দুই মাসের গ্রীষ্মের ছুটিতে নিউইয়র্ক থেকে দেশে গিয়েছিলাম সপরিবারে। যাবার সময় বাথরুম এবং রান্নাঘরের পানির কল বন্ধ করেছি কিনা ভালো করে দেখে নিলাম। সব রুমের ক্লোজেট বন্ধ করলাম। লাইট, ফ্যানের সুইস বন্ধ করে বের হলাম। গাড়িতে গিয়ে বসার পর স্বামী বললেন, শেষবারের মতো আরেকবার দেখে আসি সব ঠিক আছে কিনা। তিনি দেখে এলেন। অতঃপর আমরা জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। দীর্ঘ দুই মাস পর ফিরে এসে দরজা খুলে দেখি রান্না ঘরের বাতি জ্বলছে। একে একে সব রুমে গিয়ে দেখি বড় ক্লোজেটের দরজা পুরোপুরি খোলা। বাকি সবই যেমন রেখে গিয়েছি, তেমনই আছে। স্বামীর উপর একটু বিরক্ত হলাম, শেষবারের মতো দেখতে এসে বাতি জ্বালিয়ে রেখে গিয়েছে বলে। অপচয় আমার একেবারেই অপছন্দ, অথচ দুইমাস ইলেকট্রিক বাতিটি বেহুদাই জ্বলেছে! তিনিও নিজের ভুল হয়েছে ভেবে চুপটি করে রইলেন। দুইদিন পর এক সকালের না-আলো, না-আঁধার সময়ে আমার নিচতলার প্রতিবেশি চায়নিজ মিস্টার কেভিনের সাথে দেখা হতেই বিস্ময় নিয়ে বললেন, তোমরা এতদিন কোথায় ছিলে ? আর এইদিকে কতো ঘটনা ঘটে গিয়েছে শুনবে ? বিস্ময়ে চায়নিজ চোখ যুগল আরো ছোট হয়ে আসে তাঁর। অতঃপর মিস্টার কেভিন যা বলল তাতে আমি নিজেই বিস্মিত। যেহেতু শাশুড়ি আম্মার বয়স আশি ছুঁইছুঁই, তাই তাঁর শারীরিক নানাবিধ চেকআপের প্রয়োজন পড়ে মাঝেমাঝেই। কখনো কখনো নিয়মিত ডাক্তার, স্পেশালিষ্টের সাথে এপয়েনমেন্ট থাকে। ডাক্তারের অফিস, হেলথ ইনস্যুরেন্স এর লোকজনও ফোন করে নানাবিধ শারীরিক তথ্য জানতে চায়। কিন্তু আমাদের অবর্তমানে অহরহ ফোন করে কাউকে না পেয়ে তাঁদের সন্দেহ এবং আশংকা ঘনিভূত হয়। তাঁরা পুলিশে খবর দেয়। অতঃপর তিন দফায় পুলিশের লোকজন এসে বাসার ভেতরে, ক্লোজেট, উপরে, নিচে সব রুম তন্নতন্ন করে দেখে যায়। বেলকণির কাঁচের দরজার স্ক্রু খুলে এমনভাবে ভেতরে ঢুকেছে এবং যাবার সময় দরজাটি ঠিক আগের মতো করে বন্ধ করে গিয়েছে যে বুঝার উপায় নেই বাসার ভেতরে কেউ ঢুকেছিল। যাবার সময় ভুল করে রান্নাঘরের বাতি জ্বালিয়ে রাখা তাঁদেরই কাজ। নীচতলার প্রতিবেশিদের জিজ্ঞেস করে গিয়েছে, শেষ কবে আমাদের বাসার বাইরে দেখেছে তাঁরা। অর্থাৎ একজন বৃদ্ধ মানুষ ঘরে একাকি মৃত পড়ে আছেন কিনা দেখতেই তাঁদের এই তল্লাশি।

 

আমার প্রতিবেশি মিস্টার কেভিনের কাছ থেকে কথাগুলো শুনার পর সেদিন দিনভর আমার খুব মনে পড়ছিল এরন নামের এক শ্বেতাঙ্গ পিতার কথা। তাঁর পুরো নাম কি, কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। পরিচয়ের প্রথমদিন নিজে থেকেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে টেনে টেনে বলেছিল, ‘অ্যাই অ্যাম মিস্টার এএএরন ‘। লাঞ্চব্রেকে আমার কর্মস্থলের পাশের ফাস্টফুডের দোকানটিতে যখন খেতে যেতাম, সেসময়ে পরিচয় হয়েছিল মাঝ সত্তর বয়সের মিস্টার এরন এর সাথে। কোন ভূমিকা ছাড়াই গল্প শুরু করতো। গল্পের প্রায় পুরো অংশ জুড়ে থাকতো তাঁরই একমাত্র পুত্র আর মৃত স্ত্রী। ওই সময়টাতে যেন তাকে শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা আর বিষণ্ণতায় পেয়ে বসতো। বেদনাবিধুর একটা পরিবেশে আমি তার গল্প শুনতাম আর সেই সময় তাঁর চেহারায় শোক আর ভালবাসার বহিপ্রকাশ ঘটতো। মৃত স্ত্রীর প্রসঙ্গে তাঁর অনুভূতির কথাগুলো অনেকটা রবিঠাকুরের সেই লাইনগুলোর মতো, ‘ রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে ‘।  ম্যানহাঁটনের ওয়েস্ট টুয়েন্টি থার্ড স্ট্রীটের পাশেই একটি এপার্টমেন্ট বিল্ডিং এ মিস্টার এরন একাই বসবাস করতেন। একমাত্র পুত্র চাকুরির সুবাদে থাকতো অন্য শহরে। পিতা-পুত্রের ফোনে কথা হতো মাঝে মাঝে। দেখা হতো না বললেই চলে। ফাদার’স ডে তে ছেলে উপহার পাঠাতো, এতেই এরন ভীষণ খুশি। আমি আমার বাবাকে বিশেষ দিনটিতে উপহার পাঠাইনা শুনে এরন বড্ড আহত স্বরে বলতো, ” তুমি তোমার বাবাকে ভালোই বাসো না “। আমিও বলতাম, ” বিশেষ একটি দিনের জন্য আমরা বাংলাদেশিরা আমাদের বাবাকে ভালোবাসি না। আমরা ভালোবাসি প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে ।”

এক বিকেলে আমার কর্মস্থল (একটি চেইন স্টোর) এ মিস্টার এরন তাঁর ছেলেকে নিয়ে এসে হাজির। উচ্ছ্বসিত হয়ে পরিচয় করিয়ে দেয়। ছেলেকে উদ্দেশ্য করে স্মিত হেসে বলেছিল, ‘ রোজ দুপুরে খাবারের সময়ে আমি যে সুন্দর রমণীর সাথে গল্প করি, এই হচ্ছে সে ‘। এরপর প্রতিদিনের ন্যায় রোজ সূর্য উঠে, বাইরে আলো ফোটে, আবার আঁধার ঘনায়। সন্ধ্যার পাখিরা নীড়ে ফিরে। নিয়ম করে সময় মেপে দূরের আকাশে উড়ে যায় উড়োজাহাজ। আমি সেইদিকে তাকাই, অতঃপর মাথা নামিয়ে ফাস্টফুডের দোকানের কোণার দিকের চেয়ারে গিয়ে বসি। একাকি চুপচাপ লাঞ্চ সারি। মিস্টার এরনের দেখা নেই ! এপ্রিলের এক রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুর। অনেকটা বাংলাদেশের মাঘ মাসের মতোই হালকা শীতের চমৎকার একটি দিন। খণ্ডখণ্ড মেঘও ছিল আকাশে সেদিন। লাঞ্চ সেরে হাতের কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বাইরে এসে দাঁড়াই। আচমকা বিকট সব আওয়াজে কান ঝালাপালা হবার উপক্রম। মিস্টার এরনের এপার্টমেন্ট বিল্ডিং এর চারিপাশে এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন আর পুলিশের গাড়ীর সাইরেনের আওয়াজ মিলেমিশে অদ্ভুত এক আতঙ্কিত, ভুতুড়ে পরিবেশ তখন। অন্য অনেকের মতোই উৎসুক আমি ঘটনা জানবার চেষ্টা করছি। লোকজন নিজেদের মাঝে একথা, ওকথা বলাবলি করছিল। অবশেষে জানলাম, দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল বলে প্রতিবেশীরাই পুলিশে খবর দিয়েছিল। একাকি এপার্টমেন্টটিতে পাঁচদিন আগেই এরনের মৃত্যু হয়েছিল। সেদিন কাজ শেষে টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেই অচেনা এক বিষণ্ণ মনে। ট্রেনে ফিরছিলাম যখন, যেন ক্রমশ দূরে সরে যেতে যেতে ম্রিয়মান হতে থাকে জনমানুষের কোলাহল। দৃশ্যমান অনেক মানুষের মাঝে অদৃশ্য এরনের মুখখানা ভেসে উঠে বারংবার। আহা, মৃত্যু কি এসেছিলো তার ঘুমন্ত শরীরের উপর দিয়ে ? শেষ সময়টাতে ছিল না কোন মমতার হাত কপালে! ছিল না প্রিয়জনের ভালোবাসাময় মায়াবী চাহনি। দেয়নি কেউ মুখে দু’ফোটা তৃষ্ণার জল…! তবে দু’ফোটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়েছিল এই ভিনদেশী আমার কপোল বেয়ে। ট্রেন জংশন ব্লুবার্ড স্টেশনে এসে যখন থামে, ততক্ষণে অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে বাইরের শহর জলমগ্ন। বিশ্বাস করুন, সেদিনের বর্ষণমুখর সেই সন্ধ্যাটুকু অন্য দিনের সন্ধ্যা’র চেয়েও অধিক নির্জন এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হয়েছিলো আমার কাছে। নিঃসঙ্গ মানুষের জন্যে সঙ্গ বড় বেশি প্রয়োজন। জীবনের পড়ন্তবেলায় মানুষ স্মৃতি হাতড়ে বেঁচে থাকে। মানুষকে যেতে হয় চরম এক মানসিক যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে। এদেশে ঘরের কোণে এরনের মতো এমন একাকি, নিঃসঙ্গ মৃত্যু হয় অনেকেরই। এক জীবনে অনেক না পাওয়ার মাঝেও যারা জীবনের শেষ সময়গুলোয় পরিবারের মানুষদের সঙ্গ আর বুকভরা ভালোবাসা পায়, তাঁরা বড় বেশি ভাগ্যবান। এমন ভাগ্যবান ক’জন আছেন ?

কলেজে পড়ার সময়ে ইংরেজি শিক্ষক ওয়ালীউল্লাহ্‌ স্যার যখন ‘দ্যা ড্যাফোডিল’ কবিতাটি পড়াতেন, তখন ফুলের সাথে মানুষের জীবনের তুলনামূলক ব্যাখ্যা দিতেন এভাবে, ‘ আমাদের জীবন সংক্ষিপ্ত, কিন্তু আমাদের যৌবন আরো সংক্ষিপ্ত ‘। এই সংক্ষিপ্ত জীবনে একে একে কাছের, দূরের মানুষদের এইসব চলে যাওয়া বড় বেদনার মতো বাজে, প্রাণে।

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

১জন ১জন
0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ