নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্তিক প্রমাণের সাহায্যে সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টাদের সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করা হয়েছে। তাত্ত্বিকেরা চারটি মানব গোষ্ঠীর পরিচয় পেয়েছে মহেন্জোদারো ও হরপ্পার নরকঙ্কাল থেকে। যেমনঃ প্রোটো, অষ্ট্রালয়েড, ভূমধ্যসাগরীয়, আলপাইন ও মঙ্গোলীয়। তবে কোন গোষ্ঠী এই সভ্যতা সৃষ্টি করেছিল বলা মুশকিল। প্রত্নতাত্তিক প্রমাণ অর্থাৎ মনুষ্যাকৃতির পুতুলগুলোর গঠন পরীক্ষা করে মনে করা হয় এখানে অনেক জাতিই বাস করতো। সিন্ধু অধিবাসীরা নদীতে বাঁধ দিয়ে কৃষিকাজ করত।
আমরা ইতিহাস পড়ে দেখেছি অনেক সভ্যতার উত্থান ও পতন। সিন্ধু সভ্যতারও পতন ঘটে। এই সভ্যতার পতনের প্রধান একটি কারণ দেখা যায় তার চার পাশের নদী। তারা তাদের নগরগুলো সংস্কার জানতো না। প্রত্নতত্ত থেকে দেখা গেছে যে, এই নগরগুলো ছিল কিছুটা উঁচু ঠিকই কিন্তু পরবর্তীতে তারা বড় বড় ঘরের উপরে পোড়ামাটি দিয়ে আরো ঘর তৈরী করেছে। এবং এক ঘরের মাঝে দেয়াল দিয়ে আরো ছোট ছোট ঘর তৈরী করেছে। এতে তাদের বাসস্থানের অনেক পরিবর্তন আসার পাশাপাশি তা ভঙ্গুর অর্থাৎ দুর্বল হয়েছে। অন্যদিকে আরো একটি কারন হিসেবে দেখা যায় যে তারা তাদের ঘর তৈরী করতে পোড়ামাটির ব্যবহারের ফলে তারা তাদের এলাকার বনের পর বন উজাড় করেছে এতে বৃষ্টিপাত কম হওয়াতে বাতাসে লবনের পরিমান বেড়ে গিয়ে তাদের বাসস্থানেরও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং মরুভূমি জেগে ওঠে। এতে কৃষি ব্যবস্থাও ধ্বংস হয়ে যায়। তাছাড়া সিন্ধু নদের জল বাঁধ দ্বারা ধরে রেখে চাষ আবাদ করতো কিন্তু পরবর্তীকালে তা আর সংস্কার করেনি। অনেকের মতে এতে সিন্ধু নদীর দিক পরিবর্তন হয়ে মহেন্জোদারো থেকে নদীপথে বানিজ্য নষ্ট হয়। আর মহেন্জোদারো ছিল বাণিজ্যকেন্দ্রিক নগর। অনেকের মতে ভূমিকম্পের ফলেও এ নগর ধ্বংস হতে পারে বলে মনে করা হয়। তবে এই ভূমিকম্পের কথা প্রমাণ হিসেবে দুর্বলই মনে করা হয়। বন্যাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এখানে।
তবে এক জায়গায় মার্টিমার হুইলার প্রভৃতি পন্ডিত মনে করেন যে, বহিরাগত আর্য জাতীর আক্রমণে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কারণ হিসেবে মহেন্জোদারোতে কূপের ধারে পড়ে থাকা মনুষ্য কঙ্কাল গুলির খুলিতে ও হাড়ে ধারালো অস্ত্রের দ্বারা আঘাতের চিহ্ন এবং মৃতদেহের কঙ্কাল গুলিকে যত্রতত্র ভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এতে ইঙ্গিত করা হয় যে হঠাৎ আক্রমণের ফলে এই সকল নগরবাসী নিহত হয়। অনুমান করা হয় কোনো বহিরাগত জাতিই এই আক্রমন চালায়। এরা আর্য জাতিই বলে মনে করা হয়। আর্যদের হাতে ছিল লোহার অস্ত্র এবং যুদ্ধে তারা ঘোড়া বা রথ ব্যবহার করতো। সিন্ধু অধিবাসীরা তামার অস্ত্র দিয়ে তাদের আক্রমণ ঠেকাতে পারেনি। এজন্য সিন্ধু অধিবাসীরা সহজে পরাস্ত হয়। ঋকবেদে দেখা যায়, আর্যরা এই নগর ব্যবস্থা পছন্দ করতো না। তারা ছিল গ্রামীন জীবনে অভ্যস্ত, পশুপালন ছিল তাদের আদি জীবিকা। এই কারণে তারা এই সভ্যতা ধ্বংস করে ফেলে। ঋকবেদে আর্যরা তাদের দেবতা ইন্দ্রকে”পুরন্দর” বা পুরের ধ্বংসকারী বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পুর বলতে সিন্ধু নগর বুঝায় বলে হুইলার(পন্ডিত ব্যাক্তি) মনে করেন। তার মতে আর্য দেবতা ইন্দ্রের অপর নাম হলো পুরন্দর। সিন্ধু অঞ্চলের নগর বা পুরগুলি ধ্বংস করার ফলে হৃষ্ট আর্যরা তাদের দেবতার এই নাম দেয়।

ঋকবেদে কিছু তথ্য থেকে আর্যদের ভারতে বসতি সম্পর্কে জানা যায়। আর্যরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে পর্যায়ক্রমে ভারতে প্রবেশ করে। রোমিলা থাপার বলেছেন যে, ঋকবেদের যুগে দিল্লি অঞ্চল পর্যন্ত আর্য বসতি বিস্তার লাভ করে। ঋকবেদের পরবর্তী বৈদক যুগে আর্যতা গঙ্গা পার হয়ে আরও পূর্ব দিকে বসতি বিস্তার করে। এই বৈদিক যুগে এসে তারা পশুপালন ছেড়ে অন্যান্য জীবিকায় দক্ষতা লাভ করে। পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যরা পান্জাব থেকে সরে এসে মধ্যদেশ অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা উপত্যাকায় চলে আসে। কারণ, আর্যদের লোকসংখ্যা বাড়ার ফলে পান্জাবে গোচারণ ভূমি, বনজ সম্পদ, কৃষিক্ষেত্রের অভাব দেখা দেয়। তাছাড়া রাভি নদীর জলের ভাগ নিয়ে আর্যগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঝগড়া বিবাদ দেখা দেয়। ঋকবেদে যে দশ রাজার কথা উল্লেখ আছে ধারণা করা হয় এটা তারই কথা। গঙ্গা যমুনার উর্বর জমি আর্যদের এই দিকে আকর্ষণ করে।এরা পূর্ব ভারতের জঙ্গলগুলি আগুনে পুড়িয়ে বসতি স্থাপন করে। পূর্ব ভারতের ব্যাঘ্র-সঙ্কুল বঙ্গদেশে আর্য বসতি বিস্তারে কিছুটা বিলম্ব ঘটে। পুণ্ড্র দেশ বা উত্তর বাংলাকে দস্যু বা অনার্যদের আবাসস্থল বলে উল্লেখ করা হয়। মহাভারতের বন পর্বে উত্তর বাংলার করতোয়াকে একটি পবিত্র নদী বলা হয়েছে। ভারতের দক্ষিণে আর্য সভ্যতা খুব একটা বেশি প্রাধান্য পায় নাই।

ঋকবেদের যুগে আর্যদের রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল প্রধানতঃ উপজাতি(5Tribal) কেন্দ্রিক। ঋকবেদের যুগে আর্যরা ভরত, যদু, সঞ্জয়, অনু, পুরু, দ্রুহুৎ, তুর্বস প্রভৃতি উপজাতিতে বিভক্ত ছিল। পিতামাতা, পিতামহ ও পরিবারের অন্যান্য আত্নীয়দের নিয়ে পরিবার গঠিত হয়। রক্তের সম্পর্ক দ্বারা পরিবারের বন্ধন স্থির করা হয়। পরিবারের প্রধানকে কুলপতি বা কুলপা বলা হতো। ইনিই হতেন সে পরিবারের শাসনকর্তা। কতকগুলো পরিবার রক্তের সম্পর্কে যুক্ত হলে গোষ্ঠী বা উপজাতি গঠিত হতো। কয়েকটি পরিবার নিয়ে গোষ্ঠী গঠিত হতো। কয়েকটি গোষ্ঠী নিয়ে গ্রাম এবং কয়েকটি গ্রাম নিয়ে বিশ বা জন গঠিত হতো এবং কয়েকটি জন নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হতো। গ্রাম প্রধান গ্রামের শাসন করত। বিশপতি বিশ এর এবং গোপ জন এর শাসন করত। রাজ্যকে শাসন করতে এভাবে ছোট ছোট ভাগে শাসন কাজ ভাগ করা হতো।
ঋকবেদের যুগে এই গোষ্ঠীর মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ বিগ্রহ চলত। এই যুদ্ধের কারন ছিল কৃষি ও পশুচারণ ভূমির অধিকার নিয়ে। ভারতের আদি অধিবাসী অনার্য বা দ্রাবিড়দের সঙ্গে আর্যগোষ্ঠীগুলোর যুদ্ধ বিগ্রহ চলত। ঋকবেদে দশ রাজার যুদ্ধের উল্লেখ আছে। এতেই প্রমাণ হয় আর্যরা আদপেই শান্তি প্রিয় ছিল না। দশ রাজার যুদ্ধ থেকে জানা যায় যে, রাজা দিবোদাসের পুত্র রাজা সুদাস ছিলেন ‘ভরত’ বা ভারত গোষ্ঠীর রাজা। তার রাজ্য ছিল পশ্চিম পান্জাব ও দিল্লি অঞ্চলে। তার পুরোহিত ছিলেন বিশ্বামিত্র। এখানে বলে রাখি আগে পুরোহিত ছিল কোনো রাজমহলের একজন খাস লোক। তিনি ছিলেন রাজার ডান হাত। তার খুব প্রভাব থাকতো রাজ্যের যে কোনো সিদ্ধান্তে। কোনো এক কারনে ভরত গোষ্ঠীর রাজা সুদাস তার পুরোহিতকে বাদ দিয়ে তার স্থলে বলিষ্ঠকে প্রধান পুরোহিত নিয়োগ করে। এতে সে ক্ষুদ্ধ হয়ে অন্যান্য দশ রাজার জোট গড়ে ভরতের রাজা সুদাসের উপর আক্রমণ করে। বহু বাধা বিপত্তির পর ভরত গোষ্ঠী জয়লাভ করে। দশ রাজার এই যুদ্ধে ভরত গোষ্ঠীর এই জয়লাভ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই গোষ্ঠী আর্য সভ্যতার প্রধান স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায়। ধারনা করা হয় ভরত গোষ্ঠীর এই নাম থেকেই এই দেশের নাম হয় ভারতবর্ষ।

ভারতবর্ষ ইতিহাসের টুকরো কথনঃ আর্যজাতি পর্ব-২

তথ্যসূত্র ‘দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া। জওহরলাল নেহরু, পৃথিবীর ইতিহাস, ভারত ইতিহাস পরিক্রমা লিখেছেন ড. শ্রী প্রভাতাংশু মাইতি

১২৪০জন ১২৪০জন
0 Shares

১৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ