প্রিয় স্বদেশ,
অনেক ভালো থাকার মাঝেও আমি ভালো নেই। ভেতরটা কেমন যেনো খাঁখাঁ শূন্যতায় কাঁদে। শুনেছি বিদেশ বিভূঁইয়ে সমুদ্রের তীরে গেলে মানুষের মন ভালো হয়। কিন্তু, যতোবারই সমুদ্রের ধারে গিয়েছি, জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দের মাঝে স্বর্ণকেশীদের ডুবে যাওয়া আর ভেসে উঠার খেলা দেখে আমার কেবলই সেই কলের জলের শব্দ কানে বাজে, বালতি থেকে মগ ভর্তি জল নিয়ে বাবা আমার মাথায় ঢেলে দিতেন। আমার শুধুই ছোট সুন্দর গ্রামের সেই নিস্তরঙ্গ, শান্ত দীঘির জলে বাবা, চাচাদের সশব্দে ঝাঁপিয়ে পড়া, সাঁতরে ডুবা আর ভেসে উঠার স্মৃতিগুলো সামনে এসে দাঁড়ায়। মনের চারিপাশে ঘুরে বেড়ায় আমার চাঁদপুরের সাঁতার শেখা লেকে জাতীয় সাঁতারু অরুন নন্দী চাচ্চুর মুখখানি। আমার ভীষণ মন খারাপ হয়। ভেতরটা কেমন যেনো খাঁখাঁ শূন্যতায় কাঁদে।
লেক জর্জে বেড়াতে গেলাম যেদিন, হোটেল রুমের সামনের বিশাল সবুজ লন দেখে আমার কেবলই শুকনো ঘাসের বিরান সেই মাঠের কথা মনে পড়ে, যে মাঠের সরু পথ বেয়ে একদা হেঁটে গিয়েছিলাম উত্তর বাড়ির কলিমুদ্দিন খাঁ’র মেয়েকে দেখতে। আমার সমান বয়সী মেয়েটি সেই নির্জন দুপুরে জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে মারা গিয়েছিলো। লেক জর্জের লেকের জল কি স্বচ্ছ নীল! আমি সেই জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকবার সময়ে শুধুই সেই মেয়েটির মুখখানা দেখি জলের কাঁপনের সাথে। কচুরিপানা, শাপলা, আর জলের নিচে খেলা করা মাছদের কথা মনে পড়ে। কেননা, সেই মেয়েটিই যে আমায় ডোবার ধারে নিয়ে গিয়ে এসব চিনিয়েছিলো! আমার বড্ড মন খারাপ হয়। ভেতরটা কেমন যেনো নেই নেই আর্তনাদে কাঁদে।
সেন্ট্রাল পার্কের মনোরম দৃশ্যের মাঝে হাজারো মানুষ হেঁটে যায়। একপাশে বয়ে গেছে লেক। লেকের জলে একদল হাঁস ভেসে বেড়ায় মনের সুখে। অন্যপাশে সারি বেঁধে ঠক্ঠক্ শব্দে হেঁটে যায় ঘোড়ার গাড়ি। অসাধারন সেইসব দৃশ্যে ভিনদেশি মানুষেরা ছবি তোলায় মগ্ন। অথচ সকলের অদেখার মাঝে আমি ফ্যলফ্যল করে চেয়ে থাকি। আমার মন সেইখানে থাকে না। পেছনের কালে ফিরে যায়। ভেজা স্বরে গেয়ে উঠি__
হায়রে আমার গাঁয়ের বাড়ি,
সারি সারি গরুর গাড়ি,
মরা নদীর চর।
দীঘির জলে হাঁসের খেলা,
ঘরের চালে দুপুর বেলা,
রঙ্গিলা কইতর ……
আমার গলা ধরে আসে।
প্রিয় স্বদেশ, আমার এমন তৃষ্ণা লাগে ক্যান? হাহাকার লাগে ক্যান?
খাঁখাঁ রৌদ্রের মরুভূমির বুকে একফোঁটা তৃষ্ণার জলের মতন হাহাকার?
ক্যান, ক্যান, কইতে পারো আমায়? কইতে পারো?
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
৫টি মন্তব্য
নীহারিকা
স্বদেশের জন্য এমন হাহাকারের, তৃষ্ণার কোনো জবাব নেই।
ভালো থাকুন প্রবাসে।
চিঠি কিন্ত ভালো হয়েছে আপা। (y)
শুন্য শুন্যালয়
আমরা যারা প্রবাসে থাকি, যেদিন বিদেশের মাটিতে পা রাখি দুই টুকরা হয়ে থাকি; অর্ধমৃত।
তোমার লেখার কথা আর কী বলবো আপু! আমরা বাহির, তুমি ভেতর।
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু বুকের ভেতর খাঁ খাঁ করে তোমার এমন লেখা পড়লে।
বিশ্বভ্রমণের স্বপ্ন ছিলো, দেশ থেকে বাইরে গিয়ে অন্য কোনো দেশে থাকার স্বপ্ন কখনো দেখেছিলে তুমি?
আমি দেখিনি।
ভালো থেকো প্রিয় আপু। -{@
জিসান শা ইকরাম
দেশের বাইরে গেলে যত চাকচিক্যের মধ্যেই থাকিনা কেন, মন থাকে দেশের মাটিতে।
চিঠি পড়ে মন হুহু করে উঠলো।
গাজী বুরহান
স্বদেশ নিয়ে চিঠিতে এক হাহাকার এবং প্রবাসীদের সব পাওয়ার মাঝেও যেন কিছুই নেই ফুটে উঠেছে।
চিঠিটি অসাধারণ ছিল।