কাজ সমান্তরালে চালিয়ে নিয়েছেন। কোন একটি কাজ বাবার জন্যে ফেলে রাখতেন না। আবার কখনো মায়ের অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলে বাবা নিজেই চুলায় ভাত চড়িয়ে দিয়েছেন, এমনটিও দেখেছি অনেক সময়। অর্থাৎ তাঁরা দু’জনেই অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি যে কোন কাজে কেউ কারো উপর নির্ভরশীল ছিলেন না।
বছর কয়েক আগে এক বাঙালি গ্রোসারি স্টোর থেকে নিয়মিত কেনাকাটা করতাম। স্টোরের মালিক স্ত্রী সন্তান নিয়ে একই বিল্ডিং এর উপরের তলায় বসবাস করতেন। দোকানটি জ্যকসন হাইটসের কোলাহল আর যানজট থেকে খানিকটা দূরে নিরিবিলিতে হওয়ায় এবং পার্কিং সুবিধা থাকায় আমি তাদের নিয়মিত ক্রেতা ছিলাম। কখনো কখনো ক্যাশ কাউন্টারে কাউকে না দেখলে অপেক্ষা করতাম। ক্ষণিক বাদে স্টোরের মালিক হন্তদন্ত হয়ে ফিরে আসতেন এবং আবারো ক্রেতাদের চাহিদা মেটানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন। একদিন খুব দুঃখ করে বলেছিলেন, ছেলেকে স্কুল থেকে এনে, খাইয়ে তবেই এসেছেন, তাই দেরি হয়েছে ফিরতে। সংসারের অনেক কাজই স্ত্রী করতে পারেন না, বাহিরে যেতে ভয় পান, ইংরেজি বুঝতে এবং বলতে পারেন না। তাই তাকেই ব্যবসার পাশাপাশি সংসারের কাজও তদারকি করতে হচ্ছে। খুব আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন, আল্লাহ না করুক কখনো যদি আমি না থাকি, ছেলেটিকে মানুষ করতে তার মায়ের অনেক কষ্ট হয়ে যাবে। একদিন খবর পেলাম ভোরের দিকে তীব্র বুকের ব্যথা নিয়ে তিনি লিভিং রুমের সোফায় ঢলে পড়লেন। এ্যাম্বুলেন্স এলো। হাসপাতালে নেয়া হলো। তারপর চির চেনা ঘরে স্ত্রী-সন্তানের কাছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আর ফিরে এলেন না তিনি। ফিরলেন নিথর দেহে জন্মভূমিতে। স্বামীর এহেন আচমকা মৃত্যুতে একমাত্র শিশু সন্তানকে নিয়ে স্ত্রী পড়লেন অথৈ সমুদ্রে।
আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু আছেন যিনি দেশে গিয়ে চমৎকার রূপবতী এক তরুণীকে বিয়ে করে এদেশে নিয়ে এসেছেন। বিত্তশালী বাবার একমাত্র কন্যাটি এদেশে আসার পর কোন কাজ করতে চাইতেন না। ফলে দীর্ঘ সতেরো বছরের প্রবাস জীবনেও তিনি পথ চিনে কোথাও যেতে পারেন না। ট্রেন, বাসে একাকি চলাচল করতে পারেন না। অর্থ উপার্জন থেকে শুরু করে স্ত্রীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া সহ যাবতীয় কাজ স্বামী একাই সামলাচ্ছেন। একদিন সেই বন্ধুপত্নী কথা প্রসঙ্গে বললেন, ও যেহেতু এই দিকটা দেখাশুনা করছে, আমার আর তা দেখার দরকার নেই। এই যে ‘ স্বামী যেহেতু এইদিকটা দেখাশুনা করছেন, আমার আর তা দেখার প্রয়োজন নেই ‘ এই মানসিকতা থেকে আমাদের নারীদের বেরিয়ে আসতে হবে। আত্নসম্মানবোধে বলিষ্ঠ একজন নারী কখনোই অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠে না। প্রবাসের কঠিন জীবন যুদ্ধে অন্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে সংসার সামলানোর পাশাপাশি নিজের প্রয়োজনীয় সবকিছুর সংস্থান যখন নিজেই করতে পারবে তখনই একজন নারীকে স্বনির্ভর, স্বাধীন বলা যাবে।
আবার আমাদের আশেপাশে অনেকেই আছেন যাদের এদেশে থাকবার বৈধ কাগজপত্র নেই। এদেশে শিক্ষা, চিকিৎসার মতো সামাজিক সুযোগ সুবিধা অনেক বেশি হওয়ায় সন্তানদের উন্নত ভবিষ্যতের কথা ভেবে হাজারো না পাওয়ার মাঝেও তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশায় বুক বেঁধে থাকেন, একদিন নিশ্চয় স্রষ্টা সদয় হবেন। এই ভিনদেশে পরাধীনতার বন্ধ দুয়ার খুলে বেরিয়ে আসবেন, বুক ভরে শ্বাস নিবেন। নতুন করে স্বপ্নের জাল বুনবেন। যেহেতু তাঁদের জীবনের সাথে যুদ্ধটা বৈধ কাগজপত্রওয়ালাদের চেয়েও অনেক বেশি, তাই তাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের আত্ন নির্ভরশীল হয়ে উঠা আরও বেশি জরুরি। এই তো ক’দিন আগেই এই শহরে আমাদের চেনা আপনজন আহমেদ হোসেন বাবু ভাইকে ইমিগ্রেশন পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। আকস্মিক এই ঘটনায় আমরা যারপরনাই ব্যথিত হই। জানতে পারি, দীর্ঘ তিন দশকের কাছাকাছি সময়ের প্রবাস জীবনে বৈধ কাগজপত্রের কোন কূল কিনারা করে উঠতে পারেননি তিনি। যেহেতু তার বিরুদ্ধে আদালতের ডিপোরটেশন অর্ডার ছিল, তাই ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে প্লেনে তুলে দেয়। এই ভিনদেশে রয়ে যায় স্ত্রী, পুত্র, কন্যাসহ এতদিনের বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী সকলে। একজন দায়িত্বশীল, স্নেহশীল বাবা হিসেবে সন্তানদের দেখভাল তিনিই করতেন। কন্যা শান্তিকে সব সময় সাথে করে নিয়ে আসতেন কবিতার অনুষ্ঠানগুলোতে। পিতা কন্যা দু’জনেই আবৃত্তি করতেন। এই স্বর্গীয় দৃশ্য আমাদের আর দেখা হবে না, হয়তো। জানা যায়, বাড়ির মর্টগেজ, ভাড়াটে সামাল দেয়া সহ কাগজপত্র সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ তিনি নিজেই করতেন। একটি পরিবারের এমন একজন দায়িত্বশীল মানুষের এমন আচমকা বিচ্ছেদও কী পাওনা ছিল ? কিন্তু নিয়তির বিধান খণ্ডাবার সাধ্য যে আমাদের নেই ! এহেন বিচ্ছেদে পরিবারটি অথৈ সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়াটাই স্বাভাবিক।
তবুও মানুষ প্রাণপণ শক্তি দিয়ে খড়কুটো ধরে ভেসে থাকতে চায়। উত্তাল সমুদ্রও একসময় শান্ত হয়ে আসে। সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়া তুমুল ঝড়ও একসময় থামে। মানুষ আবারও মাথা তুলে ঘুরে দাঁড়ায়। অবিরাম এই ঘুরে দাঁড়ানোর নামই জীবন।
রিমি রুম্মান
কুইন্স, নিউইয়র্ক
১৪টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
অবিরাম ঘুরে দাঁড়ানোর নাম জীবন, একথাটি মানি,
কিন্তু অনেকের-ই ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন স্বপ্নেই থেকে যায়।
রিমি রুম্মান
সময় কখনো কখনো মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে শেখায়।
মোঃ মজিবর রহমান
অবিরাম ঘুরে দাঁড়ানোর নাম জীবন, একথাটি মানি,
কিন্তু অনেকের-ই ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন স্বপ্নেই থেকে যায়। মানলাম
রিমি রুম্মান
কিছু বিষয় না মেনে উপায়ও নেই।
জিসান শা ইকরাম
লেখাটির মাঝে শিক্ষনীয় অনেক কিছু আছে দিদি ভাই৷ বাংলাদেশের সমাজে স্বামী এবং স্ত্রীদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দেয়া, আমরা এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না।
প্রতিটি নারীরই উচিত তিনি যেন জীবনে একা চলতে পারেন, তার সক্ষমতা অর্জন করা।
প্রবাসে ভাল থেকো দিদি ভাই।
শুভ কামনা।
রিমি রুম্মান
দেখার মাঝে প্রতিনিয়ত শিখছি, দাদা ভাই।
আরজু মুক্তা
এই দেশে শেয়ার করার মানসিকতা নাই।বাড়ির কাজ মানে নারী! কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবো?স্বপ্নগুলো বরাবরই মুখ থুবড়ে মরে।এখানে,আৃরা নারীরা তিনদিকে ছুটি।
রিমি রুম্মান
দীৰ্ঘদিনের পুরোনো নিয়ম ! তবে এর পরিবর্তন হতে সময় লাগবে হয়তো।
আরজু মুক্তা
পুরুষতন্ত্র আপু।।
মাছুম হাবিবী
একান্ত অনুভূতিটা দারুন ছিল। সময় আর ব্যস্তবতার সাথে যারা নিজেকেে মানিয়ে নিতে পারে আমার মতে তারাই সেরা।
সুন্দর লিখেছেন শুভ কামনা
রিমি রুম্মান
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। শুভকামনা রইল।
শামীম চৌধুরী
সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পে পড়েছিলাম
বাঙালী দেশে ইতর, বিদেশে কাতর। আপনার লেখাটি পড়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পের সেই লাইনটি মনে পড়ে গেল। জ্বী ঘুরে দাড়ানোর নামই জীবন। আপনার লেখায় অনেকেই অনুপ্রানিত হবে ঘুর দাঁড়ানোর।
শিরিন হক
যারা মানিয়ে চলেছে জীবনে মানিয়ে নেওয়ার সাহসীকতায় তারাই জয়ী হতে পেরেছেন।
একান্ত অনুভূতি অনেক শিক্ষনীয় অনেকের জন্য।এদেশেও এখনও অনেক নারী আছেন প্রয়োজনের তাগিদে অথৈ জলে পড়ে মানিয়ে নেয়া শিখে গেছেন।
মনির হোসেন মমি
আমাদের মত মানষিকতা আর ওদের…অনেক পার্থক্য।অনেকে ঘুরে দাড়াতে চাইলও হয়ে উঠে না হয়তো কোথাও কোন ভুল থাকে।তবে সংকল্প যদি থাকে স্থির তবে ঘুরে সে দাড়াবেই।চমৎকার লেখা আপু।এমন লেখায় জীবন চলার সঠিক পথ খুজেঁ পাই।