রুনু আপা স্বামী সহ এদেশে এসেছেন ওপি ওয়ান লটারি পেয়ে। বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল, যেখানে তখনো শিক্ষার আলো ছড়ায়নি__ তেমন পরিবেশ থেকে আসা তাদের। দু’জনেই কঠোর পরিশ্রমী। বিধায়, জব পেতে… টিকিয়ে রাখতে… ভাষা রপ্ত করতে কোন সমস্যা হয়নি। দু’জনেই দু’টি করে জব করেন। সকালে বের হন, ফিরেন রাতে। আমরা অনেকগুলো দিন পাশাপাশি বাসায় থেকেছি। সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি’র সময় কাটিয়েছি।
তাদের ছয় মাসের ছেলে আর পাঁচ বছরের মেয়ে দেশে থাকে দাদীর সাথে। সঙ্গে আনেননি। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে নিজেরাই উঠবেন অন্যের বাসায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা হয়ে। কষ্ট বুকে চেপে… অশ্রুজল আড়াল করে সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভাবনায় শক্ত মনোবল নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করেন তারা। ফোনে কথা বলা ব্যয়বহুলের সেই সময়টাতে সপাহান্তে বাচ্চাদের গ্রামের বাজারে আনা হতো মা’য়ের সাথে কথা বলানোর জন্যে। বছর তিনেক পরপর একবার দেশে গিয়ে দেখেও আসেন সন্তানদের। রুনু আপার স্বামী যেতে পারেন না জব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। তাছাড়া দু’জন মানুষ দেশে যাওয়াও অনেক খরচের ব্যাপার।
নাগরিকত্ব পাবার পর আর দেরী না করে সন্তানদের এদেশে নিয়ে আসেন। ততোদিনে সন্তানরা কিশোর-কিশোরী। আমি সেই কিশোরী মেয়েটিকে চুল বেঁধে দেই… সাজিয়ে দেই। কোথাও বেড়াতে গেলে পরিবারটিকে নিয়ে যাই। কিন্তু বিস্ময়ে লক্ষ করি, ওরা ওদের বাবাকে বাবা ডাকে না। কিছুই ডাকে না। রুনু আপাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম___ যে মানুষটিকে ওরা বেড়ে উঠার সময়টাতে কাছে পায়নি, সেই মানুষটি ওদের কাছে অনেকটা অপরিচিতের মতনই। বাবা ডাকতে লজ্জাবোধ করে। বাবা আর সন্তানদের মাঝে দূরত্বের কারনে কখন, ক্যামন করে যে একটা গ্যাপ তৈরি হল তা তারা বুঝে উঠতে পারেনি। এমন করেই পেরিয়ে যায় সময়। কিশোরী মেয়েটি পরিনত হয়। এক সকালে তার বিয়ের দাওয়াত পাই। সে চলে যায় পরের ঘরে।
রুনু আপার সাথে মাঝে মাঝেই জ্যাকসন হাইট্সে দেখা হয়ে যায়। বাসায় যাওয়া-আসা হয়না ব্যস্ততার কারনে। আজ তাদের ডে অফ। আমারও একটু অবসর। ভাবি, বৈকালিক চা টা না হয় আজ ওখানেই খাই। অনেকদিন ঐদিকটায় যাওয়া হয়না। ফোন করি। খুশী হলেন খুব। দুই বেডরুমের মোটামুটি বড় এপার্টমেন্টটিতে তারা মানুষ মাত্র দু’জন। ছেলেটি কোথাও জব করে। মেয়ের রুমটি ফাঁকা, থম্থমে, গুমোট। রুমের এখানে সেখানে মেয়েটির হাস্যজ্জল অনেক ছবি। শিশুকাল… কিশোরী… যুবতী… বধুবেশে…
রুনু আপার স্বামী সংগ্রামী জীবনের একথা ওকথা শেষে বিষাদময় কণ্ঠে বলেন, জীবনে একটা করতে গেলে অন্যটা হয়না। আমি অর্থহীন এদিক সেদিক তাকাই। দেয়ালের ছবি দেখি। ভাবি, একটা মানুষ দিনরাত পরিশ্রম করেছেন… অনেকগুলো মানুষকে ভালো রাখবেন বলে বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করেছেন… দেশে সন্তানদের, দরিদ্র স্বজনদের কষ্টার্জিত অর্থ পাঠিয়েছেন নিয়মিত… অর্থ সাশ্রয়ের জন্যে, জব রক্ষার জন্যে দেশেও যাননি। বিনিময়ে অনেকগুলো মানুষের জীবনের গতিপথ বদলেছে যদিও, কিন্তু নিজের সন্তানদের আদর করে জড়িয়ে ধরার সময়টা কখন যে ফুরিয়ে গেলো ! শিশুগুলোরও তাদের বন্ধুদের মতো উচ্ছলতায় বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পরার সময় কখন যে পেরিয়ে গেলো ! যখন তখন বাবা বলে জড়িয়ে ধরে বাবা’র বুকের উত্তাপ নেয়াটা যে স্বপ্নই থেকে গেলো ! অতৃপ্ত পিতৃমন… অতৃপ্ত শিশুমন…
আমরা তিনটি প্রাণী রুমটিতে। ধোঁয়া উঠা চা ও ততক্ষনে বরফ শীতল হলো। গল্পে গল্পে সন্ধ্যা হয়ে এলো। ঘরে বাতি জ্বালেনি কেউ ভুলে। জানালা দিয়ে আসা বাইরের ল্যাম্পপোস্টের নরম আলোয় আবিস্কার করি___ একজন বাবার ভেতরের বরফ জমা কষ্টগুলো দু’চোখ বেয়ে খরস্রোতা নদী হয়ে বইছে…আর একজন মা বুকের ভেতরের নরম জমিনে এতকাল কেমন করে দুঃখের চারাগুলো সযতনে রোপণ করে গেছে… কেমন করে……
## সব অর্জনের পিছনে কিছু বিসর্জন থাকে
সব পাওয়া’র পিছনে কিছু হারানো থাকে
সব সুখের পিছনে কিছু দুঃখের গল্প থাকে…
২৭টি মন্তব্য
শুন্য শুন্যালয়
সব অর্জনের পিছনে কিছু বিসর্জন থাকে, খুব ভালো বলেছেন।
তবে দিন শেষে সবকিছুর পর মাঝে মাঝে সব অর্জন বৃথা মনে হয়।
প্রবাসের এই গল্পগুলো শুনলে ভেতরে মোচড় দেয়। ভাল থাকবেন আপু ।
রিমি রুম্মান
তারপরও জীবন বয়ে চলে তার নিজস্ব স্রোতধারায়। ভাল থাকবেন আপনিও।
কৃষ্ণমানব
বিষাদের গল্পে
ভরে উঠেছে বাস্তবচিত্র!
দুঃখ কে স্পর্শ না করলে জীবনের মানেটাকে খুজে পাওয়া যায় না ।
চাওয়া-পাওয়ার দাবি
অনেক সময় অর্থবহ করে তোলে !
নির্জনতার ছোয়ায়
কোন এক সময়
হৃদয় পিন্জর বরফের চেয়ে ও শীতল আকারে রুপ নেয় !
অতৃপ্ত আছে বলেই মানুষ তৃপ্ত হতে ছোটে চলে অজানা গন্তব্যে !
রিমি রুম্মান
সুন্দর মন্তব্য। আমি কবিতার মত করে পড়ে নিলাম। ভালোলাগা জানবেন।
বনলতা সেন
আমরা আলোটুকু দেখি ,আলোকিত হই ।উত্তাপ নেই।অন্ধকারটুকু আড়ালেই থেকে যায়।
রিমি রুম্মান
অন্ধকারটুকু আড়াল থেকে বের করে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি মাত্র। গভীর ভালোবাসার দৃষ্টিতে আমরা আমাদের অর্জনের পেছনের মানুষটিকে যদি বুঝার চেষ্টা করি, তবেই তার কষ্টগুলো সার্থকতা পাবে। ভাল থাকবেন।
মামুন
ভালো লিখেছেন….
রিমি রুম্মান
ভাল থাকবেন। শুভকামনা রইলো।
জিসান শা ইকরাম
নিজকে বাবা হিসেবে কল্পনা করলাম এই বাবার সাথে
বেশ কষ্ট এবং শুন্য শুন্য লাগলো।
বাবা আর সন্তানদের মাঝে দূরত্ব যেনো না হয় কোন পরিবারে।
রিমি রুম্মান
বাবা- সন্তানদের মাঝে ভালোবাসা অটুট থাকুক। শুভকামনা জানবেন।
স্বপ্ন নীলা
সব পাওয়া’র পিছনে কিছু হারানো থাকে
সব সুখের পিছনে কিছু দুঃখের গল্প থাকে ‘’;;;;;;;;;;;;; অসাধারণ একটি পোস্টে অনেক অনেক ভাল লাগা জানিয়ে গেলাম
ভাল থাকবেন সব সময়
রিমি রুম্মান
ভাল থাকবেন আপনিও। মন্তব্যে অনুপ্রানিত হলাম ।
নওশিন মিশু
সম্পর্কের দূরত্ব খুব ভয়ংকর ব্যাপার যা একবার প্রতিষ্ঠিত হয়েগেলে কোন কিছুতেই আর ঠিক হয়না।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। সেই বাবা’কে আজও তার সন্তানরা বাবা বলে ডাকে না। সংকোচ বোধ করে। অথচ বাবার সব দায়িত্বই তিনি পালন করে গেছেন। সন্তানদের প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেননি __ এই যা ।
লীলাবতী
‘ একটা মানুষ দিনরাত পরিশ্রম করেছেন… অনেকগুলো মানুষকে ভালো রাখবেন বলে বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করেছেন… দেশে সন্তানদের, দরিদ্র স্বজনদের কষ্টার্জিত অর্থ পাঠিয়েছেন নিয়মিত… অর্থ সাশ্রয়ের জন্যে, জব রক্ষার জন্যে দেশেও যাননি। বিনিময়ে অনেকগুলো মানুষের জীবনের গতিপথ বদলেছে যদিও, কিন্তু নিজের সন্তানদের আদর করে জড়িয়ে ধরার সময়টা কখন যে ফুরিয়ে গেলো ! শিশুগুলোরও তাদের বন্ধুদের মতো উচ্ছলতায় বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পরার সময় কখন যে পেরিয়ে গেলো ! যখন তখন বাবা বলে জড়িয়ে ধরে বাবা’র বুকের উত্তাপ নেয়াটা যে স্বপ্নই থেকে গেলো ! অতৃপ্ত পিতৃমন… অতৃপ্ত শিশুমন… ‘
আপু এমন করে ভাবনি কোনোদিন।বাবার প্রতি মমতা শ্রদ্ধা আরো বৃদ্ধি পেলো।ধন্যবাদ আপু (y)
রিমি রুম্মান
জেনে ভাল লাগলো খুব… আমার নিজের বাবা নেই তো !
ছাইরাছ হেলাল
কিছু পেতে গেলে কিছু হারাতেও হয়। তবে অনুপাতটি আমাদের অজানা।
রিমি রুম্মান
আমরা আসলে তেমন করে ভাবতে শিখিনি, তাই এমনটি হয়। সব পাওয়ার পিছনে কিছু হারানোর গল্প থাকে, অগোচরে।
স্বপ্ন
সব অর্জনের পিছনে কিছু বিসর্জন থাকে
সব পাওয়া’র পিছনে কিছু হারানো থাকে
সব সুখের পিছনে কিছু দুঃখের গল্প থাকে… আপনার লেখায় তো এমন মন্তব্যই দিতে চেয়েছি আপু।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন ভালোবাসায়। আপ্লুত হলাম এমন মন্তব্যে।
আবির
সব অর্জনের পিছনে কিছু বিসর্জন থাকে
সব পাওয়া’র পিছনে কিছু হারানো থাকে
সব সুখের পিছনে কিছু দুঃখের গল্প থাকে
খুব মূল্যবান কথা বলেছেন, এইভাবে মাঝে মইধ্যে আমিও ভাবি, সব কিছু অর্জনের পিছনেই কোন না কোন দুঃখ থেকেই থাকে কখনো মূর্ত কখনো বিমূর্ত। সুন্দর লেখা।
রিমি রুম্মান
সুন্দর থাকুন। উপলব্দিগুলো মিলে গেলো আমাদের।
মরুভূমির জলদস্যু
আপনি খুব ভালো গুছিয়ে লিখতে পারেন। -{@
রিমি রুম্মান
আপনি গুছিয়ে পড়েছেন বলে আমার লেখাকেও গুছানো মনে হয়েছে। শুভকামনা জানবেন।
সায়ন্তনু
আপনার লেখা পড়লে কষ্ট লাগে। যদিও জীবন এমন।
রিমি রুম্মান
জীবন বিয়ে যায় তার মত করে। পথে পথে রেখে যায় ছোট ছোট কিছু সুখ, কিছু কষ্ট।
রিমি রুম্মান
জীব বয়ে যায় তার মত করে। পথে পথে রেখে যায় ছোট ছোট কিছু সুখ, কিছু কষ্ট।