প্রবাসে রমজান

রিমি রুম্মান ২৫ মে ২০১৯, শনিবার, ১২:০৯:৪৭অপরাহ্ন সমসাময়িক ২০ মন্তব্য

দেখতে দেখতে রমজান মাসের প্রায় শেষের দিকের সময় চলছে এখন। কেমন যাচ্ছে প্রবাসীদের পবিত্র রমজান মাস ? ‘ সারাদিন কর্মব্যস্ততায় কাটলেও ইফতারের সময়টায় খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে উঠি, দেশে রেখে আসা পরিবারের কথা মনে পড়ে খুব, একাকীত্বটা আরো বেশি করে জেঁকে ধরে, ‘ বললেন নিউইয়র্কে বাঙালিদের ব্যস্ততম এলাকা জ্যকসন হাইটসের ফুটপাতে জায়নামাজ, তসবি, ধর্মীয় বই বিক্রেতা প্রবীণ একজন। ব্যাচেলর জীবন যাপন করছেন এমন একজন তরুণ জানালেন ভিন্ন কথা। তিনি যে বাড়িতে ভাড়া থাকেন, সেখানে আরো চারজন ব্যাচেলর বসবাস করেন। সকালে কাজে গিয়ে সন্ধ্যার আগেই সকলে ঘরে ফিরেন। রুটিন করে এক একদিন এক একজন ইফতার তৈরির দায়িত্ব পালন করেন যদিও, তবে তাকে অন্যরাও সহযোগিতা করে থাকেন। ছোলাবুট, পেঁয়াজু, চিড়া, লেবুর শরবত, মুড়ি, জিলাপি এবং নানান রকম ফলমূল দিয়ে টেবিল সাজিয়ে একসাথে বসে ইফতার করা, একসাথে নামাজে দাঁড়ানো, আবার ভোরের দিকে সেহেরী খাওয়া, সবমিলে দেশীয় আমেজে রমজান মাস উপভোগ করেন তারা। রাতের শিফটে ক্যব চালান এমন দুইজন বড়ভাইয়ের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিকেল পাঁচটায় কাজে নেমে পড়েন তারা। যেহেতু এটি একটি স্বাধীন পেশা, তাই ইফতারের কিছু আগে কাজে বিরতি দিয়ে বাসায় ফিরে আসেন। পরিবারের সাথে একত্রে ইফতার করে আবার কাজে ফিরেন। অর্থাৎ পূর্ণ ঘরোয়া আমেজে পবিত্র রমজান মাস অতিবাহিত করেন তারা। পরিবার এদেশে নেই এমন কেউ কেউ বাড়িতে ইফতারের ঝামেলায় না গিয়ে বাঙালি রেস্তোরাঁয় ইফতার সারেন। রেস্তোরাঁগুলোয় ইফতারের জমজমাট আয়োজন থাকে। দুপুরের পর থেকেই শুরু হয় এই আয়োজন। ইফতারের জন্যে নিয়মিত আইটেমগুলো ছাড়াও সাথে থাকে হালিম, খিচুড়ি, বিরিয়ানি। মসজিদগুলোতেও রোজাদারদের জন্যে ইফতারের ব্যপক আয়োজন থাকে। মুসলমানরা একসাথে বসে ইফতার করেন। তারাবির নামাজের সময়টাতেও মুসল্লিদের ভিড় লক্ষণীয়। সেইসময়ে এটি যে বিদেশ বিভূঁইয়ের কোন একটি স্থান, এমনটি মনে হয় না। অথচ আমার প্রবাস জীবনের শুরুর দিকের সময়গুলোতে এমন দৃশ্য ছিল কল্পনাতীত। আমার শৈশবের দিনগুলোতে রমজানের সময় ক্ষুদা, তৃষ্ণা কিংবা ক্লান্তি কখনোই আমাদের কাবু করতে পারতো না। কেননা আমাদের শেখানো হয়েছিল, অভাবী মানুষদের ক্ষুদার কষ্ট অনুভবের জন্যে এবং সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভের জন্যেই আমরা রোযা রাখি।আর তাই ক্ষুদাকে আমরা প্রশ্রয় দিতাম না। তবে ইফতারের ঠিক আগের সময়টায় ভেতরে একরকম আনন্দ খেলে যেতো। আমরা দুইবোন রুহ আফজা দিয়ে শরবত বানানো, টেবিলে খাবার সাজানোর কাজটি করতাম। মা গরম গরম পিঁয়াজু, বেগুনী ভাজতেন। আব্বা আর ভাইটি টুপি মাথায় অপেক্ষা করতেন। একসাথে মোনাজাত ধরতেন। সে এক অন্যরকম পরিবেশ ছিল।

তবে যে দৃশ্য এখন পর্যন্ত দেখা হয়নি এই প্রবাসে, তা হোল সেহেরীর সময়ে মাইকে শহরবাসীকে ডেকে তোলা। খুব মিস করি সেইসব দিনগুলো, যখন আমার মফঃস্বল শহরে রমজানের মধ্যরাতগুলোতে পাড়ার অলিতে গলিতে রিকশায় মাইক লাগিয়ে সেহেরি খাওয়ার জন্যে সবাইকে ডেকে তোলা হতো। মধ্যরাতে ইসলামী গান কিংবা গজল গেয়ে মাইকিং হতো, অথচ কেউই এতে বিরক্তবোধ করতো না। সকলেই একে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতো। শহর জুড়ে সকলেই যেন রমজান মাসে একটি পরিবারে হয়ে উঠত। আম্মা রাত জেগে নফল ইবাদত করতেন। অতঃপর সেহেরির জন্যে রান্না করে রাখা খাবার সব গরম করে একে একে টেবিলে সাজাতেন। আমাদের তিন  ভাইবোনকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন। খুব ভাব গম্ভীর এক পরিবেশে নিরবতার সাথে আমরা সেহেরি শেষ করতাম। কিন্তু এই প্রবাসে অনেকেরই সেহেরি খাওয়ার জন্যে ঘুম থেকে জেগে উঠা হয় না। কাজের সময় সকলের এক না হওয়াতে যার যার সুবিধানুযায়ী সেহেরি করে নেয়। দীর্ঘ সময় উপোষ থেকে রোযা রাখতে হয় যদিও, তবুও কেউ কেউ একবারেই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সেহেরির সময় অব্দি অপেক্ষা করে না। রোযা রাখার জন্যে সেহেরি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু পর্যাপ্ত ঘুম না হলেও তো চলে না। কর্মস্থলে ক্লান্তি জেঁকে বসে। পরিবারের সকলে মিলে মধ্যরাতে একসাথে ডায়নিং টেবিলে ঢুলুঢুলু চোখে সেহেরি করা, ফজরের আজানের ঠিক আগে আগেই রোযার নিয়্যত করা, এমনটি অন্তত আমার দীর্ঘ প্রবাস জীবনে হয়ে উঠেনি।

রমজান মাসে যাকাত দেয়া-নেয়ার বিষয়টিও চোখে পড়ে না এই বিদেশ বিভূঁইয়ে। প্রবাসীরা যাকাতের টাকা দেশে নিজ নিজ এলাকায় বিতরণের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে থাকেন, বিধায় ভিড় থাকে মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে। আমার এখনো মনে আছে এদেশে আসার পর প্রতি রমজানে দেশে যাকাতের টাকা কখন পাঠাবো সে খোঁজ নিতেন প্রতিবেশিদের অনেকেই। টাকা পাঠাবার পর দেশে কথা হবার সময় ফোনের অন্য প্রান্তে শোনা যেতো অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ। বাবা বলতেন, ‘ তোর আম্মা অমুককে যাকাত দিতে চায়, সে যাকাত পাবার উপযুক্ত না ‘। মা বলতেন, ‘ তোর আব্বা অমুককে দিতে চায়। তারে দেয়া ঠিক হবে না, সে নামাজ কালাম পড়ে না, রোযা রাখে না ‘। এমনতর মৃদু মতবিরোধ, যাকাত নিতে আসা মানুষজনের আনাগোনা আর ব্যস্ততা থাকতো পুরো রমজান মাস জুড়ে। এখনো এই দীর্ঘ প্রবাস জীবনে শাশুড়ি আম্মাকে দেখি রমজানের শুরু থেকেই কাগজ কলম নিয়ে হিসেব নিকেশ করেন। কাকে কত টাকা যাকাত দিবেন সেইসব লিখেন। অমুকের মা, তমুকের মা … লিখতেই থাকেন। লিস্ট দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। প্রতি বছর কিছু নতুন মানুষ লিস্টে যুক্ত হয়। কিছু মানুষের নাম বাদ দিতে হয় তাদের মৃত্যুজনিত কারণে। যাকাত নিতে আসা মানুষগুলো অধির হয়ে অপেক্ষায় থাকেন। গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নিতে আসেন। আম্মাও এক এক করে প্রত্যেককে মনে রাখেন। গত ক’বছর আগেও আমার বাবা-মা বেঁচে ছিলেন। এই রমজানে তাঁরা বেঁচে নেই। তাঁদের নিয়ে সেইসব আনন্দমুখর স্মৃতিগুলো প্রতি রমজানে নির্মমভাবে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠে এই দূরের দেশে। আগামী রমজানে আমরা কে থাকবো, অথবা থাকবো না, জানিনা। কেননা, মৃত্যুর কালো শীতলতা আমাদের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে।

রিমি রুম্মান

কুইন্স, নিউইয়র্ক

৯১০জন ৭৭৪জন
0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ