শেখ মুজিব, একটা ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি যার পুরোটা অনাবিষ্কৃত, ছেঁড়া খোঁড়া যেটুকু ইতিহাসের পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে সেটা অপ্রতুল এবং সমগ্র শেখ মুজিবের স্বরূপ নির্দেশ করে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মানেই শেখ মুজিবের ইতিহাস যা পরবর্তীতে পক্ষপাতিত্ব দোষে দুষ্ট এবং নিশ্চিতভাবেই বিকৃত। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অবশ্যম্ভাবী ভাবে শেখ মুজিবের পতন এই ইতিহাস বিকৃতিকে করেছে অগ্রসরমান এবং যার ফলশ্রুতিতে আজ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী স্বয়ং শেখ মুজিব একটি বিতর্কিত রাষ্ট্রনায়কের নাম।
কেন এমন হল?
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী ঘরানার নেতা কর্মী এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশের প্রবল স্বেচ্ছাচারিতা এবং লোলুপতার বলি হয় আওয়ামী সরকার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যে নেতাকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে রক্তের চালান এবং জোগান দিয়েছিল, তারা এবং তাদের দোসররাই মুক্তিযুদ্ধ পরবতি সময়ে সে চালানের শতভাগ লভ্যাংশ সহ সুদে আসলে উসুল করতে উদ্ধত হয়। সরকারী কর্মযজ্ঞে অনৈতিক অংশগ্রহন ব্যাপক লুটপাট আর স্বজনপ্রীতির কারনে আওয়ামীলীগ এবং মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করে তুলতে থাকে। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দেওয়ার কারনে এমনিতেই ইসলামপন্থী দলগুলো আওয়ামীলীগের প্রবল শত্রুতে পরিগণিত হয় আবার অন্যদিকে চিনপন্থি কমিউনিস্ট দলগুলোর কিয়দংশ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে কুটচালে লিপ্ত হয়। এই কারনে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে কিছু কমিউনিস্ট দল এবং ইসলামপন্থীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক মাত্রায় এসে দাঁড়ায়, এদের দেশ বিরোধী চক্রান্তের সাথে সাধারন শ্রেণীর আওয়ামী বিদ্বেষ চূড়ান্ত রুপ ধারন করে এবং ফলশ্রুতিতে আওয়ামী শাসন ব্যবস্থা এবং জনপ্রিয়তা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে।
আওয়ামী স্বেচ্চাচারিতার সাথে যুক্ত হয় চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ। যুদ্ধপীড়িত দেশে খাদ্য পণ্যের মারাত্মক সঙ্কট, আওয়ামী নেতা কর্মীদের ব্যবসা কুক্ষিগতকরণের মাধ্যমে কৃত্তিম সঙ্কট সৃষ্টি, ত্রাণের দ্রব্যসামগ্রী লুটপাটের সাথে দুর্ভিক্ষ যুক্ত হয়ে আওয়ামী শাসন ব্যবস্থার লেজেগোবরে অবস্থা সৃষ্টি হয়।১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ খাদ্য সংকট আরো বাড়িয়ে দেয় এবং অর্থনীতির প্রধান উত্স কৃষিকে ধ্বংশ করে ফেলে। এ কারনে কৃষি নির্ভর জনসাধারণের মধ্যে সরকার বিরোধী মনোভাব প্রকট হতে শুরু করে। যুদ্ধ পরবর্তী দেশ গঠনে সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দুষ্প্রাপ্যতা এবং মূল্যের অসামঞ্জস্যতা, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যর্থতার কারণে মুজিবকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। আন্তর্জাতিক মদদপুষ্ট বিরোধীপক্ষ এবং দেশের স্বঘোষিত সরকারবিরোধীরা মাথা চাঁড়া দিতে শুরু করলে শেখ মুজিব ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের প্রচেষ্টা চালান।
দেশ পুনর্গঠন, দলীয় নেতাকর্মীদের অবাধ স্বেচ্ছাচার প্রতিরোধ, বিরোধীপক্ষ দমন, রাষ্ট্রীয় কৃচ্ছতাসাধন এবং আওয়ামী শাসন স্থায়ীকরণ ইত্যাদি সুদরপ্রসারী রাজনৈতিক অভিপ্সা থেকে শেখ মুজিব একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের স্বপ্ন দেখেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি করে তাঁর রাজনৈতিক সমর্থকদের অনুমোদনের মাধ্যমে সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা শেখ মুজিবুর রহমান সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী উত্থাপন করেন। এই সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে প্রচলিত সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা বাতিল করে বাকশাল ব্যবস্থা চালু করা হয়। বাকশালের কারনে মৌলিক কিছু নাগরিক অধিকার রহিত হয়ে যায় তবে এই নীতির ফলে রাজনৈতিক অবস্থা কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং দুর্নীতি,কালোবাজারী এবং অবৈধ মজুদদারি অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যায়।
বাকশালি শাসন ব্যবস্থা একটি বিতর্কিত রাজনৈতিক সমস্যা। দূরদর্শী রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অদূরদর্শী দলীয় নেতাকর্মীদের ব্যক্তিগত লাভালাভের অস্ত্র হয়ে উঠলে বাকশাল বিতর্কিত হয়ে ওঠে এবং সাথে সাথেই বাকশালের প্রবর্তক শেখ মুজিবের ঘাড়ে এর সম্পূর্ণ দায় চেপে বসে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশবিশেষ হিসেবে যে বাকশালের শুরু, কয়েকদিন যেতে না যেতেই অর্থনীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় এর নেতিবাচক প্রভাব প্রকট আকারে পড়তে থাকে ফলে পুরো সরকার ব্যবস্থা’ই সারা বিশ্বে প্রশ্নের সম্মুখিন হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন বাকশাল গঠন করেন তখন সারা সারা বিশ্বে সমাজতন্ত্রের প্রভাব পূর্ণমাত্রায় বহাল ছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন বলিষ্ঠ সমর্থন দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে বড় মাপের ভূমিকা রাখে। তাছাড়া ষাটের দশকের পর আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোর সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি সংযুক্ত করা হয়। এছাড়া তখনকার গলাকাটা হঠকারী রাজনীতি সামাল দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি হিসেবে শোষিতের গণতন্ত্র কায়েম করার লক্ষ্যে বাকশাল গঠন করেছিলেন। ষাটের দশকের পর আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোর সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি সংযুক্ত করা হয়। একাত্তর পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেকে প্রত্যন্ত জনসাধারণ, কৃষক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত করে রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। বাকশাল দলটি বৃহৎ সমাজতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড গ্রহণ করে। সরকারি বাহিনীর সাথে সমর্থকদের নিয়ে গঠিত জাতীয় রক্ষী বাহিনীর সহায়তায় মুজিব বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করেন এবং সারাদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। বঙ্গ বন্ধু মনে করেছিলেন স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা জরুরী, বিশেষ করে অবাধ রাজনীতির সুযোগে যেন দেশে হানাহানির ঘটনা না ঘটে, সরকার যেন নিবিষ্টচিত্তে দেশের উন্নয়নে মননিবেশ করতে পারে ইত্যাদি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই বাকশাল গঠন করা হয়।
বঙ্গবন্ধু বাকশাল কায়েমই করতে পারেননি। বাকশাল গঠন করার পর পূর্ণ উদ্যমে তিনি কাজে হাত দেওয়ার পরপরই তাঁকে হত্যা করা হয়। বাকশালের কারনে শেখ মুজিবের অনেক সমালোচনা কিন্তু যে গাছ ফল দানের পূর্বেই কেটে ফেলা হয়েছে, সে গাছের ফল মিঠে না তেঁতো হতো সেটা মনগড়াভাবে আগেই বলা যৌক্তিক নয়।
আমরা এই ভুলটাই করি!
(কৃতজ্ঞতাঃ তথ্য উপাত্ত নানা ব্লগ এবং উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত এমনকি কোন কোন বাক্য বা বাক্যাংশ পাঠকের মন্তব্য থেকেও সরাসরি বা কিঞ্চিৎ সংযোজন বা পরিমার্জন করে সংযুক্ত করা হয়েছে।)
১৪টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
বাকশাল গঠন করার পর পূর্ণ উদ্যমে তিনি কাজে হাত দেওয়ার পরপরই তাঁকে হত্যা করা হয়। বাকশালের কারনে শেখ মুজিবের অনেক সমালোচনা কিন্তু যে গাছ ফল দানের পূর্বেই কেটে ফেলা হয়েছে, সে গাছের ফল মিঠে না তেঁতো হতো সেটা মনগড়াভাবে আগেই বলা যৌক্তিক নয়।-{@ (y) হুম সুন্দর উপাস্হাপন।
একজন আইজুদ্দিন
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আপনাদের উত্তরোত্তর সহযোগিতা আশা করি।
জিসান শা ইকরাম
বিশ্লেষন মোটামুটি সঠিক আছে। দুর্ভিক্ষের কারন হিসেবে আমেরিকার দেয়া খাদ্য সহায়তার জাহাজ ফিরিয়ে নেয়াটা যুক্ত করলে ভালো হতো।
প্রথম দিকে শুধু শেখ মুজিব লেখা একটু দৃষ্টি কটু।
যে শিশু কেবল জন্ম নিলো, হাটাই শুরু করেনি, তাঁকে নিয়ে যত সমালোচনা- এই হচ্ছে বাকশাল।
বঙ্গবন্ধুর এটা করা উচিৎ ছিলো স্বাধীনতার পর পরেই।
দেশ এখন অন্য উচ্চতায় চলে যেতো–
বাকশালের ক্ষুদ্রতম সংস্করন বাস্তবায়ন করে মালয়েশিয়া আজ সমৃদ্ধ দেশ।
লিখুন আরো ।
একজন আইজুদ্দিন
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
শেখ মুজিব নামটা বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠতে ইতিহাস সময় নিয়েছে প্রায় দুই দশক, আমি দুই বা তিন পর্বের বেশি সময় নেবো না।
আশা করি পরবর্তী পর্ব গুলোতে আপনার সুচিন্তিত মতামত পাব।
ভাল থাকুন।
নীলকন্ঠ জয়
মনির ভাইয়ের সাথে সহমত। লিখে যান। জানার ইচ্ছে আছে অনেক অজানা তথ্য।
একজন আইজুদ্দিন
ধন্যবাদ। লিখা চালিয়ে যাবার প্রত্যয় রইল।
আপনাদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নীলাঞ্জনা নীলা
একমত আপনার সাথে।
একজন আইজুদ্দিন
ধন্যবাদ।
খসড়া
যদি রাত পোহালেইশোনা যেত
————-
একজন আইজুদ্দিন
…… বঙ্গবন্ধু মরে নাই।
বঙ্গবন্ধু বাইচ্চা আছে, বাঙ্গালীরা বাইচ্চা নাই। ( ফকির লাল)
মিসু
অকৃতজ্ঞ বাঙ্গালী জাতির গুনটা ভালোভাবেই জানে জামাত শিবির এবং বাম দলগুলো। এর সুযোগ নিয়েছে তারা। আর হুজুগে বাঙ্গালী তা গ্রহন করেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা।
একজন আইজুদ্দিন
শ্রদ্ধা আপনার প্রতি’ও।
ধন্যবাদ।
শুন্য শুন্যালয়
বেশ ভালো বিশ্লেষণ। ঠিকই বলেছেন, বংগবন্ধু মরেনি, বাঙ্গালীরা মরে গেছে। পরের পর্বের জন্য অবশ্যই অপেক্ষা করে থাকলাম।
একজন আইজুদ্দিন
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
পরের পর্বগুলো খুব দ্রুতই পাবেন আশা করি।