পাওয়া-না পাওয়া

রিমি রুম্মান ৮ ডিসেম্বর ২০১৪, সোমবার, ১২:০৫:৪১অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২৭ মন্তব্য

রুনু আপা স্বামী সহ এদেশে এসেছেন ওপি ওয়ান লটারি পেয়ে। বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল, যেখানে তখনো শিক্ষার আলো ছড়ায়নি__ তেমন পরিবেশ থেকে আসা তাদের। দু’জনেই কঠোর পরিশ্রমী। বিধায়, জব পেতে… টিকিয়ে রাখতে… ভাষা রপ্ত করতে কোন সমস্যা হয়নি। দু’জনেই দু’টি করে জব করেন। সকালে বের হন, ফিরেন রাতে। আমরা অনেকগুলো দিন পাশাপাশি বাসায় থেকেছি। সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি’র সময় কাটিয়েছি।

তাদের ছয় মাসের ছেলে আর পাঁচ বছরের মেয়ে দেশে থাকে দাদীর সাথে। সঙ্গে আনেননি। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে নিজেরাই উঠবেন অন্যের বাসায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা হয়ে। কষ্ট বুকে চেপে… অশ্রুজল আড়াল করে সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভাবনায় শক্ত মনোবল নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করেন তারা। ফোনে কথা বলা ব্যয়বহুলের সেই সময়টাতে সপাহান্তে বাচ্চাদের গ্রামের বাজারে আনা হতো মা’য়ের সাথে কথা বলানোর জন্যে। বছর তিনেক পরপর একবার দেশে গিয়ে দেখেও আসেন সন্তানদের। রুনু আপার স্বামী যেতে পারেন না জব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। তাছাড়া দু’জন মানুষ দেশে যাওয়াও অনেক খরচের ব্যাপার।

নাগরিকত্ব পাবার পর আর দেরী না করে সন্তানদের এদেশে নিয়ে আসেন। ততোদিনে সন্তানরা কিশোর-কিশোরী। আমি সেই কিশোরী মেয়েটিকে চুল বেঁধে দেই… সাজিয়ে দেই। কোথাও বেড়াতে গেলে পরিবারটিকে নিয়ে যাই। কিন্তু বিস্ময়ে লক্ষ করি, ওরা ওদের বাবাকে বাবা ডাকে না। কিছুই ডাকে না। রুনু আপাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম___ যে মানুষটিকে ওরা বেড়ে উঠার সময়টাতে কাছে পায়নি, সেই মানুষটি ওদের কাছে অনেকটা অপরিচিতের মতনই। বাবা ডাকতে লজ্জাবোধ করে। বাবা আর সন্তানদের মাঝে দূরত্বের কারনে কখন, ক্যামন করে যে একটা গ্যাপ তৈরি হল তা তারা বুঝে উঠতে পারেনি। এমন করেই পেরিয়ে যায় সময়। কিশোরী মেয়েটি পরিনত হয়। এক সকালে তার বিয়ের দাওয়াত পাই। সে চলে যায় পরের ঘরে।

রুনু আপার সাথে মাঝে মাঝেই জ্যাকসন হাইট্‌সে দেখা হয়ে যায়। বাসায় যাওয়া-আসা হয়না ব্যস্ততার কারনে। আজ তাদের ডে অফ। আমারও একটু অবসর। ভাবি, বৈকালিক চা টা না হয় আজ ওখানেই খাই। অনেকদিন ঐদিকটায় যাওয়া হয়না। ফোন করি। খুশী হলেন খুব। দুই বেডরুমের মোটামুটি বড় এপার্টমেন্টটিতে তারা মানুষ মাত্র দু’জন। ছেলেটি কোথাও জব করে। মেয়ের রুমটি ফাঁকা, থম্‌থমে, গুমোট। রুমের এখানে সেখানে মেয়েটির হাস্যজ্জল অনেক ছবি। শিশুকাল… কিশোরী… যুবতী… বধুবেশে…

রুনু আপার স্বামী সংগ্রামী জীবনের একথা ওকথা শেষে বিষাদময় কণ্ঠে বলেন, জীবনে একটা করতে গেলে অন্যটা হয়না। আমি অর্থহীন এদিক সেদিক তাকাই। দেয়ালের ছবি দেখি। ভাবি, একটা মানুষ দিনরাত পরিশ্রম করেছেন… অনেকগুলো মানুষকে ভালো রাখবেন বলে বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করেছেন… দেশে সন্তানদের, দরিদ্র স্বজনদের কষ্টার্জিত অর্থ পাঠিয়েছেন নিয়মিত… অর্থ সাশ্রয়ের জন্যে, জব রক্ষার জন্যে দেশেও যাননি। বিনিময়ে অনেকগুলো মানুষের জীবনের গতিপথ বদলেছে যদিও, কিন্তু নিজের সন্তানদের আদর করে জড়িয়ে ধরার সময়টা কখন যে ফুরিয়ে গেলো ! শিশুগুলোরও তাদের বন্ধুদের মতো উচ্ছলতায় বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পরার সময় কখন যে পেরিয়ে গেলো ! যখন তখন বাবা বলে জড়িয়ে ধরে বাবা’র বুকের উত্তাপ নেয়াটা যে স্বপ্নই থেকে গেলো ! অতৃপ্ত পিতৃমন… অতৃপ্ত শিশুমন…

আমরা তিনটি প্রাণী রুমটিতে। ধোঁয়া উঠা চা ও ততক্ষনে বরফ শীতল হলো। গল্পে গল্পে সন্ধ্যা হয়ে এলো। ঘরে বাতি জ্বালেনি কেউ ভুলে। জানালা দিয়ে আসা বাইরের ল্যাম্পপোস্টের নরম আলোয় আবিস্কার করি___ একজন বাবার ভেতরের বরফ জমা কষ্টগুলো দু’চোখ বেয়ে খরস্রোতা নদী হয়ে বইছে…আর একজন মা বুকের ভেতরের নরম জমিনে এতকাল কেমন করে দুঃখের চারাগুলো সযতনে রোপণ করে গেছে… কেমন করে……

## সব অর্জনের পিছনে কিছু বিসর্জন থাকে
সব পাওয়া’র পিছনে কিছু হারানো থাকে
সব সুখের পিছনে কিছু দুঃখের গল্প থাকে…

৪৭৫জন ৪৭৫জন
0 Shares

২৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ