পরিবারের সবাই একত্রে বসে নাটক দেখার মধ্যে অন্যরকম একটা আনন্দ আছে। মন খারাপের দৃশ্যে সবাই একসাথে মন খারাপ করে বসে থাকে। হাসির দৃশ্যে সবাই একসাথে হাসে। পরিবারের সবাই মিলে একসাথে হাসে, এরচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর কি হতে পারে!
সময় একুশ শতকের সূচনালগ্ন।একুশে টিভি তখন উন্মুক্ত টেরিষ্টোরিয়াল টেলিভিশন কেন্দ্র হিসেবে সম্প্রচার শুরু করে। সেই সুবাদে গ্রামের মানুষের কাছে তখন বিটিভির পাশাপাশি একুশে টিভি দেখারও সুযোগ তৈরি হয়। একুশে টিভিতে কোন অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে একটা টোন দেয়; ওটা খুব দারুণ। এই টোনের রেশ কাটতে না কাটতে শুরু হতো অর্ণবের কণ্ঠে বন্ধন নাটকের থিম সং ‘ব্যস্ত শহরে, ঠাস বুনোটের ভিড়ে, আজো কিছু মানুষ, স্বপ্ন খুজে ফেরে’। বন্ধন নাটকের ‘বন্ধন’ শুধু নামে নয়, এই নাটক আমাদের বাড়িতে কয়েকটা পরিবারকে আবদ্ধ করতে পেরেছিল খুব মজবুত বন্ধনে। নাটক শুরু হওয়ার পাঁচ দশ মিনিট আগে থেকে সবাই এসে হাজির হতো সাকিল ভাইয়াদের ঘরে।পড়ার টেবিলে আমাদের মন বসত না। শুধু সময় গুনতাম কখন নয়টা বাজে। নয়টা বাজলে বইপত্র সব একদিকে রেখে দৌড়ে চলে যেতাম টিভির সামনে। এই যে না পড়ে টিভির সামনে এসে হাজির হতাম, এটার জন্য বাড়ির বড়রাও বকতো না। বন্ধন নাটক ছিলো সবার জন্য উন্মক্ত। এসময় পড়া-লেখা, খাওয়া-দাওয়া সহ অন্যসব কাজকর্মও বন্ধ থাকতো।
বাড়িতে তখন একটাই টিভি।সাকিল ভাইয়াদের ঘরে। সাদাকালো ১৪ ইঞ্চির টিভিটা চলতো এন্টেনার মাধ্যমে। বিশাল লম্বা বাঁশের মাথায় এন্টেনা জুড়ে দেয়া হত। বাঁশের অপর প্রান্ত মাটিতে পুঁতে রাখা হত। ভাবলেই অবাক লাগে, তখন এই এন্টেনা, সাদাকালো ১৪ ইঞ্চির টিভি আর বন্ধন নাটকের কি দারুণ ক্ষমতা ছিলো।নির্দিষ্ট সময়ে কিছু সংখ্যক মানুষকে চুম্বকের মতো এক জায়গায় এনে একত্র করতো। বজায় রাখত শক্তিশালী ঐক্য,সংহতি,ভ্রাতৃত্ববোধ ।
সময় বদলায়। দিন-মাস-বছর-যুগ সব স্মৃতি হয়ে রয়ে যায়। কতশত স্মৃতি জমা হয়। কিন্তু পারিবারের সবাই মিলে নাটক দেখার এমন স্মৃতি আর তৈরি হয়না। আমি প্রায় চেষ্টা করি হারিয়ে যাওয়া ঘটনাগুলোর পুনরাবর্তন করতে। কিন্ত তা কি আর সম্ভব! তারপরেও যতটুকু পারি চেষ্টা চালিয়ে যায়। এইতো সেদিন হঠাৎ ইচ্ছে হলো, পরিবারের সবাইকে একত্র করে নাটক দেখব। এখন বাংলা টিভি চ্যানেল গুলোর যে হাল অবস্থা, তাতে কোনভাবেই টিভিতে নাটক দেখা সম্ভব না। তাই আমি আমার ল্যাপটপে হুমায়ূন আহমেদের একটা নাটক চালু করে দিলাম। খেয়াল করে দেখলাম আম্মা,ভাবী,ছোটভাই সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে নাটকটা দেখছে। মনখারাপের মুহূর্তে মন থারাপ করে বসে থাকছে। হাসির দৃশ্যে সবাই হা হা করে হেসে উঠছে। এভাবে একদিন-দুইদিন-তিনদিন করে একটানা গত চৌদ্দ দিন ধরে আমার বাসায় হুমায়ূন আহমেদের নাটক চলছে। নাটক চলাকালীন সময়ে আম্মা জিঙ্গেস করছে, এটা হুমায়ূন আহমেদের বউ না? ছোট ভাই আম্মারে ভাবীরে একেক করে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, ‘এটা হুমায়ূন আহমেদের বউ। এটা হুমায়ূন আহমেদের মেয়ে শীলা আহমেদ। এটা বাকের ভাই। এটা হিমু। হিমু হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে। তার বিছানাও হলুদ রঙের থাকে।’
আমি পিছনে বসে হাসি। ভাইপুত আমার কোলে বসে কিছুক্ষণ নাটক দেখে।কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকায় থাকে। আমি ভাইপুতের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিই। ভাইপুতও আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসে। তারপর হাততালি দেয়। আমি ভাবি, কি সুখ আমার! কি আনন্দ আমার! এমন আনন্দ ছেড়ে, সুখ ছেড়ে, আমি কেমন করে দূরে যায়!
১৭টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
এখন প্রগতিশীল আর আধুনিক সব খাইছে, শিয়ালের মত কইরারে ভাই।
আকবর হোসেন রবিন
মাঝেমধ্যে মনের ভেতর এক ধরনের হাহাকার তৈরি হয়।
মোঃ মজিবর রহমান
হয়াই স্বাভাবিক ভাই।
কামাল উদ্দিন
হুমায়ুন আহমেদের লেখনি সত্যিই অনন্য, এমন লেখক শত বছরে একজন আসে কিনা সন্দেহ আছে
আকবর হোসেন রবিন
হ্যাঁ, ঠিক তাই।
মনির হোসেন মমি
স্যারের জন্মদিনে এমন লেখা সত্যিই প্রশংসনীয়। ওপারে ভাল থাকবেন জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলী জানাই।
আকবর হোসেন রবিন
ধন্যবাদ ভাই।
জিসান শা ইকরাম
অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন ভাই।
সাদাকালো এন্টিনা সংযোগের টিভির যুগে আমাদের পাড়ায় টিভি ছিল প্রথমে দুইটা। একটি ক্লাবে, অন্য একটি বাসায়। আমরা বিভিন্ন ভাল অনুষ্ঠান দেখতে যেতাম, রুম ভর্তি দর্শক।
এরপর আমরা টিভি কিনি, আমাদের বাসায়ও তেমন ভির থাকত। অন্য রকম এক আনন্দ ছিল তখন।
স্যারের নাটক দেখতাম পরিবারের সবাই মিলে, তখন প্রায় সব বাসায় সাদা কালো টিভি এসে গিয়েছে।
আকবর হোসেন রবিন
স্মৃতি গুলো মাঝেমধ্যে মনের ভেতর হাহাকার তৈরি করে।
সুরাইয়া পারভিন
দুর্ভাগ্য আমার
আমি স্যারের লেখা বই পড়িনি। এটা জানতে পেরে আমার বন্ধু অনেক গুলো বই পাঠিয়েছেন স্যারের লেখা। উনার সবগুলো বই পড়ার চেষ্টা করবো
আকবর হোসেন রবিন
বহুব্রীহি পড়িয়েন। এই বইটা দিয়ে আমি আমার অনেক স্টুডেন্টরে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করেছি।
নৃ মাসুদ রানা
হাসির দৃশ্যেে সবাই একসাথে হাসে…
আকবর হোসেন রবিন
ভাই, এই মুহূর্তটা অনেক দারুণ।
জাকিয়া জেসমিন যূথী
স্মৃতিকাতর লেখা।
আকবর হোসেন রবিন
হ্যাঁ। পরিবর্তন আমি খুব সহজে মেনে নিতে পারিনা।
এস.জেড বাবু
আমি পিছনে বসে হাসি। ভাইপুত আমার কোলে বসে কিছুক্ষণ নাটক দেখে।কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকায় থাকে। আমি ভাইপুতের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিই। ভাইপুতও আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসে।
ভাল লাগলো ভিষন।
একটা অভাব বোধ করছি তেমন মানুষটার।
আকবর হোসেন রবিন
ধন্যবাদ ভাই।