“বর্ষায় ঝরঝর সারাদিন ঝরছে,
মাঠ ঘাট খাল বিল থৈ থৈ করছে।”- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা।
“যদি মন কাঁদে তবে চলে এস,চলে এস।
এক বরষায়”হুমায়ূন আহমেদের গান।
বরষা নিয়ে কবি সাহিত্যিকদের অনেক অনবদ্য রচনা রয়েছে যা আজও আমাদের মন কেড়ে নেয়।
বসন্ত নাকি ঋতুরাজ। বর্ষা বিদায় নিয়েছে।আমার বর্ষাকেই ঋতু রাজ বলতে ইচ্ছে করে। বর্ষার সৌন্দর্যটাই অন্যরকম। সারাদিন টুপটাপ ঝরতে থাকে, প্রকৃতি মাথা নত করে উপভোগ করে।এ সৌন্দর্য আমাদের জন্যও অন্যরকম উপভোগ্য।বৃষ্টি এলেই মনটা ভেজার জন্য আনচান করে ওঠে। কেমন উদাস উদাস লাগে।সব থাকার পরও মনে হয় কি যেন নেই। বৃষ্টি প্রেমিক মেয়েরা নিজেকে বৃষ্টি স্নানে জুবুথুবু করে ধন্য হয়। পাশের বাড়ির যুবক ছেলেটিও সুযোগ খোঁজে বৃষ্টিস্নাত মেয়েটির সৌন্দর্য দেখবার।
“আজি ঝরো ঝরো মুখরও বাদরও দিনে জানিনে;জানিনে,
কেন যে কিছুতে মনও লাগেনা লাগেনা।”এরকম অনুভুতি কাজ করতে থাকে।
বাচ্চারাও কম যায় না।অযথাই দৌড় ঝাঁপ করে পানিতে ভিজতে থাকে।মায়েরা লাঠি হাতে তাদের ফেরানোর বৃথা চেষ্টা চালায়।ভিজতে ভিজতে ঠোঁট সাদা হয়ে কাঁপুনি শুরু হলে ফিরে আসে।মা তখন তাদের শাসনের সুরে গা মুছে সরিষার তেল দিয়ে মুড়ি মেখে দেয়।
কৃষক বৃষ্টির গান গাইতে গাইতে জমিতে হালচাষে নেমে পরে।এ যেন মহা আনন্দ যজ্ঞ।
মাছেরা নবযৌবনা হয়।লেজ নেড়ে নেড়ে সঙ্গীদের নিয়ে ডিম দেয়।নদী,মাঠ-ঘাট,পুকুর উপচে যায় বৃষ্টির পানিতে। নদীর পাড়ের মানুষরাই শুধু না,উজানের মানুষও বিভিন্ন প্রকার জাল নিয়ে মাছ ধরতে নেমে পরে।খেয়েদেয়ে অতিরিক্ত মাছ শুটকি বানায়।
এ সময় জেলেদের নদীতে মাছ ধরা দেখলে আমারই কেমন গা ছমছম করে।কি উত্তাল ঢেউ!যে চাচার কাছে নদীপাড়ে গিয়ে মাছ কিনি তাকে জিজ্ঞেস করলাম- চাচামিয়া ঢেউএ ভয় করে না?
সহজাত উত্তর- আমি ভয় পাইলে তোমরা খইবা কি?
সত্যিই তো দেশী মাছের অতুলনীয় স্বাদ! ওনারা সাহসী পদক্ষেপ নেয় বলেই আমরা খেতে পারি।
গ্রামে যুবক ছেলেরা পুলের মাথায় একত্রিত হয় পুকুর থেকে বের হওয়া মাছ ধরতে।সারাদিন এমনকি রাতেও জাল ফেলে ফেলে মাছ ধরে।সবাই একসাথে জাল ফ্যালে।কেউ একটাও পায়না আবার কেউ বড়সড়টাই পায়। সমস্বরে সবাই আনন্দ চিৎকার দেয়। বাড়িতে একা থাকা বউটির কান পাতা থাকে পুলের পাড়ে।সে চিৎকার শুনে লাল হয়,আঁচলে মুখ ঢেকে মনে মনে আনন্দিত হয়,বড় মাছটি বুঝি তাঁর জনই পেল।মেয়েরা বাপের বাড়ি বেড়াতে আসে। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক গল্প কাহিনীও আছে বর্ষা নিয়ে। মোটামুটি একটা আমেজে ভরে থাকে বর্ষাকাল।
নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ।
‘মাছে ভাতে বাঙ্গালীয়ানা‘দেশটির গলপ অন্য সব দেশের মুখে মুখে। সেই দেশ আর তার আশীর্বাদপুষ্ট বর্ষা এখন পরিনত হয়েছে অভিশাপে।নদী পাড়ের সুখী মানুষগুলো বর্ষার পানিতে প্রত্যেক বছর ভাসতে থাকে। ভেলা বানায়, চৌকির উপর চুলা বসিয়েও রক্ষা হয়না।আশ্রয় নেয় রাস্তায় ও বিভিন্ন বাঁধে।গতদুমাস ধরেই দেশে বন্যা চলছে।প্রায় বএিশটি জেলার মানুষ পানিবন্দী হয়ে ভোগান্তির শিকার। কোথাও কোথাও পানি নামতে শুরু করেছে। সেখানকার মানুষজন ফিরতে শুরু করেছে বাড়িতে। ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে থেকে পঁচে গ্যাছে।সরকারী-বেসরকারী সহায়তায় চলছে মেরামতের কাজ।আবার শুরু হবে,পরের বর্ষার আগ পর্যন্ত জীবনযাপন।
প্রতিবছরই জনসংখ্যার বিরাট একটা অংশ এই দূর্ভোগের শিকার হয়। অসহনীয় দৃশ্য! সারাদিন বৃষ্টি হয়েই চলছে আর মানুষজন রাস্তা ও বাঁধের ওপর প্লাষ্টিক ত্রিপালের ঘর বানিয়ে গরু,ছাগল,ভেড়া,হাঁস,মুরগি সহ একত্রে বসবাস করছে।
সারাদুপুর অপেক্ষায় থাকে কখন খাবার আসবে।আসে হয়ত,শেষ বিকেলে সামান্য খিচুড়ি।কোনকোনদিন আসেই না।এমনি করে খেয়ে,না খেয়ে পার করে বন্যা।আবার ফিরে যায় নিজ বাড়িতে।
আমি দীর্ঘদিন NGOতে কাজের সুবাদে মানুষের দূর্ভোগ এর সাথে পরিচিত।একদিন একজনকে বললাম-
চাচী আম্মা এতকষ্ট করে কেন নদী পাড়ে থাকেন বা ফিরে আসেন?
সাবলীল উত্তর-আমগো কে ঠাঁই দিব গো মা।কই যামু।আমার বাবুই পাখির কবিতা মনে পড়ে গেল-” নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা”।
বছরের পর বছর নদীপাড়ের মানুষের এই দূর্ভোগের স্হায়ী সমাধান কি নেই?থাকলে সেটা কি?
BIWTA (বাংলাদেশ নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়)এর এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা যিনি সারাবছর নদীতে অবস্থান করেন।এবং কাজ করেন। পরিচিতির সুবাদে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম- আপনারা এত কাজ করেন লাভ তো দেখিনা। বন্যা হয়েই যায়।তাঁর প্রতিউত্তরে আমার মাথায় হাত।
“আমরা সরকারের অতি স্বল্প বাজেটে যে কাজ করি তা ১০০ ভাগের ১০ ভাগ।দেশের সব নদী ময়লা-আবর্জনায় ভরে গ্যাছে।আর পলি ও ভাঙ্গনে নিজের গতিপথ হারিয়ে ফেলেছে।নদীর মাঝে ভরাট হয়ে গ্যাছে।তাই বর্ষায় যে পানি হয় তা ধারন ক্ষমতা নদীর থাকেনা।ফলে বন্যা হয়।
বন্যা রোধ করতে গেলে নদীর গতিপথ তৈরী করতে হবে।আধমরা নদীগুলো ড্রেজিং করতে হবে।নদীর গভীরতা বাড়লেই আর বন্যা হবেনা।আমাদের এর জন্য বিরাট বড় সর বাজেট দরকার।আর আমাদের যেহেতু প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট নেই তাই বিদেশি কোম্পানিকে কন্টাক্ট করতে হবে।এত টাকা আমাদের কোথায়?
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।আশাবাদী মানুষ আমি।চোখের সামনে উন্নত দেশের মত;আমাদের টলটলে নদীর পানি ভাসতে থাকল। স্বপ্নের পদ্মা সেতু যেমন নিজের দেশের টাকায় হচ্ছে তেমনি একদিন এটাও হবে।আমরা নাতি নাতনী নিয়ে নদীপাড় ধরে ভ্রমনে বের হব।খুশিতে মনটা নেচে উঠল।
২৫টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
দারুন অনবদ্য লেগেছে আপু। বৃষ্টি ভেজা দিন খুব ভালো লাগে ঘরে থাকলে কিন্তু কাজের খুব ব্যাঘাত ঘটায় আর বৃষ্টির দিনে আমার মনটাও কেমন যেন উদাসী আর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কিন্তু বৃষ্টিস্নাত গাছপালা , পথঘাট দেখতে খুব ভালো লাগে। অতিবৃষ্টি আমাদের দেশের জন্য অভিশাপ বয়ে আনে। শহর, গ্রাম সবখানে অতিবৃষ্টি কষ্ট দেয় বেশি। আমরাই আমাদের দেশের নদীনালা গুলো কে প্রতিনিয়ত হত্যা করছি নিজেদের ভুলে ।শহরে , গ্রামে এখন প্লাষ্টিক, পলির আধিপত্য চরম সর্বনাশ ডেকে এনেছে। আমাদের বোধগম্য যে কবে হবে জানিনা। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা রইলো
রোকসানা খন্দকার রুকু।
অনেক সুন্দর বলেছেন আপু।
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
ভালো থাকবেন।
ইঞ্জা
কি বলবো, বৃষ্টি বিলাস নাকি বর্ষা বিলাস, খুব সুন্দর করে বর্ষা বন্দনা করেছেন, বর্ষাকালে আমাদের চিরাচরিত রূপ তুলে ধরলেন আপনার লেখণীর মাঝে, সত্য মুগ্ধ হলাম।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
আপনাকে মুগ্ধ করতে পেরে ধন্য হলাম।
ভালো থাকবেন।
ধন্যবাদ। শুভ কামনা।
ইঞ্জা
আপনিও ভালো থাকবেন সুপ্রিয় ব্লগার।
ফয়জুল মহী
নিপুন প্রকাশ।
অনবদ্য , লেখা পড়ে বিমোহিত হলাম।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
মহী ভাইয়া অনেক ধন্যবাদ।
শুভ কামনা।
নিতাই বাবু
আপনার বৃষ্টি বিলাশে বিনোদিনী বর্ষা পরে সত্যি বিমোহিত হলাম। সাথে আজ দুইদিন ধরে অঝরে ঝরে পড়া বৃষ্টি নিয়েও ভাবছি! ভাবছি, আপনার সুলিখিত বিনোদিনী বর্ষা নিয়েও।
শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয় দিদি।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
বর্ষার জন্যই আমাদের দেশ সুজলা সুফলা।
আজ সে অভিশাপ আমাদের জন্যই।
পাগলও নাকি নিজের ভালো বোঝে।
শুধু বাঙালি বোঝেনা।
দোয়া করবেন আর ভালো থাকবেন দাদা।
আলমগীর সরকার লিটন
বেশ স্বপ্নময় লেখা অনেক শুভেচ্ছা রইল রুকু আপু
রোকসানা খন্দকার রুকু।
জী ভাইয়া। ধন্যবাদ।
শুভ কামনা।
সুপায়ন বড়ুয়া
“স্বপ্নের পদ্মা সেতু যেমন নিজের দেশের টাকায় হচ্ছে তেমনি একদিন এটাও হবে।আমরা নাতি নাতনী নিয়ে নদীপাড় ধরে ভ্রমনে বের হব।খুশিতে মনটা নেচে উঠল।”
আমরাও একদিন স্বপ্নীল বাংলাদেশ গড়বো।
শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
ধন্যবাদ দাদা।
দোয়া করবেন। ভালো থাকবেন।
তৌহিদ
বর্ষা নিয়ে চমৎকার একটি পোস্ট লিখেছেন। এটি আমারও খুব পছন্দের ঋতু। তবে সুবিধে অসুবিধে সবকিছুরই আছে।
ভালো থাকুন আপু।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
ধন্যবাদ।আমার পছন্দের সাথে মিলে গেল।
ভালো থাকবেন সবসময়।
আরজু মুক্তা
চমৎাকার ভাবে তুলে ধরেছেন বর্ষাকে।
আর যারা বর্ষায় শুধু দুর্দশাগ্রস্ত, তারা ভালো থাক। তাদের জন্য সোনালি রোদটাই কাম্য।
শুভকামনা আপি
রোকসানা খন্দকার রুকু।
হুম সেটাই আশা।আমাদের বন্যা পিরীত মানুষগুলোর জীবনে সুসময় ফিরে আসুক।
তোমাকেও ধন্যবাদ আপু।
ভালো থেক।
রেজওয়ানা কবির
বর্ষার সকল সমাগম তুলে ধরেছো।খুব ভালো লাগল আপু।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
খালি সমাগম চোখে পড়ল।
বাকি সব। বাঙালি খুব বিজি।
ধন্যবাদ আপুনি।
ছাইরাছ হেলাল
আপনার বর্ষা-বন্দনা খুব সুন্দর। কাছে থেকে প্রাণ দিয়ে দেখলে যা হয়।
বর্ষার এত এত রূপ, তাতে ভাল না লেগে উপায় নেই।
তবে আশায় থাকতেই হচ্ছে, সকল দুর্বিপাক একদিন শেষ হবে অবশ্যই।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
ইনশাআল্লাহ। অসম্ভব বলে কিছু নেই।
শুভ কামনা ভাইয়া।
ভালো থাকবেন।
সাবিনা ইয়াসমিন
আশা রাখি হয়তো একদিন আমাদের নব প্রজন্মের হাত ধরে সত্যি সত্যিই বর্ষার রুপে মুগ্ধ হবো। তার আগ পর্যন্ত কবিদের কবিতায়, আর বানভাসি মানুষের হাহাকারময় বর্ষাকালের দিনগুলো অতিবাহিত করি।
অনেক অনেক চমৎকার একটা পোস্ট দিয়েছেন।
আরও লিখুন। শুভ কামনা সব সময়ের জন্যে 🌹🌹
রোকসানা খন্দকার রুকু।
রাগ করেছি কিছু বলব না।
সাবিনা ইয়াসমিন
আচ্ছা, রাগ ফুরিয়ে গেলে নাহয় কিছু-মিছু বইলেন। আছি এখানেই 😉
সুরাইয়া পারভীন
আচ্ছা এতো এতো সৌন্দর্যের অধিকারী তাকে তো অনায়াসে রাণী বলায় চলে তাই না! ঋতুর রাজা যদি বসন্ত হয় তবে বর্ষা রাণী নয় কেনো? আমি তো বর্ষাকে উন্মত্ত মাতাল করা রাণীই বলি। সব কিছুর ই এপিঠ ওপিঠ আছে। বর্ষা যেমন মনকে আন্দোলিত করে, মাতাল করে তেমনি অতিরিক্ত বর্ষণের ফলে সহায় সম্বল হীন হয়ে যাযাবর জীবন যাপন করে কতিপয় মানুষ জন। হয়তো সময়ের সাথে সাথে একদিন বর্ষা রাণীর সৌন্দর্য আরো বেশি উপভোগ্য হয়ে উঠবে আমাদের কাছে।