* যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম, মহেশখালীর পানখিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম *
* পান খেয়ে ঠোঁট লাল করিলাম, বন্ধুর দেখা পাইলাম না *
পান নিয়ে এমন অনেক গান আমরা শুনেছি। এই আমার ও আপনাদের খসড়া ভাইয়া আপুর আড্ডার সময় পান ছাড়া চলেই না। যাই হোক, মূল কথায় আসি।
দক্ষিন ও দক্ষিন এশিয়ায় পান একটি জনপ্রিয় ও পরিচিত খাবার। সাধারণত অতিথী আপ্যায়নে কিংবা কোনো বৈঠকে আলোচনা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে পানের ব্যবহার দেখা যায়। পান বলতে শুধু পান পাতা খাওয়াই বোঝায় না। সাথে থাকে অবশ্যই ঠোঁট লাল করার চুন ও সুপারি। আর ভারত বর্ষ ও বাংলার রসনা বিলাসী মানুষের কাছে পান একটি অতি প্রিয় খাবার। সেই পানে স্বাদ যোগায় চুন সুপারি। সুপারি একধরনের ফল তা গাছে ধরে সবাই জানি। কিন্তু চুন প্রস্তুত করতে হয়। বাংলাদেশে একসময় চুন বলতে বোঝাত, শামুক ও ঝিনুকের তৈরী চুন। কিন্তু কালের বিবর্তনে এই জৈব উপায়ে তৈরী চুন বিলুপ্তির পথে। তাই এখন আমরা বাজারে দুই ধরনের চুন দেখলেও *পাথুরে* চুনই বেশী দেখি। পাথুরে চুন তৈরী হয়, ‘চুনাপাথর’ ও অন্যান্য ক্যামিকেল দিয়ে। যা মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই চুন আসলে ঘরবাড়ি চুনকাম করার জন্যও অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য। পাথুরে চুন মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই পাথুরে চুন মানুষের শরীরের ক্যালসিয়াম ও শক্তি ক্ষয় করে, জীবনী নষ্ট করে, পাকস্থলী নষ্ট করে, দাঁত ক্ষয় করে। এই জন্য কোনোমতেই পাথুরে চুন খাওয়া উচিৎ নয়। তবে একথাও সত্য যে জৈব অথবা অজৈব উভয় প্রক্রিয়ায় চুনাপাথর গঠিত হতে পারে। অধিকাংশ চুনাপাথরই উচ্চমাত্রায় জীবাশ্ম সমৃদ্ধ এবং সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত যে, প্রাচীনকালের ঝিনুক রাজি অথবা প্রবাল বলয়ের সঞ্চয়নকে উপস্থাপন করে থাকে। তবে এই চুনাপাথরই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন ক্যামিকেল মিশিয়ে তা বাজারজাত করে। সেই চুন অনেকে ব্যবহার করে ঘরবাড়ি চুনকাম করতে, অনেকে খাওয়ার চুন হিসেবে। অন্যান্য কাজ তো আছেই। এই চুনে এ্যাসিডের পরিমান বেশী থাকে। তথ্যসূত্র বাংলা পিডিয়া।
অন্যদিকে জৈব উপায়ে তৈরি খাবার চুন হিসেবে এই শামুক ঝিনুকের চুন মানুষের শরীরের জন্য উপকারী। এই চুন বা, শ্লেষ্মা, মেদোরোগ, অম্ল-পিত্ত-শূল, ব্রণ, গ্রহনী(পাকস্থলী জাতীয় রোগ), ক্রিমি রোগ নষ্ট করে। ৮ তোলা চুন দশ সের পানির মধ্যে দুই প্রহর অর্থাৎ ছয় ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে সেই পানির সাথে দুধ মিশিয়ে পান করলে মধুমেহ রোগ প্রশমিত হয়। এই পানিয়টি অম্লপিত্ত ও শূল রোগের পথ্য ও ঔষধ। ঝিনুক চুনের মধ্যে মুক্তার গুন পাওয়া যায়। আর আমরা সবাই জানি, আমাদের চামড়ার উপরের অংশ অর্থাৎ টিস্যুর গঠনে যে উজ্জ্বলতা তা সোনা ও মুক্তার কারনে। একটা বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলিঃ একবার ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলতে গিয়ে, ভিমরুলের চাকে খোঁচা দিয়েছিলাম। আর যাবা কোথায় ! দুইটা ভিমরুল বসে পড়ল নাকের উপর। কোনোরকম পাশে থাকা পুকুরে ঝাপ দিলাম। ওরাও পিছু নিল আমার। ডুব দিতে দিতে একটা কামড় বসাল পিঠে। সে বার দেখেছি নানীর হাতে বানানো ঝিনুক ও শামুকের তৈরি চুনের যাদু। তিনি আমার ভিমরুলের কামড়ানো স্থানে এই চুন লাগিয়ে দিলেন। কিছুক্ষনপরে সেই তীব্র যন্ত্রনা কমে গেল, ফোলাও কমে গেলো। আগেই বলেছি আগে গ্রামের গেরস্তবাড়ির অনেকেই নিজেদের খাওয়ার জন্য ও চুন তৈরি করত।
এবার চুন চুন প্রস্তুত প্রণালী দেখিঃ
এই চুন তৈরীর জন্য দরকার শামুক ঝিনুক । তাই কিছু মানুষ চুন তৈরীর জন্য সুন্দরবনের ভিতরে ছোট ছোট খালে প্রবেশ করে, শামুক ও ঝিনুক সংগ্রহ করার জন্য। তারা এগুলো সংগ্রহ করে স্থানীয় হাঁটে বিক্রি করত। আবার অনেকে নিজেরাই তৈরী করত। চুনুরিরা এসব হাঁট থেকে শামুক ও ঝিনুক সংগ্রহ করত। এই চুন প্রস্তুত খুবই চমকপ্রদ এবং সময় সাপেক্ষ ব্যপার। চমকপ্রদ এজন্য বললাম, কারন এই চুন প্রস্তুতের সময় তারা বিভিন্ন সাবধানতা অবলম্বন করে। মন্ত্র পড়ে, বনের দেবদেবীকে স্মরণ করে। চুনিরিদুর ধারনা অলক্ষি কেউ এই চুন তৈরীর সময় নজর দিলে চুন ভাল ফুটে সাদা হবে না। চুন কালো হয়ে যাবে, অলক্ষির মুখের মতো। তাই অনেক রাখঢাক করেই এই চুন তৈরী করত চুনেরা। স্থানীয় ভাষায় এদের চুনে বলা হয়। তবে আমার শশুরবাড়ির এদাকে অর্থাৎ উত্তরাঞ্চলে এদের *জুগে* বলা হয়। চুনেরা বা জুগিরা ছাড়াও এই চুন তৈরি করে অনেক গেরস্থ বাড়ি। যেমন আমি আমার নানিকে দুখেছি এই চুন তৈরী করতে। আমার নানা ও দাদাবাড়ি সুন্দরবন সংলগ্ন রামপাল উপজেলায়। তাই আমি সখের বশেই কিয়াম মামার সাথে ঝিনুক ও শামুক খুঁটে এনেছি নানাবাড়ির পাশেই খাল থেকে। আহা! আমার সেই শৈশব! যাই হোক, চুনুরিক চুন তৈরীর জন্য ঝিনুক ও শামুকের উপরের শক্ত আবরনটি নিতই নিত। আর ভিতরের নরম অংশটুকু বাড়ির হাঁস মুরগির খাবারের জন্য কাজে লাগাতো। উপরের শক্ত খোলসটি খুব ভাল করে পরিষ্কার করে অল্প রোদে শুকিয়ে নিত প্রথমে।
অন্যদিকে গরুর গোবরের গোল গোল চাকতি করে রোদে ভাল করে শুকিয়ে নিত যেন, জ্বালানী হিসেবে এটি ভালমতো পোড়ে। শামুকের ও ঝিনুকের শক্ত খোলসটি এই গোল চাকতির উপরে রেখে তার উপর আবারো চাকতি দিত এভাবে পর্যায়ক্রমে এটি উপরের দিকে উঠাত। এবং চাকতির মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় তুষ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিত। গোবরে্র চাকতিগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেলে আলত করে শামুক ও ঝিনুকগুলো উঠিয়ে গরম ফুটানো পানিতে ছেড়ে দিয়ে জোরে জোরে বাঁশের লাকড়ি দিয়ে ২০/২৫ মিনিট নাড়তে হয়। আমি দেখেছি নানিকে খেজুরের রস জাল দেওয়া *তাফোলে* ( এক ধরনের পাত্র) এই শামুক ও ঝিনুকগুলো ফুটাতো। মজার ব্যাপার হলো, আগুনে পুড়ে শামুক ও ঝিনুকগুলো সাদা রং হয়ে যেতো।। এই শামুক ও ঝিনুকগুলো ফুটানো পানিতে ফুটানোর সময় অনেকে চুনের রং আরো সাদা করার জন্য কাঁচা কলার রস মিশায়। ৫০ কেজী চূর্ণ বিচূর্ণ পোড়ানো শামুক ও ঝিনুক ফুটালে ১৫০ থকে ১৮০ কেজী খাওয়ার চুন পাওয়া যায়। অনেকে আবার অন্য পদ্ধতিতেও এই জৈব চুন তৈরী করে। যেমন এই উত্তরাঞ্চলে মাটির এক ধরনের বিশেষ চুলায় ও মাটির পাত্রে চুন পোড়ায় ও ফুটায়।
আমি এই চুনকে জৈব চুন বলি কারনঃ এই চুনে রাসায়নিক কোনো ধরনের ক্যামিকেল মেশানো হয় না।
চলবে……………
সুন্দরবন সংলগ্ন শ্রমজীবী মানুষ – চুনশিল্প – ১
২৪টি মন্তব্য
ইঞ্জা
আমি একবার টিভিতে চুন বানানো দেখেছিলাম কিন্তু আজ বিস্তারিত জানলাম আপু। 🙂
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ, ভাই। শুভকামনা রইল।
ইঞ্জা
আপনাকেও ধন্যবাদ আপু। 🙂
ছাইরাছ হেলাল
ভাবছি এত্ত খুঁটিয়ে দেখলেন কীভাবে!
রীতিমত গবেষনা পত্র তৈরি করে ফেলেছেন দেখছি।
মৌনতা রিতু
সত্যিও এটা গবেষনামূলক লেখা। আমার এক বড় দাদা বিদেশী একটা পত্রিকার জন্য লিখতে বলেছিল। এই লেখার জন্য গিয়েছিলাম কুড়িগ্রামের জুগি পল্লিতে।
ধন্যবাদ ভাই।
নীলাঞ্জনা নীলা
এতোকিছু জানা ছিলোনা। তোমার অনেক ধৈর্য শান্ত-সুন্দরী।
অপেক্ষায় আছি পরের পর্বের জন্য।
মৌনতা রিতু
দেখতে হবে না! শিষ্যটি কার! 🙂
তোমার জন্য আজই ঐ লেখাটা দিব। তোমাকে উৎসর্গ করব। কোনোদিন ভাবিনি আমার এইভাবনাটক কারো এতো ভাল লাগবে। ধন্যবাদ গুরুজী। অনেক ভালবাসা নিও।
নীলাঞ্জনা নীলা
আরে শিষ্যটি কার বলোনা শান্ত-সুন্দরী। বরং বলো আমি-ই শিখতে চাইছি এমন ধৈর্য কিভাবে তৈরী করতে পারি নিজের জন্য! :p 😀
মিষ্টি জিন
আমরা যারা দক্ষিনের মানুষ। পান ছাডা আমারা মেহমান আপ্যায়ন ভাবতেও পারিনা।আর আমার মনে হয় দক্ষিনাজ্ঞনের মানুষ পাথর্র চুন না ঝিনুকের চুন ব্যাবহার করে। এই চুনে গাল পোডে না।
অনেক অনেক ভাল লিখেছো রীতু আপু। এত পড কখন?
আচ্ছা ছোট্ট একটা কথা .,,,না মানে ইয়ে চুনের অনেক উপকারী গুনের কথা বললে, তাই জানতে চাইছিলাম ,চুন দিয়ে ফেইস প্যাক বানিয়ে যদি মুখে দেই তাহলে কি ফরসা হতে পারবো? :D)
মৌনতা রিতু
এই চুন মুখে মাখবা ^:^ 🙁 মোরে কিন্তু জেলে যেন যাইতে না হয়। ও আপু তুমি এমনিতেই একের সুন্দর। খবরদার এমন কাম কইরো না। তবে আপু ইয়ার্কি না, সত্যি আমি আমার দুইছেলেকে এলোপথি ওষুধ কম খাওয়াই। ঠান্ডা লাগলে তুলসি পাতা। কালোজিরা। পেটে ব্যাথা হলে, হাতে শরিষখর তেল মেখে মোমবাতির উপর ধরে এই উষ্ণ হাত বাবুদের পেটে দিতাম। ওদের বেশ উপকার হতো।
আমাকে এটা কে শিখাইছিল জান ? ডাক্তার এম আর খান স্যার। তখন ধানমন্ডিতে উনি ছিলেন। কেন যেন আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। গেলেই হেসে দিতেন। সত্যি আপু ডাক্তার আইভি আপা ও এম আর খান স্যার আমার এক অন্য রকম শ্রদ্ধার মানুষ।
ভাল থেকো আপু। অনেক ভালবাসা নিও।
মিষ্টি জিন
হা হা হা ., চুন মাখার কথা না বললে তুমি হাসতা ?
এম আর খানের কাছে আমি ও কৃতজ্ঞ। আমার মেয়েদের চিকিৎসা উনিই করেছেন । হোম রেমিডি পুরো বিশ্বে বেশ জনপ্রিয়। ইন্দোন্শিয়ানদের থেকে কিছু শিখেছিলাম আর বাকিটা আমার চাইনিজ বন্ধু আমাকে শিখিয়েছিল।
তুমি ও ভালথেকো ।
মৌনতা রিতু
ভাল থেকো আপু। -{@
অনিকেত নন্দিনী
আরিব্বাপরে! এত্ত কাহিনী করে চুন বানাতে হয়? এতোকিছু তো জানিতামই না। এই পোস্ট পড়ে জানতে পেলাম। (y)
আমি যেখানটায় থাকি এখানে পাথুরে চুনের দেখা মেলেনা। নানু আমার কাছে এসে থেকেছিলেন কয়েকবার। তখন তাঁর জন্য চুন কিনতে গিয়ে কৌটোয় বাজারজাত করা ঝিনুক চুনই পেয়েছি। তাই আগের পর্বের মন্তব্যে বলেছি ঝিনুক চুনের সহজলভ্যতার কথা।
মৌনতা রিতু
না, আপু, ঝিনুকের চুনই কম পাওয়া যায় এখন। এ নিয়ে পরের পর্বে জানতে পারবে।
ভাল থেকো আপু। অনেক ভালবাসা নিও। -{@
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
মাগ্গো এতো তথ্য!চুন যে একপ্রকার ঔষধ আপনার লেখা না পড়লে এ ভাবে বিস্তারিত জানা হতো না।আর চুন তৈরীর চুলাটি আমি এ প্রথম দেখলা্ম।দেখি সামনে আরো কি আছে। -{@
মৌনতা রিতু
সামনে দেখি কতোটুকু তথ্য আনতে পারি। সাথে থাকবেন সবাই। তাইলেই পারব। অনেক শুভকামনা রইল ভাই।
আবু খায়ের আনিছ
প্রস্তত প্রনালী দিয়ে দিয়েছেন, এবার দেখি সোনাদের কেউ এটা বানায় কিনা।
আমার কাছে ঝিনুকের মূল্য ছিল এক সময় মাছের খাবার বানানোর জন্য, যখন মাছের খামার ছিল।
মৌনতা রিতু
ও ভাই এই আপনাদের জন্যই তো ঝিনুক শামুক কমে গেল :@
পরের পর্বে দিব এই বিষয়গুলো।
ভাল থাকুন ভাইটু। শুভেচ্ছা রইল।
রুম্পা রুমানা
আগে হালকা হালকা জানতাম ।এখন ভাল করে জানা হলো। সুন্দর পোস্ট , আপু ।
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ, আপু। শুভকামনা রইল। ভালথাকুন। সাথে থাকুন।
শুন্য শুন্যালয়
ভাবীজান, ও ভাবীজান মন্তব্য দিমু না ভাগমু? ডড়াইছি। আসো তোমার মাথায় তেল বুলিয়ে দেই বিলি কেটে। মাথা ঠান্ডা হবেই হবে। লেখা নিয়া মন্তব্য পরে দিতাছি গো ভাবীজান।
মৌনতা রিতু
সত্যি মাথা গরম হইছিল। সন্ধ্যার আগেও গোসল করলাম। ঘাড় ধরে গেছিল।
ততোমার কি অবস্থা? কেমন আছ ?
বাবাটা কেমন আছে ?
ব্লগার সজীব
খুব অবাক হচ্ছি আপনার বিষয়বস্তু নির্বাচন দেখে। এ বিষয়ে আপনার মাধ্যমে এই প্রথম জানলাম। অত্যন্ত পরিশ্রমের ফসল আপনার এই লেখা। জানছি সুন্দরবনকে ঘিরে বিভিন্ন পেশার মানুষদের সম্পর্কে। ধন্যবাদ এমন লেখার জন্য।
মৌনতা রিতু
ধন্যাবাদ ভাবু ভাই। যাক দেখা মিলতেছে আমাদের সদা হাস্যজ্জল ভাইটার।
ধন্যবাদ। এবখর হারালে খবর আছে :@ তবে জীবনের বাস্তবতাও বুঝি ভাই। মন থেকে দোয়া রইল।