মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-২৩)

শামীম চৌধুরী ৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার, ০৫:৪৬:১৩অপরাহ্ন ভ্রমণ ২৪ মন্তব্য

আগের পর্বের লিঙ্ক- মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-২২)

পর্ব-২৩

আমরা দ্রুত ৫ নাম্বার জোনে যাত্রা করিলাম। সময় হাতে একেবারেই নেই। সূর্য্য অস্ত যাবার মাত্র দেড় ঘন্টা বাকি। আমাদের সবার ভিতর এই সময়ে নতুন প্রজাতির কিছু পাওয়ার লোভটা কাজ করছিলো

৫ নাম্বারে পৌছার আগে মূল সড়কের ধারে ওক গাছে কিছু খোড়লে পেঁচার দেখা পেলাম। সচারচর এক সঙ্গে এতগুলি পেঁচা দেখা যায় না। কারন এরা নিশাচর প্রাণী। রাতের আঁধারে শিকার ধরে খায়। দিনে কোন গাছের কোটরে ঘুমায়। তাও বিচ্ছিন্ন ভাবে। সূর্য্যের আলো এদের অপছন্দনীয়। দিনের বেলায় কোন প্রানী নজরে আসলে গোলাকার হলুদ চোখে বড় বড় করে তাকায়। চাহুনীতে মনে হবে শত্রুকে ঘায়েল করবে। প্রতিটি পাখির নিজস্ব স্বভাব ও বিচিত্র চরিত্র থাকে। কারো সঙ্গে কারো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। বিধাতা এমন করেই প্রানীদের সৃষ্টি করেছেন। আমাদের মাঝেও তাই।

সময় বিকাল ৫:৩০মিনিট। আমরা জোনের ভিতর। দিনের শেষ বেলার আহারের জন্য জলজ পাখিগুলি খাবারের সন্ধানে ব্যাস্ত। তেমন কিছু নজরে পড়লো না। পায়ে হেঁটে বেশ কিছুটা পথ সামনে গেলাম। হঠাৎ দেখলাম কয়েকশত Bar-headed Goose বা ডোরা-মাথা রাজহাঁস মাঠে কচি ঘাষ খাচ্ছে। এত বড় রাজহাঁসের ঝাঁক আগে কোথাও নজরে পড়েনি। কচি ধান গাছ বা কচি ঘাস এই জলজ পাখির প্রিয় খাবার। গোঁৎ…গোঁৎ…গোঁৎ আওয়াজে চারিদিক ভারি করে তুলেছে। পাঠক বন্ধুরা বুঝতেই পারছেন,শত শত রাজহাঁসের ডাকে পুরো এলাকা জুড়ে ভারী আওয়াজ হবারই কথা।আমরা সবাই রাজহাঁসের ছবি তুলছি। পাঠক বন্ধুদের দেখার জন্য ডোরা-মাথা রাজহাঁসের ছবি দিলাম।

Bar-headed Goose বা ডোরা-মাথা রাজহাঁস।

 

হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, বনের পশ্চিম প্রান্তে বেশ কয়েকটা চিত্রা হরিন দৌঁড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘন বনের ভিতর ঢুকছে। সাধারনতঃ বাঘ বা চিতার আক্রমন থেকে বাঁচার জন্য হরিন এভাবে দৌঁড়ায়। কিন্তু এই বনে তো বাঘ নেই! তা’হলে হরিনের দৌড়ে পালাবার কারন কি? মনের ভিতর কৌতুহুল জাগলো। চিন্তায় পড়ে গেলাম। হরিনের এমন দৃশ্য সুন্দরবন বা বাঘ অধ্যুষিত এলাকা ছাড়া আর কোথাও দেখিনি। সবাইকে নিয়ে মাঠের পাশে মাটির রাস্তায় বসে পড়লাম। ব্যাপারটা বুঝার জন্য তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখলাম। এমন সময় দেখলাম ৮/১০ পন্ডিত মশাই (খেঁকশিয়াল) একটি হরিনের বাচ্চার পিছনে ছুঁটছে। শিয়াল যে হরিনকে তাড়া করে এই প্রথম দেখলাম। হাসি পেলো এই ভেবে যে, বিপদে হাতি খাঁড়িতে পড়লে চামচিকাও ঠোঁকর মারে। তবে পন্ডিত মশাইদের স্বপ্ন, স্বপ্নই রয়ে গেল। হরিন শাবক তার দলের সহযোগিতায় নিরাপদে বনের ভিতর ঢুকে পড়লো। মনে একটা আফসোস রয়ে গেল যে,হরিনের পিছু শিয়ালের দৌড় প্রতিযোগিতার ছবি তুলতে না পারায়।

মাঠ ছেড়ে আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হলাম। হাঁটার পথে হাতের বাঁ দিকে এক ঝাঁক Painted stork বা রঙ্গিলা বক উড়ে এসে জলাশয়ে বসলো। এদের চঞ্চলতা দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না,এরা শেষ বেলার খাবার খেতে বসেছে। Painted stork বা রঙ্গিলা বক আমাদের দেশে বহুবার তুলেছি। তবে এত কাছ থেকে কখনই দেখা হয়নি। পাখিগুলিকে এত কাছে পাওয়ায় আনন্দে মনটা ভরে গেল। সারাদিনের হাড়-ভাঙ্গা খাঁটুনির অবসাদ মুহুর্তেই মিশে গেল। অনেকটাই উত্তেজিত হয়ে গেলাম।

Painted stork বা রঙ্গিলা বক রাজশাহীর পদ্মার চরে পরিযায়ী হয়ে আসে। তাও ভারত থেকে। এরা উত্তর আমেরিকার পাখি। ভারতের ঝাড়খন্ড,উত্তরখান্ড,ভরতপুর ও আসামের কাজিডাঙ্গা বনে এরা মূলতঃ পরিযায়ী হয়ে আবাসস্থল গড়ে। সেখানে এদের খাবারের অভাব নেই। দলে বেশী হয়ে গেলে খাবার সংকটে মাঝে মাঝে এরা খাবারের খোঁজে অন্যত্র চলে যায়। খাবার শেষে আবার ফিরে আসে।

Painted stork বা রঙ্গিলা বক।

আমাদের দেশে যে রঙ্গিলা বক দেখা যায় এরা মূলতঃ আসাম থেকে আসে। সারাদিন খাবার খেয়ে আবার দলে ফিরে যায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও পদ্মার চরে ৫/৬টি পাখির দেখা পাওয়া যায়। খাবার খেয়ে চরের বালুতে বিশ্রম করে। আমরা যখন ছবি তুলতে যাই তখন অনেক দূরে থাকায় কাছ থেকে ছবি নেয়ার সুযোগ পাই না। তাছাড়া এই জাতীয় পাখিগুলি উচ্চতায় বড় হওয়ায় সহজেই অন্য প্রানীদের দেখতে পায়। দূর থেকে আই কন্টাক্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উড়ে যায়। তবে উড়ন্ত ছবি ভাল পাওয়া যায়। আমি দেশে যতবার ছবি তুলেছি সব দূর থেকে। যার জন্য মনে একটা আফসোস সবসময় থাকতো।

Painted stork বা রঙ্গিলা বক। ছবিটি রাজশাহী থেকে তোলা।

দলের সবাইকে বললাম, ভবিষ্যতে Painted stork বা রঙ্গিলা বক এত কাছ থেকে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। তাই যার যার মতন করে ছবি তুলতে। ফ্রেমে বন্দী করতে পারলে সবাই ফুলফ্রেম ছবি পাবে। ৬জন ফটোগ্রাফারের ক্যামেরায় শাটারের শব্দ যেন মেশিন গানের গুলির মতন ছিলো। আমরা সবাই জলজ বকটির ছবি তুলে মহা আনন্দে স্থান ত্যাগ করলাম।
আমার তোলা পাখিটির ছবি ও পরিচিতি পাঠক বন্ধুদের কাছে উপস্থাপন করলাম।

Painted stork বা ‘সোনাজঙ্গা/রঙ্গিলা বক’ Mycteria গোত্রের ৯৩সেঃমিঃ দৈর্ঘ্যের বড় আকারের একটি জলচর পাখি। ইহার ওজন প্রায় ৩০০০ গ্রাম বা ৩ কেজি। দেহ সাদা ও ঠোঁট কমলা-হলুদ বর্ণের। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির মুখ কমলা-হলুদ ও দেহের চামড় প্রজননকালে লাল হয়। ঘাড় ও দেহের পিছনের অংশ সাদা। বুকে আড়া-আড়ি কালো ডোরা থাকে। ডানার কালো পালকে সাদা ডোরা দেখা যায়। ঠোঁট নীচের দিকে একটু বাঁকানো। পা ও পায়ের পাতা বাদামী থেকে প্রায় লাল হয়। পুরুষ ও মেয়ে পাখির চেহেরা অভিন্ন।

‘রঙ্গিলা বক’ নদীর পাড়, জলমগ্ন মাঠ, জোয়ার-ভাটার কাদাচর ও লবনাক্ত জমিতে বিচরন করে। সচারচর জোড়ায় বা ছোট ছোট দলে থাকতে দেখা যায়। অগভীর পানিতে হেঁটে হেঁটে বাঁকানো ঠোঁট কাদায় ঢুকিয়ে এরা খাবার খায়। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে মাছ, ব্যাঙ, চিংড়ী জাতীয় অমেরুদন্ডী প্রাণী ও জলজ পোকা।
নদীর ধারে প্রায়ই এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। প্রজননকাল ছাড়া এরা নীরব থাকে। কিন্তু প্রজননের সময়ে নীচু স্বরে গোঙানোর মত শব্দ করে ডাকে। জুলাই থেকে অক্টোবর মাস এদের প্রজননকালে। প্রজননকালে এরা নিজ দেশে পানিতে দাড়ানো গাছে ডালপালা, পাতা ও খড় দিয়ে মাচার মতন করে বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় ২-৪টি ডিম পাড়ে। নিজেরাই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুঁটায়। প্রায় ২৬-২৮ দিনে বাচ্চারা বাসা ছাড়ে।

‘সোনাজঙ্গা/রঙ্গিলা বক’ বাংলাদেশের অনিয়মিত পরিযায়ী পাখি। চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগের বড় বড় নদী, জলাশয় ও উপকূলে এদের দেখা যায়। ইহা ছাড়াও ভারত, পাাকিস্তান, নেপাল, চীন, থাইল্যান্ড সহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এদের বিচরন রয়েছে।

Painted stork বা রঙ্গিলা বক।

বাংলা নামঃ সোনাজঙ্গা/রঙ্গিলা বক
ইংরেজী নামঃ Painted stork
বৈজ্ঞানিক নামঃ Mycteria leucocephala.(Pennant 1769)
(চলব)

১০৪৯জন ৯১৫জন
0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ