রহমান সাহেব

বায়রনিক শুভ্র ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, সোমবার, ১১:৫৪:৩০অপরাহ্ন বিবিধ ১৮ মন্তব্য

রহমান সাহেব কিছুতেই ক্লাসে মন দিতে পারছেন না । তিনি ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক, কবিতা পড়াতেই বেশি পছন্দ করেন । অথচ ওনাকে নিয়মিত নিতে হচ্ছে ইন্টার প্রথম বর্ষের ইংরেজি ২য় পত্রের ক্লাস । কিছু করার নেই, কারণ প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের নাতনী এই ক্লাসের ছাত্রী এবং প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের নির্দেশেই ওনাকে অনার্সের ক্লাস বাদ দিয়ে এখানে আসতে হয়েছে । শিক্ষকজীবনের শুরু থেকে তিনি ইন্টারের ছাত্র-ছাত্রীদের ঘৃণা করেন, না ভুল হল, এড়িয়ে চলেন । কারণ বয়ঃসন্ধির শেষ সময়ের ছেলে-মেয়েদের গতিবিধি উনি ধরতে পারেন না । নিজের কলেজ জীবনের কথা ভেবেও তিনি মাঝে মাঝে আঁতকে ওঠেন । তবে দীর্ঘ ১৮ বছরের শিক্ষক-জীবন ওনাকে শিখিয়েছে কিভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হয় । আর তাছাড়া রাশভারী শিক্ষক হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীরাও ওনাকে বেশ সমীহ করে চলে । তারপরও তিনি পড়াতে গিয়ে বার বার খেই হারিয়ে ফেলছেন । পিছনের ৪-৫ টা ছেলে বেশ গল্প করছে; সামনের বেঞ্চে বসা বোরখা পরা মেয়েটি বেঞ্চের নিচে মোবাইল টিপাটিপি করছে; আর ক্লাসশুদ্ধ সবার মনোযোগ অন্য দিকে । সব বুঝতে পারছেন, কিন্তু উনি ক্লাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না । এই সমস্যা নতুন নয় । গত ৭ দিন ধরেই ওনার এরকম হচ্ছে । অন্য ক্লাসগুলো যদিও বা চালিয়ে নিচ্ছেন কিন্তু এই ক্লাসে আসলেই ওনার বুকের মধ্যে ধুক পুক শুরু হয় । সদ্য জন্ম নেয়া বাছুর যেমন দাঁড়াতে শিখেই ছোটা ছুটি করে, আছাড় খায় আবার দৌঁড় শুরু করে, কোনদিকে যাবে বুঝতে পারে না, রহমান সাহেবের অবস্থাও একইরকম । ওনার এই সমস্যা সম্বন্ধে উনি সচেতন হলেও কারণটা ঠিক ধরতে পারছেন না । একটু ভুল হল, কারণ ধরতে পারলেও উনি কারণটাকে আমল দিচ্ছেন না । আর যেহেতু আমল দিচ্ছেন না, সেহেতু কারণটা দিন দিন ওনার মগজে স্থায়ী ভিটা বাধছে ।

আসলে কিভাবে আমল দেবেন ? ওনার বয়স এখন ৪৮ । দীর্ঘ ১৭ বছরের বিবাহিত জীবন ওনার । এবং স্ত্রী সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই আছেন । ওনার কলিগদের স্ত্রীদের মত ওনার স্ত্রী শাম্মি বুড়িয়ে যাননি । দুই সন্তানের জননী হওয়ার পরও শাম্মিকে সেক্সি বলা চলে । পুরোনো বন্ধুদের সাথে সস্ত্রীক দেখা হলে উনি একটু গর্ব করেই নিজের স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন এবং স্ত্রীকে যথেষ্ট ভালোও বাসেন । অথচ সেই রহমান সাহেবের চোখ আটকে যাচ্ছে কিনা ইন্টার পড়ুয়া একটি পুঁচকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে !!

মেয়েটি এই ক্লাসেরই ছাত্রী । খুব যে সুন্দরী তা নয় । কিন্তু লম্বা শ্যমলা শরীরের মেয়েটি যে যৌবনের অমৃতসুধা মজুদ করে রেখেছে তা দেখলেই বুঝা যায় । আর এটা ভাবতে গিয়েই একদিন ক্লাসের ফাঁকে মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকিয়ে ছিলেন । আর সেই থেকেই শুরু; যেখানেই যাচ্ছেন পুরোনো চাপা পড়া ফোঁড়ার মত গজিয়ে উঠছে মেয়েটির কথা । এমনকি গতরাতে স্ত্রী সঙ্গমের সময় তিনি মনে মনে মেয়েটিকে ভেবে মিলিত হয়েছেন । বিষয়টাকে উনি মনের মধ্যের দূষিত ফোঁড়া নাকি বর্ষাকালে হঠাৎ আবিষ্কৃত ঝর্নার সাথে তুলনা করবেন বুঝতে পারছেন না । একদিকে নিজের সামাজিক অবস্থান অন্যদিকে মনের সেই কিশোর বয়সের আবেগ, কোণটাকে গুরুত্ব দেবেন তা রহমান সাহেব বুঝতে পারছেন না ।

মেয়েটি কি কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে ? হতে পারে। মেয়েদের তৃতীয় নয়ন থাকে । পিছন থেকে কোন পুরুষ নিতম্বের দিকে তাকালেও নাকি মেয়েরা পিছনে না ফিরে বিষয়টা ধরতে পারে । তথ্যটা রহমান সাহেব পেয়েছিলেন ওনার স্কুল জীবনের প্রেমিকা রেহানার কাছ থেকে । মেয়েটির দিকে তাকালেই মেয়েটি মিষ্টি করে হাসছে । আর এই হাসির লোভেই বার বার রহমান সাহেবের চোখ আটকে যাচ্ছে মেয়েটির চোখে । মেয়েটির টানা কালো চোখে তিনি যৌনতার আমন্ত্রণ খুজে পাচ্ছেন । সেদিন সন্ধায় মেয়েটি রহমান সাহেবকে ফোন করেছিল । অনেক ছাত্র-ছাত্রীই ফোন করে । কিন্তু এই মেয়েটি কেন ফোন করল ? মেয়েটি তো ওনার কাছে প্রাইভেট পড়তে আসে না। বিশেষ কোন প্রয়োজনেও যে ফোন করেছে তা নয় । খসখসে গলায় বলেছে, “স্যার আমি মুক্তা, ক্লাসটেস্ট কি আগামীকাল নেবেন?” রহমান সাহেব বোঝেন মেয়েটির গলা হুমায়ূন আহমেদের নায়িকাদের মত রিনরিনে নয় । কোকিলকণ্ঠীর বদলে মেয়েটিকে বায়সকণ্ঠী বলাটাই যুক্তি সঙ্গত; অথচ এই স্বর গতকাল রাতে রহমান সাহেবের গায়ে আগুন জালিয়ে দিয়েছিল। বাচ্চারা যখন ডাইনিং রুমে খাওয়ায় ব্যাস্ত তখন তিনি তার উচ্চকিত যৌনাকাঙ্ক্ষা মিটিয়েছেন স্ত্রীকে দিয়ে । সিরিয়ালে আসক্ত স্ত্রীর চোখ নিজের দিকে ফেরাতে প্রায় ঝাপিয়েই পড়েছিলেন স্ত্রীর উপর । হকচকিয়ে গেলেও ওনার স্ত্রী ব্যাপারটাতে বেশ খুশিই হয়েছেন । সে জন্যেই সকাল রাতে কিছু অতিরিক্ত আদরও তিনি পেয়েছেন । কিন্তু এরকম কেন হচ্ছে ?
রহমান সাহেব সেক্স-স্টার্ভ নন । স্কুল জীবনে বাড়ির পাশের খালাতো বোনের মাধ্যমেই ওনার হাতেখড়ি হয়ে গিয়েছিল এক প্যাচ প্যাচে গরমের অমাবশ্যা রাতে । প্রথমে উনি বুঝতেই পারেননি কী ঘটে গেলো । কিন্তু সেদিনটার কথা মনে করে এখন ভরদুপুরে ক্লাসের মধ্যেও শরীরটা নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে । প্রথম অভিজ্ঞতা যে খুব রোম্যান্টিক ছিল তা নয়। গল্পের মত আকাশে জ্যোৎস্না ছিল না; মেঘের গুড় গুড় বা ঝড়ের বাতাসও ছিল না । বিছানার বদলে পেয়েছিলেন সবুজ ঘাস আর ধরা পড়ার ভয় তো ছিলই । এখনও ওনার মনে আছে ফর্সা মেয়েটা ওনার পিঠ নখের আঁচড়ে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল । কলেজ জীবন পার করে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন এমনকি বেকার জীবনেও কেউ না কেউ সম্পূর্ণ দেহ নিয়ে ওনার অপেক্ষা করেছে এবং উনিও সাধ্যমত প্রতিটা মেয়ের অপেক্ষার মুল্য সুদে-আসলে শোধ করেছেন । বিয়েটা ওনার পরিবারের পছন্দেই হয় । ওনার মেজ মামা এলাকার শ্রেষ্ঠ সুন্দরী ও শিক্ষিতা মেয়েকে ওনার হাতে তুলে দেন । যে কিনা এখন পর্যন্ত রহমান সাহেবেরই আছেন । অথচ এই পড়ন্ত যৌবনে কিনা একটি পুচকে মেয়ে ওনার সব কিছু লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে !!

বিয়ের আগেই উনি ঠিক করেছিলেন স্ত্রী ছাড়া আর কোন নারীকে স্পর্শ করবেন না । এই পর্যন্ত উনি ওনার কথা রেখেছেন । বিশেষ করে ছাত্রীদের উনি সন্তান-দৃষ্টিতেই দেখেছেন । কিন্তু এই শ্যামলা দির্ঘাঙ্গী মেয়েটার মধ্যে এমন কী জাদু আছে যে এত বছরের লালিত সংযম এক মুহূর্তে নালায় ভেসে গেলো !! আর এটাই ওনাকে ভাবাচ্ছে বেশি । যদিও উনি নিজের মধ্যে একটা যৌবন পোকার অস্তিত্ব টের পাচ্ছেন, বার বার অনুভব করছেন কিশোর বয়সের অনুভূতি । আর এগুলোই ওনাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটির শরীরে । বার বার চেষ্টা করছেন স্ত্রীর কথা ভাবতে, ওনার পুরানো প্রেমিকাদের কথা ভাবতে যাদের সবার চেহারাই ওনার মনে নেই । কিন্তু মাংসে লেগে থাকা বালির মত শত জল ঢালার পরও খচ খচ করে ভেসে উঠছে মেয়েটির মুখ । এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে ওনার ৪৫ মিনিটের ক্লাস কখন শেষ হল বুঝতেই পারলেন না । ক্লাস শেষে উনি যে আশংকা করছিলেন তাই ঘটে গেলো। আশংকা না বলে কামনা বললেই উপযুক্ত হয় । কিন্তু যেহেতু সমাজ আমাদের মুখোশ পরতে শেখায় তাই আমরা আশংকাই বলব । মেয়েটি ঠোঁটে সেই কামনার হাসি, চোখে সেই আদিম আহবান নিয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো । কণ্ঠে তুষারপাতের শীতলতা ঢেলে রহমান সাহেবকে বলল “স্যার, একটু কথা বলব।“ শীতল খসখসে কণ্ঠ সত্বেও রহমান সাহেবের শরীরে যেন শুকনো চরের মাতাল হাওয়া বইয়ে দিল । তিনি একটু থতমত খেয়ে গেলেন। হঠাৎ মনে হল উনি কোন কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। প্রথম প্রেমিকাকে প্রপোজ করার সময় কিশোর বালকদের যে অবস্থা হয়, ওনার সেরকম অনুভূতি হতে লাগল । অনেক কষ্ট মাঠের দিকে চোখ দিয়ে উনি বললেন “বল” । করাতের খসখস মিশিয়ে মেয়েটি ওনাকে জানাল যে, সে ‘রাইট ফর্ম অব ভার্বস’ এর কিছুই বুঝতে পারছে না তাই রহমান সাহেবের কাছে নিরবিলিতে একটু পড়তে চায় । আর যেহেতু সে মেসে থাকে তাই স্যার তাকে যখন যেখানে বলবে সে তখনই সময় বের করতে পারবে ।

রহমান সাহেব জবাব দেয়ার বদলে মেয়েটির দিকে তাকালেন । সব ছাত্র-ছাত্রী চলে গিয়েছে । আশেপাশে দুপুরের খর রোদ ছাড়া কিছুই নেই । গাছের নিচে আড্ডা দিতে আসা ছাত্র নামের ছত্রাকগুলোও উধাও । কিন্তু থাকলেও কোন কিছুর অস্তিত্ব তিনি অনুভব করতে পারতেন না । শুধু মনের মধ্যে এক্কা দোক্কা খেলে যাচ্ছিল “নিরিবিলি” “যে কোন সময়” “যে কোন জায়গায়” “একা” এই শব্দগুলো । এই ফাঁকে ওনার মনে পড়ে গেলো আগামীকাল শুক্রবার ওনার স্ত্রী বাচ্চাদের নিয়ে তার খালার বাড়িতে যাবে । এটা ভেবেই উনি উত্তেজিত হয়ে মহাভারতের খান্ডব দাহন অনুভব করলেন । নিরবতা শুষে নিয়ে মেয়েটি আবার বলল “স্যার, আমি কবে আসব?” ঠোঁটে চোখে আবার সেই শত বছরের পুরোনো শীতল হুইস্কির মাদকতা, আহবান । রহমান সাহেব এখন কী করবেন ? সমাজের বানানো পাথুরে পাহাড়ের চূড়া আঁকড়ে বসে থাকবেন ? নাকি নেমে যাবেন ফুল প্রজাপতিতে ঘেরা সবুজ উজ্জ্বল উপত্যকায় ?

৪২৩জন ৪২৩জন
0 Shares

১৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ