রিতুর এলোমেলো ডায়রীর পাতা।

রিতু জাহান ২৯ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:২৫:০০অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১৫ মন্তব্য

আষাঢ়ের দিন। ঝুম বৃষ্টিতেই দিনের শুরু ও শেষ হলো।
কাঁচঘেরা লাইব্রেরী রুমের সাথে লাগানো বারান্দাটা আমার খুব প্রিয়। রাতের নির্জনতার সাথে একাকার হয়ে মিশে যায়। ফাঁকা অনেকখনি যায়গার উপর সদ্য বেড়ে ওঠা আকাশমনি গাছগুলো তিনতলার এই বারান্দা পার করে ফেলেছে প্রায়। বারান্দার এক কোনে ছোট ছেলের দুই জোড়া পাখি। চমৎকার করে পাশাপাশি শুয়ে একে অপরের তরে প্রেম বিলাচ্ছে। অপরপ্রান্তে আমার প্রিয় চেয়ারটি। যার উপর কেটে গেছে আমার ঘুমহীন তন্দ্রাজড়ানো অনেকগুলো রাত।
এ বারান্দায় কৃত্রিম কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই। বই এর পাতা বুলোতে বুলোতে চোখ বিদ্রোহ করলে বসে যাই চেয়ারটাতে। কখনো এক মগ গরম কফি হাতে। আকাশমনি গাছের ফাঁক গলে দিনের আলোতে দেখা  দূরের বাঁধাইকরা কবরগুলিকে তখন অনুভব করি। নিথর হয়ে ঘুমিয়ে আছে তারা তাদের স্থায়ী ঠিকানায় অনন্ততকাল ধরে হয়ত। তার উপর বেড়ে উঠেছে তিনটা কৃষ্ণচূড়া। গাছগুলো দেখে কবরগুলোর বয়স নির্ধারণ করা যায়। এ কৃষ্ণচূড়ায় ফুল ধরেছে। শায়িত এ মানুষটির মৃত্যুকালের সময় বাড়ে কিন্তু মৃতের বয়স বাড়ে না।
কতোশতো ভাবনাগুলো এসে আমায় ভিড় করে। কখনো চলে যাই অতীতে কখনো বা উদ্দেশ্যহীন ভবিষ্যতে। বর্তমান সময়টা কুমারী কোনো কিশোরী। ঠিক ঐ সদ্য ওঠা আধখানি চাঁদের মতো। অতীত তাই কালসিটে পড়া ঐ আমাবস্যার মতো। ভবিষ্যৎটা মনে হয় উদাসিন কোনো নারী।
এসব এলোমেলো কথার ডালা খুলে বসে আমার দ্বৈত সত্বা। বলি তাকে,” একটু চুপ করে বসে থাকো। কিছু ছবি মনের কোনায় ভাসতে দাও।”
কিছু ভালবাসা শ্রদ্ধার মানুষ সবার জীবনেই থাকে। তা যদি পরিবার অর্থাৎ রক্তের সম্পর্কের বাইরে হয় তবে তা মনের কোনায় আজীবন থাকে।
মাঝে মাঝেই সে মুখগুলো উঁকি মারে। গভীর বেদনার সাথে। আমার খুব প্রিয় এবং অনেক ভালবাসার মানুষ ছিলেন আমার টি এইচ এ আন্টি। আমি কখনো স্নেহ ভালবাসার সম্পর্কগুলোতে ধর্ম বিষয়টা মূল্য দেই নাই।
যাইহোক, আমাকে কেন যেন, খুবই ভালবাসতেন তিনি। তাঁর এক ছেলে এক মেয়ের মধ্যে আমিও যেন ছিলাম আর একটা মেয়ে। খুবই সৎ একজন ডাক্তার ছিলেন আমার বরেণ কাকু। তিনি ছিলেন আমাদের হসপিটালের টি এইচ এ। বরেন্দ্রনাথ মন্ডল। খুব শান্ত ধীর সৌখিন একজন মানুষ। আমাদের কোয়ার্টারের প্রতিটা কাকুর পিচ্চিরা ছিল আমার ভক্ত। বিশেষ করে ‘প্রজ্ঞা’ বরেণ কাকুর মেয়ে। আন্টি ওকে বকলেই জানলা দিয়ে আমাকে আপু আপু করে ডেকে উঠতো। গেলেই বলতো,” জানো আমিও যখন মা হব তখন আমিও এমন করে আমার বাবুকে মারব, তখন তুমি বুঝবে মজা।” আমি আন্টি হেসে উঠলে সে আরো রেগে যেতো। আজ প্রজ্ঞা বড় হয়েছে বিয়ে হয়েছে। অথচ আমার আন্টি চলে গেছে।
আমি যে কতো কিছু শিখেছি ঐ মানুষটির কাছ থেকে তার হিসেব মেলানো যাবে না। ঘর সাজানো থেকে শুরু করে সম্পর্কের মানে গুলো। তিনি একজন নিখুত মানুষ। কাকু যখনই বাইরে যেতো আন্টিকে না বলে কখনোই ঘর থেকে বের হতো না। এবং প্রতিবারই আন্টির উদ্দেশ্যে একটা প্রশ্ন, ” তোমার কিছু লাগবে।” কাকু কেমন আছে আন্টিকে ছাড়া, তা জানার আর আমার সাহস হয়নি।
আমার বিয়ে হলে যখন চলে আসলাম রাজশাহীতে। টি এন টিতে প্রায় মাঝে মাঝেই রিং করে কথা হতো। দুষ্টমীও করতো আমার সাথে বান্ধবীর মতো।
যখন আমি ঢাকা পোষ্টিং হয়ে গেলাম তার চার বছর পর আন্টিরাও চলে গেলেন ঢাকা। আমি শ্যামলীতে আন্টি কল্যাণপুরে। ভাল কিছু রান্না হলেই ফোন চলে আসতো,”কি করছিস মা? চলে আয়।” আমি চলে যেতাম। অনেক সময় সংসারের চাপে যাওয়া হতো না। তখন শশুর শাশুড়ী ননদ আমার কাছেই থাকতো। দুজনেই থাকতো অসুস্থ।
তারপর আমি চলে আসলাম পাবনা। একদিন শুনি আমার সেই প্রিয় মুখটি হারিয়ে গেলো। এ পৃথিবীর কোনো শক্তিই আর তাকে ধরে রাখতে পারলো না। আমি দেখতে পারিনি আর সে সুন্দর প্রিয় মুখটি।
কিছু মানুষকে কখনো বলা যায় না, যে ” তোমাকে আমি খুব ভালবাসি। কখনো একা খুব একা হলে তোমাকে ফিল করি। বড় ফিল করি। হঠাৎ না বলে চলে যাও।
ভাল থেকো অপারের দেশে।”

এসব এলোমেলো কথা কিন্তু মনের একদম গভীরের ভালবাসা শ্রদ্ধার কথা। যা কোনো কিছুর সাথেই মেলানো যায় না। যায় না পরিমাপ করা। চলে যায় সবাই। চলে যেতে হয়। কিন্তু অসময়ের চলে যাওয়া খুবই কষ্ট দেয়।
ভাল থাকুন সবাই। এই লেখাটা লিখেছিলাম তিন চারদিন আগে। অসুস্থ ছিলাম তখন।

৪৮৮জন ৪৮৮জন
0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ