আষাঢ়ের দিন। ঝুম বৃষ্টিতেই দিনের শুরু ও শেষ হলো।
কাঁচঘেরা লাইব্রেরী রুমের সাথে লাগানো বারান্দাটা আমার খুব প্রিয়। রাতের নির্জনতার সাথে একাকার হয়ে মিশে যায়। ফাঁকা অনেকখনি যায়গার উপর সদ্য বেড়ে ওঠা আকাশমনি গাছগুলো তিনতলার এই বারান্দা পার করে ফেলেছে প্রায়। বারান্দার এক কোনে ছোট ছেলের দুই জোড়া পাখি। চমৎকার করে পাশাপাশি শুয়ে একে অপরের তরে প্রেম বিলাচ্ছে। অপরপ্রান্তে আমার প্রিয় চেয়ারটি। যার উপর কেটে গেছে আমার ঘুমহীন তন্দ্রাজড়ানো অনেকগুলো রাত।
এ বারান্দায় কৃত্রিম কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই। বই এর পাতা বুলোতে বুলোতে চোখ বিদ্রোহ করলে বসে যাই চেয়ারটাতে। কখনো এক মগ গরম কফি হাতে। আকাশমনি গাছের ফাঁক গলে দিনের আলোতে দেখা দূরের বাঁধাইকরা কবরগুলিকে তখন অনুভব করি। নিথর হয়ে ঘুমিয়ে আছে তারা তাদের স্থায়ী ঠিকানায় অনন্ততকাল ধরে হয়ত। তার উপর বেড়ে উঠেছে তিনটা কৃষ্ণচূড়া। গাছগুলো দেখে কবরগুলোর বয়স নির্ধারণ করা যায়। এ কৃষ্ণচূড়ায় ফুল ধরেছে। শায়িত এ মানুষটির মৃত্যুকালের সময় বাড়ে কিন্তু মৃতের বয়স বাড়ে না।
কতোশতো ভাবনাগুলো এসে আমায় ভিড় করে। কখনো চলে যাই অতীতে কখনো বা উদ্দেশ্যহীন ভবিষ্যতে। বর্তমান সময়টা কুমারী কোনো কিশোরী। ঠিক ঐ সদ্য ওঠা আধখানি চাঁদের মতো। অতীত তাই কালসিটে পড়া ঐ আমাবস্যার মতো। ভবিষ্যৎটা মনে হয় উদাসিন কোনো নারী।
এসব এলোমেলো কথার ডালা খুলে বসে আমার দ্বৈত সত্বা। বলি তাকে,” একটু চুপ করে বসে থাকো। কিছু ছবি মনের কোনায় ভাসতে দাও।”
কিছু ভালবাসা শ্রদ্ধার মানুষ সবার জীবনেই থাকে। তা যদি পরিবার অর্থাৎ রক্তের সম্পর্কের বাইরে হয় তবে তা মনের কোনায় আজীবন থাকে।
মাঝে মাঝেই সে মুখগুলো উঁকি মারে। গভীর বেদনার সাথে। আমার খুব প্রিয় এবং অনেক ভালবাসার মানুষ ছিলেন আমার টি এইচ এ আন্টি। আমি কখনো স্নেহ ভালবাসার সম্পর্কগুলোতে ধর্ম বিষয়টা মূল্য দেই নাই।
যাইহোক, আমাকে কেন যেন, খুবই ভালবাসতেন তিনি। তাঁর এক ছেলে এক মেয়ের মধ্যে আমিও যেন ছিলাম আর একটা মেয়ে। খুবই সৎ একজন ডাক্তার ছিলেন আমার বরেণ কাকু। তিনি ছিলেন আমাদের হসপিটালের টি এইচ এ। বরেন্দ্রনাথ মন্ডল। খুব শান্ত ধীর সৌখিন একজন মানুষ। আমাদের কোয়ার্টারের প্রতিটা কাকুর পিচ্চিরা ছিল আমার ভক্ত। বিশেষ করে ‘প্রজ্ঞা’ বরেণ কাকুর মেয়ে। আন্টি ওকে বকলেই জানলা দিয়ে আমাকে আপু আপু করে ডেকে উঠতো। গেলেই বলতো,” জানো আমিও যখন মা হব তখন আমিও এমন করে আমার বাবুকে মারব, তখন তুমি বুঝবে মজা।” আমি আন্টি হেসে উঠলে সে আরো রেগে যেতো। আজ প্রজ্ঞা বড় হয়েছে বিয়ে হয়েছে। অথচ আমার আন্টি চলে গেছে।
আমি যে কতো কিছু শিখেছি ঐ মানুষটির কাছ থেকে তার হিসেব মেলানো যাবে না। ঘর সাজানো থেকে শুরু করে সম্পর্কের মানে গুলো। তিনি একজন নিখুত মানুষ। কাকু যখনই বাইরে যেতো আন্টিকে না বলে কখনোই ঘর থেকে বের হতো না। এবং প্রতিবারই আন্টির উদ্দেশ্যে একটা প্রশ্ন, ” তোমার কিছু লাগবে।” কাকু কেমন আছে আন্টিকে ছাড়া, তা জানার আর আমার সাহস হয়নি।
আমার বিয়ে হলে যখন চলে আসলাম রাজশাহীতে। টি এন টিতে প্রায় মাঝে মাঝেই রিং করে কথা হতো। দুষ্টমীও করতো আমার সাথে বান্ধবীর মতো।
যখন আমি ঢাকা পোষ্টিং হয়ে গেলাম তার চার বছর পর আন্টিরাও চলে গেলেন ঢাকা। আমি শ্যামলীতে আন্টি কল্যাণপুরে। ভাল কিছু রান্না হলেই ফোন চলে আসতো,”কি করছিস মা? চলে আয়।” আমি চলে যেতাম। অনেক সময় সংসারের চাপে যাওয়া হতো না। তখন শশুর শাশুড়ী ননদ আমার কাছেই থাকতো। দুজনেই থাকতো অসুস্থ।
তারপর আমি চলে আসলাম পাবনা। একদিন শুনি আমার সেই প্রিয় মুখটি হারিয়ে গেলো। এ পৃথিবীর কোনো শক্তিই আর তাকে ধরে রাখতে পারলো না। আমি দেখতে পারিনি আর সে সুন্দর প্রিয় মুখটি।
কিছু মানুষকে কখনো বলা যায় না, যে ” তোমাকে আমি খুব ভালবাসি। কখনো একা খুব একা হলে তোমাকে ফিল করি। বড় ফিল করি। হঠাৎ না বলে চলে যাও।
ভাল থেকো অপারের দেশে।”
এসব এলোমেলো কথা কিন্তু মনের একদম গভীরের ভালবাসা শ্রদ্ধার কথা। যা কোনো কিছুর সাথেই মেলানো যায় না। যায় না পরিমাপ করা। চলে যায় সবাই। চলে যেতে হয়। কিন্তু অসময়ের চলে যাওয়া খুবই কষ্ট দেয়।
ভাল থাকুন সবাই। এই লেখাটা লিখেছিলাম তিন চারদিন আগে। অসুস্থ ছিলাম তখন।
১৫টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
ডায়েরি তো দেখছি ঠিক-ই আছে, তা পাতাটি যদি এমন একটু এলোমোলো হয়
তবে এমনটি কিন্তু মন্দ নয়।
কিছু সম্পর্ক আমরা আমাদের হৃদয়ের গভীরেই ধারণ করি। তা সে যেখানে যে দেশেই থাকুক।
মৌনতা রিতু
ডায়রীর পাতা সত্যিই এলোমেলো হয়ে যায় অনেক সময়।
এইসম্পর্কগুলো সত্যিই মানুষের ভিতরে মানুষের আন্তরিকতার শৃঙ্খলা ঠিক থাকে।
ধন্যবাদ।
জিসান শা ইকরাম
জীবনের দীর্ঘ পথ ভ্রমনে অজশ্র মানুষ সাথে থাকে, আশেপাশে থাকে। সামান্য কয়েকজন থাকেন মনের গহীনে শ্রদ্ধায় ভালবাসায় ঘুমিয়ে। মাঝে মাঝে জেগে ওঠেন তারা। আসলে তারা বেচেই থাকেন রিদ মাঝারে।
সবারই এমন একটি বারান্দার প্রয়োজন, যা একান্তই তার নিজস্ব।
ভাল লেগেছে খুব।
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ ভাইয়া। ভাল থাকবেন।শরীরের প্রতি যত্ন নিবেন।
মিষ্টি জিন
রক্তের সম্পক ছাডাও কিছু সম্পক আঁছে যা সব সম্পককে ছাডিয়ে যায়। যার/ যাদের স্হান একেবারে গহীনে।
আমার কাছে বারান্দা নিশ্বাস নেয়ার জায়গা। একান্ত আপন কিছু সমঁয় এই বারান্দয় কাটাতে আমার ভালো লাগে।
এলোমেলো নাম হলেও বেশ গোছানো তোর ডাইরির পাতা ভাল লেগেছে।
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ মিষ্টি আপু। ভালবাসা নিও। ভাল থেকো। -{@ (3
অপ্সরা
কিছু কিছু প্রিয়জনকে সবাই মিস করে! অনেক ভালো লাগা!
মৌনতা রিতু
আসলেই। অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকুন।
নীহারিকা
আপনার বারান্দাটার বর্ণনা পড়ে লোভ হচ্ছে এমন একটি বারান্দার। এমন একটি নিজের ভাবনার জায়গা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
আমার আব্বার সরকারি চাকরীজনিত কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় থেকেছি আমরা। আমি ভাগ্যান যে মিশুক হবার কারণ কোয়ার্টারের অনেক চাচা-চাচী আমাকে খুব ভালোবাসতেন। এমনকি ঈদে নিজের মেয়েদের সাথে আমার জামাও কিনতেন। ইন্টারমিডিয়েট যখন পড়ি তখনও এক এডিসি আংকেল উনার মেয়েদের সাথে আমার জামা কিনতেন। বাসার ফলবাগানের ফল খাবার জন্য লোক পাঠিয়ে বা নিজে এসে নিয়ে যেতেন। মেয়েদের সাথে বসিয়ে খাওয়াতেন। এত বহর পরে যখন সেসব ভাবি তখন নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় নিজেকে। মিস করি তাদের। মনে পড়ে উনাদের আন্তরিকতা যা আজকাল দেখা যায় না।
ভালো থাকুক সেসব ভালো মানুষেরা, ভালো থাকুক আপনার আন্টির আত্মা।
মৌনতা রিতু
আসলেই তাই হয়। অন্তত আমিও অনেক জামা পাইছি। এবার ঈদে পাশের ফ্লাটের সাকি সোনাও হঠাৎ করে একটা থ্রি পিস নিয়ে হাজির।
এমন সম্পর্কগুলো আছে বলেই পৃথিবীটা অনেক সুন্দর।
লেখা দিন তাড়াতাড়ি। ভাল থাকুন আপু। -{@ (3
মোঃ মজিবর রহমান
কিছু মানুষকে কখনো বলা যায় না, যে ” তোমাকে আমি খুব ভালবাসি আপু আপনার ভাবনা গুলি। বারান্দার কানীহি পাশে শায়িত মানুষ কবরে আপনাকে ভাবনায় আনে! এই এলমেল চিন্তা মানুষকে আরো অনেক দূর নিয়ে যাবে। ভাল থাকু ন।
মৌনতা রিতু
আসলেই খুব সুন্দর এই পরিবেশটা। মন অন্যরকম হয়ে যায়। ভালো থাকবেন ভাই। পাশে থাকবেন। শুভকামনা রইলো।
মোঃ মজিবর রহমান
আরো লিখুন সঙ্গে আছি।
ব্লগার সজীব
আপু আপনার এই লেখা পড়ে আমি যেন কোথায় হারিয়ে গেলাম। খুবই ভাল একটি লেখা।
মৌনতা রিতু
আসলে মাঝে মাঝে পরিবেশটা এমন হয়ে যায়। এই বারান্দাটায় আমি রাতে ছাড়া বসি না।
এই মানুষগুলো সব সময়ই মনের মধ্যে থাকে।
ভাল থাকুক সবাই।
ধন্যবাদ ভাই।