বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সমবেত লাখো লাখো জনতার সামনে দ্ব্যর্থকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম , এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি আরও বলেন, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব- এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’
২৫শে মার্চের প্রথম প্রহরেই রাজধানী জুড়ে থমথমে পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। পাকিস্তানী বাহিনী তাদের ষড়যন্ত্রের শেষ ধাপে বাঙ্গালী নিধনের চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। গোয়েন্দা সংস্থার সার্বক্ষণিক খবরাখবরে বঙ্গবন্ধু উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন, কেউ কেউ তাকে পালাবার অনুরোধ করেন, কেউ কেউ আত্মগোপন করার পরামর্শ দেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার শিদ্ধান্তে অনড় থাকেন।
কোন কোন আওয়ামী বিরোধী ছিদ্রান্বেষী মহল বলে থাকেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বেচ্ছায় পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এটা নিছক একটা মিথ্যা প্রোপাগান্ডা বৈ অন্য কিছু নয়। বঙ্গবন্ধুর সারা রাজনৈতিক জীবনে একটিবারের জন্যও পিছুহটা’র ইতিহাস নাই। বরং যে কোন ধরনের ন্যায়সঙ্গত দাবী আদায়ে তিনিই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন। সে রাতে তিনি চাইলেই পালিয়ে যেতে পারতেন, সে ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের কপালে ইতিহাসের একটা কালো তিলক পড়ে যেত। এটা বোঝার মতো নির্বুদ্ধি তিনি ছিলেন না। তিনি ভেবেছিলেন, তাকে পেলেই হয়তো নিরীহ বাঙ্গালীর উপর পাকিস্তানী বাহিনী বর্বরতা চালাবে না। তিনি জানতেন, তাকে না পেলে পাকিস্তানী বাহিনী সারা ঢাকায় তল্লাশি চালাবে। বাড়ি বাড়িতে গিয়ে তাঁকে খোঁজা হবে এবং প্রত্যেকটি বাড়িতে অন্যায় অত্যাচার জুলুম নির্যাতন করা হবে। এটা তার নিজের মুখেই তিনি জানিয়েছেন “আমাকে না পেলে ওরা গোটা ঢাকা শহরের প্রতিটি বাড়িতে খুঁজবে। জ্বালিয়ে দেবে, নিরীহদের হত্যা করবে।’ তার এ বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায় ২৫শে মার্চের কাল রাতে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অপারেশনের দায়িত্বে থাকা জেনারেল টিক্কা খানের কাছ থেকে। ১৯৭৬ সালে মুসা সাদিককে দেয়া এক সাক্ষাতকারে টিক্কা বলেছিলেন :
I knew very well that a leader of his stature would never go away leaving behind his countrymen. I would have made a thorough search in every house and road in Dhaka to find out Sheikh Mujib. I had no intention to arrest leaders like Tajuddin and others. That is why they could leave Dhaka so easily.” Then Tikka Khan said more in a very firm voice, “in case we failed to arrest Sheik Mujib on that very night, my force would have inflicted a mortal blow at each home in Dhaka and elsewhere in Bangladesh. We probably would have killed crores of Bangalees in revenge on that night alone
বঙ্গবন্ধু জানতেন, তাঁকে যে কোন রকমভাবেই হোক গ্রেফতার করা হবেই। পালিয়ে গেলে কলঙ্ক এবং সেই সাথে সারা পূর্ব বাংলার সাধারন মানুষের উপর স্টিম রোলার চালানো ঠেকাতে তিনি গ্রেফতার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এটা আত্মসমর্পণ নয়, এটা তাঁর ব্যক্তিগত উপলব্ধি। নিজের দেশের মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে নিজে আত্মগোপন করলে সেটা শুধু তাঁর নয় সারা বাঙ্গালীর অগৌরবের বিষয় হত।
নিজের জীবন বিপন্ন করে, নিশ্চিত মৃত্যুর সম্ভাবনা জেনেও যিনি আত্মগোপনের মতো কাপুরুষের পথ বেছে নেন নি, তিনিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
২৫শে মার্চের কালরাতে অপারেশান সার্চ লাইটের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে “অপারেশান বিগ বার্ড” নামে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পক্ষে ব্রিগেডিয়ার (অব.) জহির আলম খান গ্রেফতারে নেতৃত্ব দেয়। ২৪ কিংবা ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে পূর্বেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল, তার এই অপারেশনে সহযোগী হিসেবে সাথে ছিল মেজর বিল্লাল, ক্যাপ্টেন সাঈদ ও ক্যাপ্টেন হুমায়ুন। আগের রাতে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ পায় ব্রিগেডিয়ার (অব.) জহির আলম খান। সকাল ১১টায় এই সাক্ষাতকারে চীফ অব জেনারেল স্টাফ তাকে নিশ্চিত করে ২৫ মার্চ রাতেই মুজিবকে গ্রেপ্তার করতে হবে। শর্ত ছিল, শেখ মুজিবকে জীবিত গ্রেফতার করতে হবে।
২৫শে মার্চ রাত এগারটার আগেই ধানমন্ডি-মোহম্মদপুর সংযোগ সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। এ কারণে গাড়ি করে এই পথে আসা অসম্ভব হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত একটি দল ব্রিগেডিয়ার (অব.) জহির আলম খানের নেতৃত্বে পায়ে হেটে ৩২ নম্বরে পৌঁচে যায়। ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের নির্দেশে একটি দল পাশের একটি বাসায় ঢুকে দেয়াল টপকে মুজিবের আঙ্গিনায় নামেন। এসময় গোলাগুলিতে একজন নিহত হয়। তল্লাশী চালানোর জন্য এরপর অন্য আরেকটি দল ঢুকে বাসার মধ্যে, এরপর সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠলো সার্চপার্টি। বঙ্গবন্ধু তখন একটি ঘরে দরজা আটকিয়ে ওয়ারল্যাস ট্রান্সমিশনে ব্যস্ত ছিলেন। সে দরজা ভাঙ্গার জন্য মেজর বিল্লালকে নির্দেশ দিয়ে নিচে নেমে আসে জহির আলম খান। ক্যাপ্টেন সাঈদের দল তখন পর্যন্ত এসে পৌছায় নাই।
নিচে নামার সময় একটা গুলির শব্দ হলো। এরপর গ্রেনেড বিস্ফোরন ও তার সাথে সাব-মেশিনগানের ব্রাশ। মেজর বিল্লালের লোকেরা যখন দরজা ভাঙার চেষ্টা করছিলো তখন কেউ একজন সেদিকে পিস্তলের গুলি ছোড়ে। বারান্দার যেদিক থেকে গুলি এসেছিলো সেদিকে গ্রেনেড ছোড়ে একজন সৈনিক, এরপর সাবমেশিনগান চালায়। গ্রেনেডের প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির আওয়াজে বন্ধ সে রুমের ভেতর থেকে চিৎকার করে সাড়া দেন শেখ মুজিব। বেরুনোর পর হাবিলদার মেজর খান ওয়াজির (পরে সুবেদার) তার গালে চড় মারেন।
উপরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আশ্বস্ত করে ব্রিগেডিয়ার (অব.) জহির আলম খান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হবে না বলে নিশ্চিত করে সে, তবে তাকে গ্রেফতারে সহযোগিতা করতে হবে বলে প্রতিশ্রুতি চায় সে। শেখ মুজিব তাঁর পরিবারের সাথে কথা বলে চুরুটের পাইপটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।
ইতিমধ্যে পাকিস্তানী সেনা সদরে রেডিও বার্তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে,“বিগবার্ড ইন কেইজ”।
(কৃতজ্ঞতাঃ তথ্য উপাত্ত নানা ব্লগ এবং উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত এমনকি কোন কোন বাক্য বা বাক্যাংশ পাঠকের মন্তব্য থেকেও সরাসরি বা কিঞ্চিৎ সংযোজন বা পরিমার্জন করে সংযুক্ত করা হয়েছে।)
৯টি মন্তব্য
পারভীন সুলতানা
আমিত তখন তারুণ্যে ডগবগ করছি । কখনো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আবার কখনো বাসায় ছুটে আসছি । কিন্তু ২২ তারিখে নেতারা বললেন, বাসায় ফিরে যেতে। মেয়েদের হোস্টেলে না থাকাই ভাল । ফিরে এলাম কিন্তু প্রতি মুহূর্তের খবর আদান প্রদান হত। আব্বা তখন প্রাদেশিক পরিষদ দপ্তরে সরকারি অফিসার। রোজ চখের সামনে দেখতেন, একদিকে গোল টেবিলে আলোচনার অভিনয়, অন্যদিকে সিভিল ড্রেসে প্রতিদিন পাকিস্তানী সৈন্যের আগমন। ২৫ তারিখ আমরা তিন্টার সময় খবর পেলাম আজ ক্রাক ডাউন হবার সম্ভাবনা প্রচুর । হলও তাই। বঙ্গবন্ধু ইচ্ছে করলে পুরো পরিবার নিয়ে পালাতে পারতেন । কিন্তু উনি সে ধাতেরই ছিলেন না । সাধারণ মানুষও জানত , পালিয়ে কই যাবে, দেশটাকেত মাথায় তুলে নিয়ে যেতে পারবে না।
দারুন লিখেছেন, লিখুন । আমাদের নতুন প্রজন্ম যত সহজ বাংলাদেশ পেয়েছে, এত সহজে আমরা স্বাধীনতা পাই নি।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আমাদের নতুন প্রজন্ম যত সহজ বাংলাদেশ পেয়েছে, এত সহজে আমরা স্বাধীনতা পাই নি। (y)
পারভীন সুলতানা
ধন্যবাদ।
একজন আইজুদ্দিন
আপনাদের চোখ দিয়ে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের আলো দেখুক, এই প্রত্যাশা করি।
পারভীন সুলতানা
সেই আলো দেখানো আমাদেরই গুরুদায়িত্ব , নয়ত ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
একজন আইজুদ্দিন
সেই দায় থেকেই এই ক্ষুদ্র প্রচেস্টা, আশা করি আপনাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাবো।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
“বঙ্গবন্ধুর সারা রাজনৈতিক জীবনে একটিবারের জন্যও পিছুহটা’র ইতিহাস নাই। বরং যে কোন ধরনের ন্যায়সঙ্গত দাবী আদায়ে তিনিই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন। সে রাতে তিনি চাইলেই পালিয়ে যেতে পারতেন, সে ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের কপালে ইতিহাসের একটা কালো তিলক পড়ে যেত। এটা বোঝার মতো নির্বুদ্ধি তিনি ছিলেন না।” (y)
প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েও কি তাঁকে তাঁর অবস্থান থেকে এতোটুকু সরাতে পেরেছে? ঘুরেফিরে ঠিকই তো স্বমহিমায় আবির্ভূত হয়েছেন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী হিসাবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন।
তবে হ্যাঁ, প্রজন্মকে যারা সর্বদাই বিভ্রান্তির বেড়াজালে ফেলে রাখতে চায়, তাদের অপতৎপরতাকে রুখে দিতে সর্বদা আমাদেরও সরব থাকতে হবে।
জিসান শা ইকরাম
অত্যন্ত ভাল ভাবে উপস্থাপন করেছেন
ধন্যবাদ আপনাকে।
শুভ কামনা।
একজন আইজুদ্দিন
আপনার জন্য’ও শুভ কামনা।